সৈকত চৈতী

সৈকত চৈতী

সৈকত যে মেয়েটির সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, তার নাম চৈতী। সৈকতের ধারণা, ফেসবুক না থাকলে তাদের সম্পর্কের বারোটা বেজে যেত। ঘটনা সত্য। সৈকত ফেসবুকের একাধিক লেখকের ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত। আর চৈতীর ফ্রেন্ডলিস্টে হাজারখানেক লেখক যুক্ত।

সৈকত সারাদিন সম্পর্ক নিয়ে ফেসবুকের জ্ঞানীগুণী লেখকদের চমৎকার সব ভাবনা চিন্তা, আদেশ নিষেধ পড়ে অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলার চেষ্টা করে। শুকরিয়া আদায় করে সে। সম্পর্কটা টিকে আছে আজ অবধি তাদের। এর একমাত্র কৃতিত্ব নেবে অনেকের মধ্যে বিশেষ করে ক্ষুদে লেখক, ভেটকা লেখক, ছটকু লেখক এবং বাইঞ্চো লেখক। এরা না থাকলে গত বৎসরের তেইশে সেপ্টেম্বর রাত আড়াইটায় তাদের ব্রেকাপ হয়ে যেত। সৈকতের সেদিন প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল। গুডনাইট বলে ঘুমিয়ে যাচ্ছি বলার পর প্রায় দুইঘন্টা ধরেও চৈতী অনলাইনে বসে ছিল। সৈকত যখন জিজ্ঞেস করলো,

– কি হয়েছে? চৈতী তখন বললো,
– গল্প পড়ছি আমি। এই দেখো স্ক্রীনশট।

সৈকত স্ক্রীনশটের কোনার মেসেঞ্জার চ্যাটহেডে আশীষের আইডি দেখতে পেল। নিউ মেসেজ সহ। আশীষ চৈতীর ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়। এক ঘন্টা ধরে ওর সাথে চ্যাট করেও চৈতী মিথ্যা বলেছে। সৈকত ভয়ানক রেগে গেল।

ঠিক তখুনি বাইঞ্চো লেখকের একটা লেখা হোমপেইজে ভেসে উঠলো, ‘সন্দেহ কোরোনা। সন্দেহ ভালোবাসা কুরে কুরে খেয়ে ফেলে। মানুষটি কারো সাথে চ্যাট করেছে, এর মানে এই নয় যে তারা সেক্সচ্যাট করেছে। যদি সেক্সচ্যাট করেও থাকে তার মানে এই নয় যে তাদের মধ্যে মানসিক কোনো সম্পর্ক আছে। মানসিক কোনো সম্পর্ক থাকলেও এটা নয় যে তারা একসাথে শুয়েছে। আর শুয়েছে মানে এটাও নয় যে, তাদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়েছে সৈকতের রাগ চট করে চলে গেল। আসলেই তো। ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয়। চৈতীর আইডির পাশে সারারাত সবুজ বাতি জ্বললো, সৈকত আরামসে ঘুমিয়ে পড়লো। সৈকত শুকরিয়া আদায় করলো। ভাগ্যিস লেখাটা সঠিক সময়ে চোখের সামনে পড়েছিলো। এরপর আরো বেশ কয়েকবার তাদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলো এই লেখক মহোদয়রা। সৈকত এখন চৈতীকে একদম সন্দেহ করেনা। সেইদিন চৈতী নিজ থেকেই কেঁদে কেঁদে বললো,

– আশীষ আমায় ব্ল্যাকমেইল করছে, ও কে কিছু ন্যুড পাঠিয়েছিলাম গতরাতে ওগুলো পাবলিক করে দেবে বলছে। আমি কি করবো এখন? সৈকত মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

– ব্যাপার না। আমি সলভ করে দিচ্ছি। এরপর সৈকত আশীষের সাথে কথা বললো। কিছু টাকাপয়সা দিয়ে বিষয়টা এই যাত্রায় চেপে দিলো। এমন একটা ঘটনার পরও সৈকত চৈতীকে জিজ্ঞেস করলোনা,

– তুমি তোমার বন্ধুকে ন্যুড পাঠিয়েছো কেন? তাও আমার সাথে সম্পর্কে থেকে?

কারণ ভেটকা লেখকের একটা লেখা চোখের সামনে ভাসছিলো ওর, ‘ভুল মানুষ করে। ভালোবাসার মানুষের ভুল ক্ষমা করতে হয়। কোনো মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। হয়তো তোমার মনের মানুষ ভুল করে অন্য একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, হয়তো তোমায় অপশন হিসেবে রেখে দেদারসে আর দশটা মানুষের সাথে লাইন ক্লিয়ার করছে তুমি ভুল মনে করে ভুলে যাও। সবকিছু জড়ায়ে রাখলে জীবন চলেনা।’

সৈকত ভুলেই গিয়েছে। এসব মনে রাখলে কি আর সম্পর্ক টিকে থাকে? সৈকত কখনোই চৈতীকে কোনোকিছু নিয়ে জোরজবরদস্তিও করেনা। কারণ ক্ষুদে লেখক লিখেছেন, ‘মনের মানুষকে স্পেইস দাও। আটকে রেখোনা। মানুষের দমবন্ধ করে ফেলোনা। ফ্রিডম দাও। তার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। তুমি তার অংশ হতে যেওনা। সন্দেহ কোরোনা, জেলাস হয়োনা, বিরক্ত হয়োনা, রাগ হয়োনা, অধিকার খাটাইয়োনা সৈকত প্রতিটা শব্দ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে মাথায় রেখে দিয়েছে। চৈতীর সাথে ওইদিনই সৈকতের ব্রেকাপ হয়ে যেত, যেইদিন চৈতী গোসল করে এসে গায়ে শুধু একটা টাওয়েল জড়িয়ে কোলবালিশ বুকে নিয়ে পিক আপলোড করে ক্যাপশন দিলো,

– আমার মতোন আমার কোলবালিশটাও সিঙ্গেল…

তিন বৎসরের সম্পর্কে বর্তমানে থেকেও ‘সিঙ্গেল’ শব্দটি চৈতীর ক্যাপশনে দেখেও সৈকতের একটুও রাগ হলোনা। কারণ ইতিমধ্যেই ছটকু লেখক লিখেছেন, ‘সম্পর্কে স্পেইস বলে একটা কথা আছে। কেউ তোমায় ভালোবাসে মানে সে তোমার কুকুর না। তার ন্যুড ছবি আপ দেয়ার আগে তোমার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। তার ইচ্ছা করলে ন্যুড ভিডিও দেবে, তোমার সাথে তার সম্পর্ক পাবলিকলি অস্বীকার করবে তার একটা ব্যক্তিগত লাইফ আছে। ওখানে তোমার কথা বলার অধিকার নেই, ওখানে তোমার স্পেইস নেই’ সৈকত ওই পিকে লাভ রিয়্যাক্ট দিলো।

বাইঞ্চো লেখকের লেখামতোন সৈকত কখনোই চৈতীর উপর কোনো অধিকার খাটায় না। তাদের মধ্যে তেমন কথা হয়না। এক সপ্তাহে দুই কি তিনদিন। সৈকতের সাথে দেখা করার সময় না হলেও মাঝে মাঝেই চৈতী বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যায়। সৈকত স্পেইস দেয়। বন্ধুদের সাথে অন্তরঙ্গ কিছু ছবি আপ দেয় ফেসবুকে চৈতী। সৈকতের জেলাস ফিল হয়না। সম্পর্কে জেলাস ফিল থাকলেই সমস্যা। সে হাসিমুখে লাভ রিয়্যাক্ট দেয়। সৈকত ভেবে আটকে উঠে, কয়েকমাস আগেই চৈতীর সাথে সম্পর্কটা প্রায় যায় যায়। চৈতী পুরো সপ্তাহ ধরে রাতে একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে দূর সম্পর্কের মামার সাথে। সৈকত অধীর আগ্রহে বসে থাকে কখন কথা শেষ হবে। চৈতী রাত সাড়ে চারটায় কথা শেষ করে সৈকতকে ‘আমি খুব ক্লান্ত, গুডনাইট’ বলে শুয়ে পড়ে। সৈকত জিজ্ঞেস করে,

– কি কথা বলো মামার সাথে এত?

চৈতী আঁতকে উঠে, মানে কি? মামার সাথেও কথা বলা যাবেনা? সৈকত চটজলদি মন শান্ত করার জন্য ফোটকা লেখকের একটা লেখা পড়ে ফেলে। পড়ার পর মনে হয়, আসলেই তো। অত রাতে চৈতী কোন মামার সাথে কথা বলছে, সে কে জিজ্ঞেস করার? বললেই বা কি! ভালোবাসার মানুষকে শ্বাস নিতে দিতে হবে তো। একটা মানুষের সাথে দুই তিন বৎসর কথা বলার পর বোর লাগতেই পারে। অন্য কারো সাথে কথা বলে মনটা ফ্রেশ করতেই পারে। মামা পরিচয়ে ভাস্কো ডা গামার সাথে কথা বললেও সৈকতের কোনো অধিকার নেই কুকুরের মতোন আচরণ করার।
সৈকত হাসিমুখে বললো,

– ঠিক আছে বেইবি, কথা বলো। ফ্লেক্সি লাগলে বোলো।

কি বাঁচাটাই না বাঁচলো সেইদিন। লেখকদের প্রতি সৈকতের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আশীষের প্রতিও সৈকতের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এ নিয়ে চারবার রুমডেট করেছে আশীষ ব্ল্যাকমেইল করে চৈতীকে। চৈতী কিছু না জানালেও আশীষ জানিয়েছে সৈকতকে। সব শুনে সৈকত বিশ্বাস করেনি। এমনকি নোংরা ছবি দেখেও না। ভালোবাসার মানুষকেই যদি বিশ্বাস না করে কেউ, সেটা কোনো সম্পর্ক হলো? আশীষের প্রতি এইজন্য কৃতজ্ঞ সে, কেননা এইসব মিথ্যে বলে বরং সে চৈতীর প্রতি সৈকতের বিশ্বাসের ভিত্তি আরো দৃঢ় করে দিয়েছে। সৈকত আশীষের সাথে রুমডেটের বিষয়টা তখনো বিশ্বাস করেনি যখন চৈতী প্রেগন্যান্ট হলো। একটা মানুষ প্রেগন্যান্ট হতেই পারে, পার্সোনাল বিষয়। সৈকত হাসি মুখে পেটে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– বাচ্চাটা আমার? চৈতী ভেবে পায়না কার বাচ্চা। সৈকতকে বাদ দিয়ে আশীষের হতে পারে, কমলেরও হতে পারে। জুনায়েদ, অনিরুদ্ধকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। চৈতী ভারী রাগ করে বললো,

– তোমার জানতে হবে কেন? একটু স্পেইস দাও আমায়..

আশীষের সাথে কথা বলে সৈকত বুঝলো ওটা আশীষের বাচ্চা হতেই পারেনা। বাচ্চা যদি পেট থেকে বের হয়ে আশীষের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে,

– ওই যে আমার আব্বু..

তাও আশীষ মানবেনা। সৈকত মুশকিলে পড়লো। বাচ্চার তো একটা পরিচয় দরকার। চৈতীকে কিছু জিজ্ঞেস করাও যাবেনা। কেননা ইতিমধ্যেই ফেসবুকের ভেটকা লেখক লিখেছেন, ‘ভালোবাসার মানুষকে সন্দেহ কোরোনা, অলৌকিক প্রেগন্যান্সী নিয়েও না। বাচ্চা নিয়ে তো প্রশ্ন তুলতেই নেই। মানুষের পার্সোনাল বলে একটা বিষয় আছে সৈকত আর প্রশ্ন তুলেনি। হোক বাচ্চা আশীষ কিংবা কমলের। সে তো ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। জানতে হবে কেন তার? যাইহোক, চার বৎসর সৈকতের সাথে প্রেম করার পর গতকাল প্রেগন্যান্ট চৈতী বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছে সৈকতকেই। সৈকত কার্ড খুলে দেখে, বরের নাম আশীষ। বিয়ের স্থান, বাঁধন কমিউনিটি সেন্টার। শুক্রবার জুমআর নামাযের পর। সপরিবারে আমন্ত্রিত।

আশীষকে আশীষেরই ধারণ করা ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অবশেষে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলেছে চৈতী।
সৈকত একটুও মন খারাপ করলোনা। চৈতী বিয়ে করতেই পারে। মানুষের পার্সোনাল লাইফ বলে একটা কথা আছে। তাছাড়া চৈতী আশীষকে বিয়ে করছে মানে এই নয় যে সে সৈকতকে ভালোবাসেনা। চার বৎসরের সম্পর্ক তো মিথ্যে হতে পারেনা। পরদিন সৈকত সেজেগুজে বিয়ে খেয়ে আসলো চৈতীর। চৈতী আর আশীষের সাথে হাসিমুখে ছবিও তুললো। রাতে ফেসবুকে ঢুকে দেখে চৈতী বিয়ের ছবি আপলোড করেছে। সৈকত যে ছবিতে রয়েছে ওই ছবিটার ক্যাপশন হচ্ছে,

– With husband and friends…

সৈকত কখনোই চৈতীকে নিয়ে সন্দেহ করেনি, আজও করলোনা। সে বুঝে ফেললো এখানে হাসবেন্ড বলতে তাকেই ইঙ্গিত করেছে চৈতী। না করলেও থাক, মানুষের পার্সোনাল লাইফ বলে একটা কথা আছে। সৈকত বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অসীম কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠলো তার। শ্রদ্ধেয় বাইঞ্চো লেখকের মহামূল্যবান লেখাগুলির জন্য এইযাত্রায় সম্পর্কটা টিকে গেলো নয়তো এখুনিই ভুল বুঝে ব্রেকাপ হয়ে যেত। ভাগ্যিস।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত