আমি যখন তালা খুলছিলাম তখনও আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে মিতু আমার সাথেই রয়েছে । ঠিক আমার পেছনে দাড়িয়ে রয়েছে । আমার সাথে আমার ঘরে ঢুকার জন্য অপেক্ষা করছে । আমার দিকেই তাকিয়ে আছে নিশ্চয়ই । আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার বুকের ভেতরে যে সেই কখন থেকে ধুকধুক শুরু হয়েছে সেটা আস্তে আস্তে বাড়ছেই । আমি দরজা খুলে এক পাশে সরে দাড়ালাম । ওকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলাম । মিতু একটু যেন হাসলো । তারপর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো । আমি ওর পেছন পেছন ঢুকলাম !
মোহাম্মাদ পুরে ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে আমি থাকি । দুই রুম আর ড্রয়িং ডাইনিং এক সাথে । বেশি দিন হয় নি এই বাসাটা ভাড়া নিয়েছি । এখনও মিতুকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে নেওয়া হয় নি । আমি এতো দিন একটা মেসেই থাকতাম । ইচ্ছে ছিলো আর একটু গুছিয়ে নিলে মিতুকে তুলে আনবো । তখন একটা আলাদা বাসা নেওয়া যাবে । কিন্তু মিতুর পাশাপাশি কাছাকাছি থাকার একটা তীব্র একটা ইচ্ছে আমাকে এই বাসাটা ভাড়া নিতে বাধ্য করেছে । বুকের একটা আকাঙ্খা ছিলো যে মাঝে মাঝে মিতু হয়তো আমার ঘরে আসবে ।
দুজন বসে গল্প করবো । তবে সে হওয়ার সম্ভবনা ছিল অনেক কম । আমি শুরু থেকেই বুঝতে পারতাম যে মিতু যেমনটা স্বামীর স্বপ্ন দেখেছিলো আমি হয়তো তেমন কেউ ছিলাম না । তাই আমার কাছ থেকে ও দুরে দুরেই থাকতো । তবে আমার কেন জানি একটা ভরশা ছিলো ও একদিন আমার ভালবাসাটা বুঝতে পারবে ! জানি না এখনও পেরেছে কি না । তবে এটা হয়তো প্রথম ধাপ ! ঘরের আলো জ্বালানোর পরে মিতু ঘুরে ঘুরে ঘর দেখতে লাগলো । বিয়ের পর বলতে গেলে মিতু এই প্রথম আমার ঘরে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-বাহ ! ঘর তো ভালই সাজিয়েছেন দেখছি ! আমি হাসলাম আবারও । মিতু বলল
-না সত্যি বলছি ! আমার পছন্দ হয়েছে আপনার ঘর ! আমি বললাম
-আমাদের ঘর !
কথা শুনে মিতু হাসলো । কথাটা যেন ওর পছন্দ হয়েছে । তবে কিছু বলল না । আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই আমার ফোনে চলে এল । স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি মিতুর বাবা ফোন দিয়েছে । এই নিয়ে উনি বেশ কয়েকবারই ফোন দিয়েছে । যখন মিতুর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছিলো তখনও ফোন দিয়েছে । ওর ফোন নাকি বন্ধ পাচ্ছে । আমি ওর সাথে আছি দেখে আর কিছু জানতে চায় নি । আমি বলেছিলাম খাওয়া দাওয়া শেষে আমি ওকে বাসায় পৌছে দিব । এখন রাত হয়ে গেছে দেখে আবার ফোন দিয়েছে । আমি ফোনের মিতুর দিকে তুলে ধরলাম । মিতু হাত দিয়ে ইশারা করলো যে ও ধরবে না ! বাধ্য হয়ে আমাকে রিসিভ করতে হল । সালাম দেওয়ার পর বললাম
-হ্যালো আব্বা
-তোমরা কোথায় ?
-এই তো আব্বা ! আসলে
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । একটা অস্বস্থি কাজ করছিলো । মিতুর দিকে তাকিয়ে দেখি ওমুখ টিপে হাসছে । আমাকে বিব্রত হতে দেখে যেন মজা পাচ্ছে । আমি বললাম
-আসলে বাবা মিতু হঠাৎ আমার বাসায় আসতে চাইলো । ওপাশ থেকে কিছু সময় মিতুর বাবা কোন কথা বলল না ।যেন বুঝতে পারছে না কি বলবে । বুঝতে পারছি উনিও খানিকটা অস্বস্থিতে পড়ে গেছে । তারপর দ্রুত বলল
-আচ্ছা । সমস্যা নেই । রাতে খেয়ে নিও ।
-জি আব্বা !
আমি ফোন রাখার সাথে সাথে দেখি মিতু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরছে । আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম অবাক হয়ে । কোন মতে হাসি থামিয়ে বলল
-তা শ্বশুর জামাইয়ে কি কথা হল !
-আমাকে এ অবস্থায় ফেলে তোমার মজা লাগছে! তাই না ?
-খুব ! মিতু হাসতেই লাগলো । আমি বলল আচ্ছা আমি গোসলে ঢুকি ! তুমি ফ্রেস হয়ে নাও । রাতে কি কিছু খাবে আর ! বুয়া রান্না করে রেখে গেছে ।
-আমি কিছু খাবো না । আপনি গোসল করে আসুন !
শোবার ঘরের বাথরুমটা ওর জন্য ছেড়ে দিয়ে আমি কমন বাথে ঢুকলাম গোছলের জন্য । একটু যেন সময় নিয়েই গোসল করলাম । গায়ে ঝরনার পানি পড়ছিলো আর আমার পুরানো কথা গুলো মনে যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো । কিভাবে মিতুকে প্রথম দেখলাম । আর আজকে ও আমার বৌ হয়ে আমার ঘরে !
বন্ধু সজিবের বিয়ে অনুষ্ঠান ছিল সেদিন । ধানমন্ডির একটা কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছিলো সেটা । আমি বিরক্ত মুখে বসে ছিলো । বিয়ে আগেই হয়ে গেছে । এখন কেবল অনুষ্ঠান । খাওয়া দাওয়া চলছে । আমি এক একটা টেবিলে বসে চুপ চাপ খাচ্ছিলাম । ঠিক সেই সময়েই আমি মিতুকে দেখতে পাই ।
অন্যান্য মেয়েরা যেখানে বিয়ের সাজ দিয়ে পাল্লা দিয়ে সেখানে মেয়েটা তেমন কিছুই সাজে নি । কিন্তু তবুও আমার কাছে কেবল মনে হল আমি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর আমার মায়াময় মুখটা দেখছি । শ্যামলা চেহারার মেয়েটাকে দেখে আমার খাওয়া আটকে গেল । আমি আর কিছু খেতেই পারলাম না ।
নিজের মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকটা ছবি তুলতে পারলাম । কিন্তু আমি জানি আমি কি ঝামেলার ভেতরে পড়ে গেছি । আমার নিজের ভেতরের পরিবর্তনের ব্যাপারটা আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিলাম । যতটা সময় মিতু সেখানে ছিল ওদের পেছন পেছনেই থাকতাম । লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম মেয়েটাকে ।
মিতুর নাম পরিচয় বের করতে খুব বেশি সময় লাগলো না । সজিবের কোন এক আত্মীয় হয় ওরা । আমার জন্য ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল । কোন ভনিতা না করে সজিবকে বললাম সব কিছু । ও বলল যে ও দেখবে ব্যাপারটা ! তবে আমি সেখানেই থেমে ছিলাম না । মাঝে মাঝে ওর ক্যাম্পাসে চলে যেতাম । ও যেহেতু আমাকে চিনতো না তাই আমার জন্য ব্যাপারটা একটু স হজ হল । ওকে দেখতাম দুর থেকেই । বন্ধুদের সাথে ক্লাসের শেষে গল্প করছে হাসছে । রিক্সা করে বাসায় আসছে । মার্কেটে যাচ্ছে । অনেক কিছু । ডায়রী লেখার অভ্যাস ছিল বসে কথা গুলো লিখে রাখতাম । আর ওর সাথে কল্পনাতেও কত কথ বলেছি কে জানে । ঘরে ফিরে পুরো লেখা গুলো পড়তাম । মিতুকেই চোখের সামনে দেখতে পেতাম যেন ।
তারপর সজিবের মাধ্যমেই বিয়ের কথাটা গেল ওদের বাসাতে । আমার চাকরিটা খুব একটা আহমরি ছিল না, আমার একটা ভয় ছিলো যে ওরা হয়তো মানা করে দিবে । তবে সজিব কি করলো জানি না দেখলাম ওরা রাজি হয়ে গেল । আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম । তবে সেটা তখনও আকাশেই ছিল আমার দরা ছোয়ার বাইরে । মিতু আমাকে ঠিক পছন্দ করলো না । হয়তো ও যেমন আশা করেছিলো তেমনটা আমি ছিলাম না । ওর বড় দুই বোনের স্বামীরা বেশ ভাল চাকরি করতো । এটাও একটা কারন হতে পারে । এটা থেকেই আমি চেষ্টা করতে লাগলাম যে আমাকে আরও ভাল কিছু করতে হবে । চাকরির বয়স তখনও বেশ ভালই ছিল । উঠে পড়ে লেগে গেলাম ।
মিতু আমার সাথে ঠিক কথা বলতো না । খানিকটা এড়িয়ে এড়িয়ে চলতো হয়তো । তুলে নেই নি বলে আমাদের দেখা সাক্ষাত হত না । মাঝে মাঝে যেতাম ওদের বাসাতে । মিতু অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আমার সামনে আসতো । আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম । খাবার টেবিলে মিতুর বাবা অনেক কথা বলতো । মিতু এই অবহেলা আমি মেনেই নিয়েছিলাম । অপেক্ষা করছিলাম যে আমার ভাল কিছু একটা হলে ও নিশ্চয়ই সব কিছু কাটিয়ে উঠবে । তখন আমাদের চমৎকার একটা সংসার হবে ! মিতুর সাথে কথা না হলেও আমার ডায়রিতে প্রতিদিন ওর সাথে কথা হত । ওকে কি ভাবে ভালবাসি সেটা আমি ওকে বলতাম আমার লেখাতে !
গোসল সেরে যখন বাইরে বের হলাম আমাকে একটু অবাক হতে হল । খাবার টেবিলে খাবার সাজানো । দেখেই বুঝা যাচ্ছে সেগুলো গরম করা হয়েছে । মিতুর দিকে তাকিয়ে সব থেকে বেশি অবাক হলাম । ওর পরনে আমার একটা টিশার্ট আর আমারই একটা থ্রিকোয়াটার প্যান্ট ! নিজের পার্টি পোষাক বদলে ও আমার কাপড় পরেছে । আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিত হেসে বলল
-আপনার অনুমুতি না নিয়ে আপনার টিশার্ট পরলাম । আসলে রাতে অতো ভারি পোষাক পরে ঘুমানো যাবে না তো !
-না না ঠিক আছে !
-আসুন খেতে আসুন !
সত্যি বলতে কি আমার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে । আমি আমার ডায়রিতে যে কল্পনার কথা গুলো লিখতাম তার ভেতরে এই দৃশ্যটা অনেকবার এসেছে । আমি গোসল শেষ করে এসেছি । মিতু আমার জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে !
রাতের বেলা মিতু অনেক কথা বলল । এতো কথা বলবে আমি ঠিক ভাবি নি । ভেবেছিলাম আমিই বেশি কথা বলবো । বেশ রাত করেই ঘুমাতে গেলাম । সেখানে বাঁধলো আরেক সমস্যা । হিসাব মত মিতু আমার স্ত্রী কিন্তু সেটা কেবলই কাগজে কলমে । তাই ও হয়তো রাতে একই সাথে ঘুমাতে অস্বস্তি বোধ করছিলো । আবার আমাকে সেটা বলতেও পারছিলো না । ওকে শোবার ঘরে ঘুমাতে বসে আমি সোফার উপর চলে এলাম । এক সাথে থাকা হয়তো সামনে আরও অনেক হবে । আজকের জন্য এই ভাল লাগা টুকুই থাকুক !
সকাল বেলা আমি যখন অফিসের জন্য বের হচ্ছি মিতু তখনও ঘুমিয়ে । যাওয়ার সময় ওকে ডেকে তুললাম না । ঘুমাক । কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল । বিছানার পাশের টেবিলে একটা ছোট নোট রেখে গেলাম । আর একটা এক্সট্রা চাবি । নোটে লিখে আসলাম যে যাওয়ার যেন দরজা লাগিয়ে যায় । আর যে কোন দরকারে ফোন যেন করে ! আমি সত্যিকার অর্থেই অনেক বেশি আনন্দময় মেজাজে ছিলাম । কিন্তু দুপুরে মিতুর ফোন পেয়ে খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । মিতু কান্নার জড়িতো কন্ঠে আমাকে বলল
-তুমি এখনই বাসায় আসো ! মিতু কাঁদছে ! আমি কোন মতে বললাম
-কি হয়েছে ? মিতু আরও একটু ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল
-তুমি এখনই বাসায় আসো ! এখনই ।
দুপুরে আমার ঠিক বাসায় হয় নি । কিন্তু আজকের ঘটনা ভিন্ন । বস কোন রকম বলেই আমি অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম । বাসায় পৌছাতে আরও ঘন্টা খানেক পার হয়ে গেল । প্রতিটা সময় আমি কেবল চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি । এই টুকু সময়ের মাঝে আবার কি হয়ে গেল । কয়েকবার ফোন দিলাম কিন্তু ও ফোন ধরলো না ।
আমি যখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছি তখনও আমার বুকের ভেতরটা ধুপধুপ করছে । ওর যদি কিছু হয়ে যায় আমি কিভাবে ঠিক থাকবো আমি জানি না । আমি আসলেই জানি না ! আমি আর কিছু ভাবতে চাইলাম না !
দরজা খুলে বসার ঘরে দাড়াতেই মিতুকে দেখলাম । শোফার উপর পা তুলে বসে আছে । সামনে আমার লেখা ডায়রি খোলা । ওর চোখ ভেজা তখনও ! আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মিতু ডায়রী ফেলে উঠে দাড়ালো । তারপর এল দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । আমার বুকে মাথা রেখেন যেন ওর কান্নার বেগ আরও বাড়লো । আমি কোন রকমে বললাম
-কি হয়েছে ? কাঁদছো কেন ? মিতু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আরও কিছুটা সময় ফোঁফাতে লাগলো ! তারপর বলল
-আমাকে কেন এতো ভালবাসো তুমি ? কেন ? আমি তো দেখতে ভাল না । কালো একটা মেয়ে ! তবুও কেন এত।
ওকে নিয়ে লেখা কথা গুলো এতো সময় পড়ছিলো ও । হঠাৎ আমার বুকের ভেতরে একটা তীব্র আন্দোলন হল । আমার সব কিছু মিতু জেনে গেছে । একই সাথে একটু অস্বস্থি আর তীব্র একটা আনন্দবোধ করলাম আমি । আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
-চুপ ! আমার বউকে কেউ কালো বলবে সেটা আমার পছন্দ না । আমার বউ হচ্ছে হচ্ছে পৃথিবীর সব সুন্দর বউ ! মিতুর কান্নার বেগ যেন আরও একটু বাড়লো । কতটা সময় ওকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম আমি জানি না । তবে আমার নিজের কাছেই ভাল লাগছিলো অনেক বেশি । একটা মিতু আমার বুকে মাথা রেখেই বলল
-আমাকে তুমি মাফ করে দাও । তোমাকে যে অবহেলা করেছি সেটা আমার একদম উচিৎ হয় নি । আর তুমি যেমন আছো যেভাবে আছো এখন থেকে আমার সব কিছু তুমি ! তোমার আর ভাল চারকরি পেতে হবে না । কিছু করতে হবে না আমার জন্য ! আমার নিজেও কেন জানি চোখ সিক্ত হয়ে উঠছিলো । মিতুর কন্ঠই বলে দিচ্ছে আমি যে ঠিক যে যে সপ্ন দেখেছিলাম ওকে সেগুলো সব সত্যি হতে চলেছে । অথবা এরই ভেতরে অনেকটাই সত্যি হয়ে গেছে । আমি ওকে বললাম
-একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো ?
-কি !
-তুমি আমাকে আপনি বাদ দিয়ে তুমি বলা শুরু করেছো !
মিতু হেসে ফেলল । তারপর আরও একটু শক্ত করেই যেন আমাকে জড়িয়ে ধরলো । জীবনের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার দিন গুলো যেন শুরু হয়ে গেছে আমার !