সারাদিন রাত ফেসবুকে ডুবে থাকি। এটিএম বুথের মতো 24/7 সার্ভিস দিয়ে যাই। সকাল বেলা তাই পলাশির রণক্ষেত্রের হুংকার শুনে ঘুম ভাংগে। মায়ের সেই মহান বাণীতে আড়মোড়া ভাংগি। “কিরে রাইতে কি চুরি করতে গেছিলি। একটা দিন সকাল সকাল উঠলে কি তোর মহাভারত অশুদ্ধ হয়া যায়।” মায়ের এই বাণীর সাথে বাবার বাণীও যোগ হয়, “তোমার ছেলেরে বল নাইট গার্ডের চাকরি নিতে। নবাবজাদা আইছে। দিনের ১২ টা পর্যন্ত ঘুমাবে। এইগুলা কি সুস্থ মানুষের জীবন।”
প্রতিদিন ভাবি আজ রাত ১২ টা বাজার সাথে সাথে No ফেসবুক No হাংকি পাংকি। Only ঘুম। বিছানাও করে ফেলি তারাতারি। ঘুমের আয়োজন শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ি। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। গায়ে কাঁথাটা টেনে নেই। পা থাকে কাঁথার বাইরে। নাইলে গরম লাগে। কোলবালিশটাকে টেনে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরি আর ভাবি। No ফেসবুক No হাংকি পাংকি। Only ঘুম।
জুকারবার্গের গুস্টি উদ্ধার করি মনে মনে, “শালার আর কিছু পাইলি না। তোর ফেসবুক ক্যান বানান লাগে।” এপাশ থেকে ওপাশে ফেরার সময় মনে খচ খচ করে। পোস্ট যে করলাম। লাইক কমেন্ট কয়টা আসলো। একটা গ্রুপে “মা দিবস” এর জন্য লেখা দিছি। কি অবস্থা কে জানে। না না না। No ফেসবুক No হাংকি পাংকি। Only ঘুম।
ধ্যাৎত্তেরিকা! এইটা কোন কথা। আচ্ছা ৫ মিনিট। জাস্ট ৫ মিনিট ফেসবুকের নোটিফিকেশন দেখেই বের হয়ে যাবো। ফেসবুকে ঢুকলাম। ঢুকেই দেখি কিশোর’দা আমাকে ম্যানশন করছে। মাকে নিয়ে লেখাটা বিজয়ী হয়েছে। কুরিয়ার করার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার চাইছে। উপহার ওরা মায়ের কাছেই পাঠাবে। তারাতারি ঠিকানা ইনবক্স করলাম।
“এই, এই ছোট ভাইয়া উঠ তারাতারি।” ছোট বোনের ধাক্কায় ঘুম ভেংগে গেল। গতকাল রাতেও ৫ মিনিটের জন্য ফেসবুকে ঢুকে ভোর ৫ টায় ঘুমিয়েছি। “কি হইছেরে বুবুন। বাবা এতো চিল্লায় ক্যান।” বুবুন আমাকে ঈশারা করে আস্তে কথা বলতে বলে বলল, “তুই এতো বেলা করে ঘুমাস কি জন্য। প্রতিদিন বাবা মায়ের সাথে এটা নিয়ে তর্ক করে।” আমি কাঁথাটা গায়ে টেনে বুবুনের হাত মাথায় রেখে বললাম, “দেতো লক্ষি মাথায় একটু হাত বুলায় দে।”
– ছোট ভাইয়া জানিস বাবা কি বলেছে। হি হি হি!
– হাসতেছি ক্যান। কি বলছে বল। আরে এইদিকে না। এইদিকের চুল একটু টেনে দে। বল।
– দিচ্ছি তো। শোন না। বাবা বলছে তোকে রিক্সা কিনে দিবে। হি হি হি!
– দিলে বাইক কিনে দিতে বল। রিক্সা কেন?
– বাবা বলছে, যে ছেলে দিনে পরে পরে ঘুমায় তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। রিক্সা চালানো ছাড়া তার গতি না। ভাই তোকে রিক্সা কিনে দিলে আমাকে চড়াবি? হি হি হি!
– ভাড়া দিলে চড়াবো। মাগনা চড়াবো না।
– ইসসস তোকে এই যে মাথায় হাত বুলাই দিচ্ছি। এর বিনিময়ে চড়াইস।
– আচ্ছা। বাবাকে বলিস বিএমডাব্লিউ বা মার্সেডিস বেঞ্জ এর রিক্সা ছাড়া আমি চালাবো না।
– ইসসস কি কথা। তোকে আসলে রিক্সা না ঠ্যালা গাড়ি কিনে দেওয়া দরকার। হি হি হি।
এই বলে বুবুন হাসতে হাসতে এক দৌড়ে রুম থেকে পালালো। আমার কলিজার টুকরা এই বোনটা। আমার পুরো পৃথিবী একদিকে আর এই বোন আরেকদিকে।
– মা ২০০ টাকা দেও তো।
– নাই আমার কাছে।
– আহা দাও না।
– তুই কি আমার কাছে টাকা জমা রাখছিস যে চাইলেই পাবি।
– এমন করো কেন। দাও না মা। ধার দাও ফেরত দিয়ে দিবো।
মা জানে লাভ নেই। আলমিরা খুলে মায়ের ট্রেজার থেকে ৪ টা ৫০ টাকার নোট দিলো।
– তুই আমার টাকা ফেরত দিবি। কত টাকা ধার নিছিস হিসাব আছে তোর।
– ছি! এইসব কি কথা মা। মায়ের ঋণ কি কখনো শোধ হয়। শুনছো কখনো।
আমার কথা শুনে মা হাসে। আমিও হাসি। হাসতে হাসতে বাসা থেকে বের হই। তিন ভাই একবোনের মধ্যে আমি ৩ নম্বর সিরিয়ালে আর বুবুন হলো সবার ছোট। বড় ভাইয়া জব করে। বিয়ের জন্য পাত্রি দেখা হচ্ছে। বড়রা মনে হয় একটু বলদ হয়। একটা প্রেম করতে পারলো এটা একটা কথা। তাও আমার ভাই হয়ে। আরে আমাকে বললেই তো হতো দুই চারটা গার্লফ্রেন্ড দিয়ে দিতাম। মেজ ভাইয়া হলো ঘাড় ত্যাড়া পাবলিক। মেজ গুলা সব এমনই হয়। ভার্সিটি থেকে বের হবে বের হবে করছে। কিন্তু হতে পারছে না। তবে ছোটরা অনেক ভাল হয় লক্ষি হয় শান্ত শিষ্ট হয়। এটা আমি আমাকে দিয়েই বুঝেছি।
টুকটাক গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ করি আমি। একটা অর্ডার নিতে আসছি। এই অর্ডারটা পেলে মায়ের জন্য একটা শাড়ি আর বুবুনের জন্য লং স্কার্ট কিনবো। মাঝে মাঝেই টুকটাক কেনাকাটা করি সবার জন্য। গত ঈদে বাবাকেও একটা শার্ট গিফট করেছিলাম। বাবা শার্ট গায়ে দিয়ে মাকে কি যেন বলছিল। আমি ডাইনিং টেবিলে ভাত খেতে খেতে মায়ের রুমে কান খারা করে রাখলাম।
– তোমার ছেলে কোথা থেকে টাকা চুরি করে শার্ট কিনলো।
– আহ! কি বলো এইসব। ছেলে টুকটাক কাজ করে টাকা জমায়ে কিনছে। ও শুনলে মন খারাপ করবে।
– কি এমন কাজ করে। সারাদিন তো পরে পরে ঘুমায়। ও কি কাজ করবে হ্যাঁ। ছাগল দিয়ে কি হাল চাষ হয়।
– তুমি কি বলতো। ছেলেটা এতো সখ করে কিনে আনলো। আর তুমি কি সব বলতেছো।
– যা বলছি ঠিক ই বলছি। তবে তোমার ছাগলটার চয়েস ভাল।
আমার এটাই জানার দরকার ছিল। যাক হিটলারের তাইলে শার্ট পছন্দ হইছে। পরে অবশ্য মা বলেছে। শুধু যে পছন্দ হইছে তা না। অনেক পছন্দ হইছে। শোয়ার আগেও নাকি আয়নায় দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখেছে আর আর একটু পরে পরে বলেছে,”তোমার ছাগলটার চয়েস ভাল”। মা আবার অভিনয় করেও দেখালো বাবা কি করে বলেছে। মায়ের অভিনয় দেখে আমি আর বুবুন একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পরি। বাবা নাকি ঐদিন আর শার্টটা খুলেই নি। শার্ট পড়েই ঘুমিয়েছে। ফেসবুকে নিউজ ফিড দেখছিলাম। এমন সময় মা রুমে এসে দেখলো আমি মগ্ন হয়ে ফেসবুকে ডুবে আছি।
– মোবাইলের ভিতরে ঢুকে যা না। তোর তো বাপ মা ঘর বাড়ি কিচ্ছু নাই।
– কি যে বল না মা।
– শোন এই নে ইলেক্ট্রিক বিল আর টাকা। আমি আর বুবুন সকালে তোর সেজো খালামনির বাসায় যাবো। নাস্তা বানিয়ে রেখে যাবো। সকাল সকাল উঠে নাস্তা খেয়ে বিল দিয়ে আসবি। ডেট মিস করলে তোর বাবা তোকে তক্তা বানাই দিবে…
এক নিঃশ্বাসে মা এতো গুলো কথা বলে একটু দম নিলো।
– আর শোন আজ একদম রাত জাগবি না। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়বি বাপধন।
আমি লক্ষি ছেলের মতো মাথা নাড়ালাম। মা যতই বকুক আমায়, যতই ঝারুক আমি জানি আমি হলাম মায়ের কাছে রাজপুত্র। এই জন্যই তো এতো বেয়াড়া হতে পারছি। হঠাৎ মাথায় এলো আগামীকাল তো মা দিবস। কালই তো মায়ের নামে গিফট আসার কথা। মা খালামনির বাসায় গেলে কেমনে হবে।
মায়ের কথা কি করে ফেলি। মা বলছে সকাল সকাল ঘুমাইতে। আমি সারারাত জেগে ফেসবুক চালিয়েছি আর সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি। তবে মায়ের কথা পুরোপুরি রাখতে পারলাম না। সকাল হওয়ার আগেই ভোর পৌনে ৫ টার দিকে ঘুমুতে গেলাম।
আমার সামনে বিশাল সৈন্যবাহিনী। ঢাল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করছি। হঠাৎ একটা বিপক্ষের সৈন্য আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। আমার পিঠের উপরে উঠে আমার পিঠের উপরে কিল ঘুসি দিচ্ছে আর চুল টানছে। আর মুখ দিয়ে আদো আদো বলে বলছে, ” ভাইয়া, ভাইইইয়া…”
ঘুমটা ছুটে গেল। চোখ মেলেই বুঝতে পারলাম আমার পিঠের উপরে কেউ বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেজো খালামনির ছোট্ট বিলাইর হাড্ডিটা। ওকে দেখেই মন ভাল হয়ে গেল। আড়াই বছরের এই পিচ্চি ছেলের হাতের মাইরে এতো ব্যাথা কি করে হয় বুঝিনা। ওকে পিঠ থেকে নামিয়ে বুকে নিয়ে শুয়ে আদর করে দিলাম। উফফফ কি স্বপ্নই না দেখছিলাম। চোখ চলে গেল দেয়াল ঘড়ির দিকে। দেড়টা বাজে। মা আর বুবুন তাহলে খালার বাসা থেকে চলে। তারমানে খালামনিও আসছে। আমি নাই। ঠিক ঐ সময় মা কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজতে গুঁজতে চোখ মুখ লাল করে আমার রুমে ঢুকলো। আমি পিচ্চি ভাইকে একপাশে সরিয়ে মায়ের সামনে থেকে ওয়াশরুমে দৌড় দিলাম ৫ এমবিপিএস স্পিডে।
মা ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল ৫ মিনিটে বের হতে। বুকে এখনো হাতুড়ি বাজছে। মা যতই আমায় আদর করুক আর সোহাগ করুক এই মহিলাকে প্রচন্ড ভয় পাই আমি। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ৪ মিনিটের মাথায় ওয়াশরুম থেকে বেড়ুলাম। তারাতারি রেডি হয়ে বিলের কাগজ আর টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বের হওয়ার আগে খালামনি আর মা ডাক দিলো খেয়ে বের হওয়ার জন্য। কে শুনে কার কথা। এখন নাস্তা করতে বসলে মা কতক্ষণ ছিলতো আমাকে।
আহহহ! বিল দিয়ে একটা টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা সিগারেট খাচ্ছি। দিনের প্রথম সিগারেটটা বেশ আয়েস করেই খাই আমি। যদিও এখনো পেটে কিছু পরেনি। আমার না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে। এদিক ওদিক কিছুক্ষন ঢং ঢং করে বাসায় গেলাম সাড়ে ৩ টার দিকে। বাসায় ঢুকেই দেখি বুবুন আর পিচ্চি ভাইটা বাসা মাথায় তুলে ফেলেছে। ড্রয়িংরুমের সোফায় মা আর খালামনি। মা কাঁদছে। হাতে একটা কাগজ। বুকটা ধক করে উঠলো। দেখি খালামনি হাসছে। মা আমার কাছে ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। মুখে চুমু দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
– মাকে অনেক ভালবাসিস।
– হ্যাঁ বাসিতো। কিন্তু কি হইছে মা। কান্না করতেছো কেন?
– এতো ভালবাসিস বাবাই আমার। কখনো বললিও না মুখ ফুটে।
– লজ্জা লাগে বলতে। কিন্তু কি হইছে মা…
মা আমায় থামিয়ে দিয়ে কাগজটা দেখালো। চেয়ে দেখি যেই গল্পটা লিখে বিজয়ী হয়েছি সেই গল্পটা। ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলাম। কুরিয়ার চলে আসছে তাহলে। সেজো খালামনি একটা ক্যান্ডি এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে ধর। চকলেক আর দুইটা বই উপহার আসছে।”
তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে। অশ্রুভেজা চোখে কি যে মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে। ভালবাসি মা অনেক ভালবাসি। কিন্তু লজ্জা লাগছে বলতে। লজ্জা লাগে বলেই তো গল্পে বলেছি, “মাগো তুমি আমাদের ভাইবোনদের কাছে গাছের মতো। মায়ার শিকড় দিয়ে এই সংসারে আজো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছো। গাছ ভাল থাকলে গাছের ফলও ভাল থাকে। মাগো তোমার ছেলেটা তোমায় এই এত্তো গুলা ভালবাসে মা, এই এত্তো গুলা। চেয়ে দেখো মা, এই এত্তো গুলা।”