২০১৫ সাল। আমি তখন এসএসসি এক্সাম দিয়ে নতুন ফেসবুক ব্যবহার করি,নাম ছিলো জাহান ইতি। আমার এক ভাই খুলে দিছিলো আইডি,নাম ও উনি দিয়েছিলো। নতুন নতুন ফেসবুক চালাতাম তখন,প্রায় সারাদিনই এক্টিভ থাকতাম। রেজাল্টের পর কলেজে ভর্তি হলাম,তখন তুহিন হাওলাদার সৌরভ নামে একটা ছেলের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট আসে। আমাদের ক্লাসের অনেক গুলো ছেলের সাথে মিউচুয়াল দেখে ভেবেছিলাম যে আমাদের ক্লাসের কেউ হয়তো।একসেপ্ট করি তখনি।
তারপর শুরু হয় চ্যাটিং। জানতে পারি পরে যে ও আমাদের কলেজে ভর্তি হয় নি,অন্য একটা কলেজে ভর্তি হয়েছে।কিন্তু ওর অনেকগুলো ফ্রেন্ড আমাদের কলেজে ভর্তি হয়েছে। চ্যাটিং করতে করতে তুহিন হয়ে গেলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সারাদিন চলে যেতো ঝগড়াঝাটি করে। তখন আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে আমাকে প্রপোজ করে বাসায় এসেই আমি তুহিনকে সেটা বলি,শুনেই ও রেগে যায়। আমি বুঝতাম ও আমাকে ভালোবাসে,আমার ও ওর প্রতি দুর্বলতা ছিলো। দিনগুলো খুব ভালো যাচ্ছিলো।
আমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিলাম,ক্লাসের অনেকে আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না,আমাদের ছিলো অনেক কম্পিটিশন ক্লাসে ফার্স্ট পজিশন নিয়ে । লেখাপড়ার বিষয় ছাড়া আমার সাথে কথা বলার জন্য ক্লাসেরবকেউ আমাকে নক দিতো না। ফার্স্ট গার্ল হওয়ার কারনে নাকি অন্য কোনো কারনে আমি জানি না,কিন্তু আমার কোনো ফ্রেন্ড ছিলো না।তুহিন ও আমার সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পরে অন্যসব ফ্রেন্ডদের থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছিলো।ওরা সবাই যখন একসাথ হতো সবাই আড্ডা দিতো আর ও একপাশে বসে আমার সাথে চ্যাটিং করতো। তাই তুহিনের সাথে আমার বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়ে যায়।
২জন ২জন কে প্রচন্ড ভালোবাসি কিন্তু কেউ কাউকে বলি না।ফেসবুকে আমি আমার কোনো ছবি দিই নি,তুহিন ও দেয় নি,কিন্তু একদিন তুহিন আমার কাছে আমার একটা ছবি চায়,আমিও দিই।কিন্তু আমি চাইতে পারি নি ওর কাছে ওর ছবি। আমাদের ছিলো প্রাইভেট কলেজ,তাই প্রতি ৩ মাস পর পর পর্ব পরীক্ষা হতো আমাদের। প্রতি মাসে মাসিক পরীক্ষা আর প্রতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতে দিতে বেহাল দশা।
একবার আমার একাউন্টিং পরীক্ষার দিন তুহিনের খুব জ্বর হলো,আমি সে রাতে একটা অংক ও দেখি নি,করিও নি।তুহিন সারারাত ঘুমায় নি,আমিও না।সারারাত ও আমার সাথে চ্যাটিং করে কাটিয়েছে। সকালে কলেজে আসার সময় তুহিন বলে দিছলো আজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসিছ,একটা জরুরি কথা বলবো তোকে,আজ না বল্লে হবেই না।আমি অনেক জিজ্ঞেস করার পরেও তখন বললো না। সেদিন পরীক্ষা আমার খুব খারাপ হলো,১০০ মার্কসের মধ্যে আমি উওর দিছিলাম ৭০,তাও শিউর ছিলাম না ৭০ এ ৫০ পাবো কিনা।কিন্তু সেদিন পরীক্ষা ঠিকঠাক না দিয়েই ১ ঘন্টা আগেই বের হয়ে আসি হল থেকে। স্যারকে যখন আমি খাতা দিতে গেছিলাম স্যার তখন আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে ছিলো। তারপর বললো,ছন্দা তোমার কি শরীর খারাপ??
আমিঃ না তো স্যার।
স্যারঃ আজ সময় শেষ না হতেই যে খাতা জমা দিয়ে দিলে,তুমি তো সময় শেষ হবার পরেও বলতে যে স্যার আর একটু লিখি,আপনি পিছন থেকে খাতা নিয়ে আসেন।
আমিঃ স্যার আজ আমার একটা স্পেশাল ডে,আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
আর দেরি না করে বাসায় চলে এলাম।এসেই ফেসবুকে। দেখি তুহিন এক্টিভ। আমাকে দেখেই ওর প্রথম টেক্সট ছিলো,কি রে কেমন দিলি এক্সাম??
আমিঃ খুব জঘন্য, বল তুই কি বলবি।
তুহিনঃ জঘন্য মানে কি,ঠিক করে বল।
আমিঃ আমি তো একটা অংক ও প্রাকটিস করে যাই নি,তার উপর তুই বললি কি বলবি,তাই কৌতুহলে এক্সাম খারাপ দিয়ে আসছি।
কথাটা শুনে তুহিন খুব রেগে যায়,ফার্স্ট পজিশন যদি অন্য কেউ নিয়ে নেয় তাইলে আমার সাথে আর কথা বলবে না। এ কথা বলেই অফলাইনে চলে যায়। আমি কতোগুলো টেক্সট দিই,কিন্তু ও আর আসে না। রাতে এসে বলে যে,তুই এক্সাম বাকি গুলো তে যদি ৮০ এর নিছে মার্কস পাস তো দেখবি কি হবে
আমিঃ তুই কি যেনো বলতে চেয়েছিলি??
তুহিনঃ একদিন তোর সাথে দেখা করতে আসবো,সেদিন বলবো এটা বলতাম।
আমিঃ এটাই বলতে চাইছিলি??
তুহিনঃ তো কি বলবো আর নয়তো??
আমিঃ কিছু না,কবে আসবি??
তুহিনঃ তোর এক্সামের পরে।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে ।
তুহিনঃ চন্দ্রাবতী,তোর কি আমাকে একটু দেখতে ও ইচ্ছে করে না,আমি কেমন।
আমিঃ করে তো।কিন্তু তবু আমি দেখবো না,তুই আমার কাছে সারপ্রাইজ হয়ে থাক,যেদিন আসবি আমার সাথে দেখা করতে সেদিন দেখবো।
তারপর অনেক কথা হয়। আমার এক্সাম শেষ হয় যেদিন সেদিন আমরা নানাদের বাড়ি যাই নানাকে দেখতে নানা অসুস্থ ছিলো। ওই বাড়িতে নেটওয়ার্ক খুবই কম ছিলো তাই আমি আর অনলাইনে আসতে পারি নি।তুহিন কে বলতেও পারি নি। ক্লাসে ও যাই নি পরের দিন। তুহিন আমাকে অনলাইনে না পেয়ে কলেজের সামনে যায় সেদিন কিন্তু আমি তো যাই নি ক্লাসে,ওর ফ্রেন্ডদের কে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে যে আমি যাই নি আজ। পরের দিন আমরা বাড়ি আসি,তুহিন কে এসে আমি টেক্সট দিয়ে বলি ও খুব রেগে যায়,বলে যে তুই কেনো আমাকে না বলে গেলি,আমি কতো চিন্তা করেছি তুই জানিস,আমার কতো কষ্ট হয়েছে থাকতে তোর সাথে কথা না বলে।
আমিঃ আর হবে না,সরি
তুহিনঃমনে থাকে যেনো।
২দিন পরে আমার খুব জ্বর হয়,অনলাইনে এসে আমি তুহিনকে একটিভ দেখে টেক্সট দিই,ও সেদিন খুব দেরি করে করে রিপ্লে দেয়,টুকটাক কথার পরে ও আমাকে বলে যে কিরে,তোর কি হইছে।মন খারাপ নাকি।
আমিঃ না জ্বর আসছে।
তুহিনঃ কি বলিস।
আমিঃ তোর এতো টেক্সট দিতে দেরি হয় কেনো আজ??
তুহিনঃ আমি সাইকেলে তো তাই টেক্সট দিতে পারতেছি না।
আমিঃ কই যাস??
তুহিনঃ তোদের এলাকায় আসতেছি তোকে দেখতে। পরে টেক্সট দিই তোরে চন্দ্রাবতী?? (তুহিন আমাকে চন্দ্রাবতী বলে ডাকতো।)
আমিঃনা তুই আমার সাথে চ্যাটিং করতে করতে আসবি,একটু লেট হলে আমি অফলাইনে চলে যাবো,তুই পরে আসলেও আমার সাথে আর দেখা করতে পারবি না।
তুহিনঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
আমিঃ তুই এখন কোথায়??
তুহিনঃ মেইন রোডে। তোর জ্বর কতো ডিগ্রি??
আমিঃ ১০৩ ডিগ্রি ।
কিন্তু তুহিন আর সিন করে না। আমি টেক্সট দিতে থাকি ও সিন করে না। শেষে রেগে অফলাইনে চলে যাই.। কিন্তু ৫ মিনিট ও থাকতে পারি না,আবার অনলাইনে যাই। নিউজফিডে ঘুরাঘুরি করি আর ওর টেক্সটের অপেক্ষা করি। নিউজফিডে ঘুরাঘুরি করতে করতে আমাদের জেলার ফেসবুজ পেজে ঢুকি। তারপরই আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালে দেখি,জানি না কতো সময় পার হয়ে গেছে।জ্ঞান ফিরে শুধু আম্মুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি,আম্মু তুহিন কই,তুহিন কেমন আছে,ওর কি হইছে??
আম্মুঃ তুহিন কে?
আমিঃ আমার তুহিন আম্মু,আমি ওরে ভালোবাসি।
আম্মুঃ তুই কি বলতেছিস এসব,জ্বরে কি মাথা পুরাই এলোমেলো হয়ে গেছে তোর??
আমিঃ তোমার ফোন দাও।
আম্মুর ফোন নিয়ে ফেসবুকে ঢুকেই দেখি,আমার নিউজফিডটা জুড়ে শুধুই তুহিন। আমার তুহিন আর নেই। আমি আমার তুহিনকে মেরে ফেলেছি,আমি ওরে জোর করছিলাম রাস্তায় আমাকে টেক্সট দিতে হবে সাইকেলে থেকে। আমাকে টেক্সট দিতে গিয়েই তুহিন দেখতে পায় নি ও যে রাস্তার মাঝখানে চলে গেছে,সামনে থেকে ট্রাক এসে মেরে দেয় ওরে। সেখানেই আমার তুহিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।
আমি পারি নি আমার তুহিনকে দেখতে।আচ্ছা তুহিন কি আমাকে ভালোবেসেছিল তাও আমার জানা হলো না কোনোদিন। আমার সারপ্রাইজ পাওয়া আর হলো না।আমার সারপ্রাইজ আজীবনের জন্য সারপ্রাইজ রয়ে গেলো। ১ সপ্তাহ পর কলেজে যাওয়ার পরে তুহিনের একটা ফ্রেন্ড আমার সাথে দেখা করতে আসে। তুহিনের একটা ডায়েরি আমাকে দিয়ে যায়। পুরো ডায়েরি জুড়ে শুধু ২টা শব্দ লিখা, “ভালোবাসি চন্দ্রাবতী”