ভোর পাঁচটায় সুরে সুরে সুরে বেজে উঠল মুঠোফোন।
মুনিয়া চোখ বন্ধ রেখেই বালিশের নিচে হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজতে থাকে। অসময়ের ফোন।
হতে পারে কোন দুঃসংবাদ। হতে পারে উপদ্রব। যদিও মুনিয়াকে দেখে মনে হয় না সে কোন খারাপ খবরের আশংকা করছে।
‘জানা আছে’ এমন ভাব নিয়ে সে ফোন চোখের সামনে তুলে ধরে। ফোনটা বেজেই যাচ্ছে সুরেলা অথচ একঘেয়ে স্বরে।
বেজে বেজে নিশ্চুপ হয়ে যায় যন্ত্রটা। ওর ঘুম পুরোপুরি কেটে গেছে ততক্ষণে। তাও সে কলটা ধরে না।
ফোনের অন্যপ্রান্তের মানুষ যদি ধরে নেয় সে ঘুমাচ্ছে, ফোনের শব্দ শুনতে পায় নি, তাহলে হয়ত এবেলায় মাফ পাওয়া যাবে।
খানিক পরেই অনবরত কল আসতে থাকে, মেসেঞ্জার, ভাইবার, ওয়াটসএ্যাপ, লাইন এবং স্কাইপে। সেই সাথে ম্যাসেজ।
“কলটা ধরো, প্লিজ”
“দশ মিনিটের জন্য শুধু”
“আমি অপেক্ষা করছি”
“মুনিয়া”
গোটাদশেক মিসড কলের পর সে কল ধরে। নিমিষেই বদলে যায় তার কণ্ঠ।
ঘুম চটে যাওয়া স্বর নয় বরং জোর করে নিয়ে আসে রাজ্যের ক্লান্তি, ঘুম, নিরাসক্ততা।
মৃদুস্বরে বলে- বলো।
খরখরে সর্দি মাখানো জড়ানো স্বরে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সে বলে,
– কতক্ষণ ধরে কল করে যাচ্ছি। কতদিন না বলেছি তোমাকে ফোন শুধু ভাইব্রেশন মোডে রাখবে না। অল্প করে রিং টোন দিয়ে রাখবে?
– রিং টোন দেওয়া ছিল। কাল রাতে ঠাণ্ডার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছি। জানোই তো এসব ওষুধে ঘুম পায় খুব। সে জন্য টের পাই নি।
– একটু স্কাইপে আসো।
– এখন সম্ভব না। ঘরে ল্যাপটপ নেই। ফোনে স্কাইপ হ্যাং করে।
– তাহলে মেসেঞ্জারের ভিডিও কলে?
– আম্মা নামাজ পড়ার জন্য জাগবেন একটু পরেই। ঘরে আলো জ্বালাতে দেখলেই সন্দেহ করবেন। তাই আলো জ্বালাতে পারব না।
ভিডিও তে দেখতে পাবে না কিছুই। এরচেয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করো।
– আচ্ছা, তাহলে ফোনেই। না, না। আজকে বেশি কিছু করব না। এই ধরো আট থেকে দশ মিনিট।
– আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
– আরে সর্দি লেগেছে আমার আর ওষুধ খাবার পরেও ঘ্যান ঘ্যান করছ তুমি? দশটা মিনিট আমার সাথে কথা তো বলতেই পার নাকি?
তুমি তো জানোই আমি ভালোমানুষ। মদ খাই না, সিগারেট খাই না, মাগিবাজি করি না। কোন বদঅভ্যাস নেই। শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
এত কিছুর বিনিময়ে আমার সাথে একটু কথা বলতে পারবে না তুমি?
মুনিয়া চুপ করে থাকে।
– কী হল? নিজেকে মহা সুন্দরী ভাবো? মনে আছে আগের সম্পর্কে কেমন বাঁশটা খেয়েছিলে ওই লোকের কাছে?
আমি তো সেখানে বলতে গেলে কিছুই না। কণ্ঠস্বরটা ফুঁসে উঠে যেন।
– মাফ করো আমাকে। ফোন রাখছি। ঠাণ্ডাভাবে বলে মুনিয়া।
নিমিষেই বদলে যায় স্বর। গলে যাওয়া বরফের মত আকুতি মিনতি শুরু হয় অনবরত।
ভোরের আবছা অন্ধকারে দক্ষিণের জানালায় ক্ষীণ আলোর রেশ দেখা যায়। যেন ঘরের মাঝে আলো আঁধারির খেলা।
মাথার উপর বাঁই বাঁই করে ঘুরছে তিন ডানার পাখা। মুনিয়া চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকে।
ওপাশের মানুষটা মৌনতাকেই সম্মতি ভেবে মন্ত্রোচ্চারণের মত কথা বলতে শুরু করে।
প্রথমে সে কথা বলে জোরে জোরে, তারপর গলা নামায়।
কখনও মধ্যম স্বরে, কখনওবা নিচু স্বরে কণ্ঠের ওঠানামা চলতে থাকে।
মুনিয়া বিছানায় শুয়ে শুয়েই টের পায় খাবার ঘরের বাতি জ্বলেছে। খুটখাট শব্দ হচ্ছে।
একটু পর আম্মা টয়লেটে যাবেন। অযু করবেন। নামাজ পড়ে সকাল সকাল কোরআন শরিফ পড়তে বসবেন। আব্বা উঠবেন সাড়ে ছয়টায়।
তারপর গোসল করে, টিভিতে খবর দেখতে দেখতে নাশতা করবেন। ঠিক আটটায় অফিসের জন্য বের হয়ে যাবেন।
আজ বিকেলে আম্মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে জলদি আসতে হবে আব্বার।
তাঁর কি সেটা মনে আছে?
– মুনিয়া, মুনিয়া। ফোনের ওপাশ থেকে জড়ানো কণ্ঠ ভেসে আসে।
– হু।
– কথা শুনতে পাচ্ছ?
– পাচ্ছি।
– দু একটা সেলফি পাঠাবে নাকি? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
– বললাম তো, ঘর অন্ধকার। আলো জ্বালাতে পারব না। ছবি কীভাবে দেব?
– সব সময়ই ছবি চাইলে কোন না কোন বাহানা তোমার দেখানো চাই। আচ্ছা, তাহলে এক কাজ করো।
কী পোশাক পড়ে আছ সেটার বর্ণনা দাও। একদম খুঁটিনাটি করে বর্নণা।
– তুমি তো জানোই আমি কেমন পোশাক পরি। আগেও বলেছি এভাবে বলতে পারি না আমি।
– উফফ। তোমাকে আসলেই আমার অনেক শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। কিছুই করতে চাও না তুমি।
যে পোশাক পরে আছ তাই বলো। আর ঘর যেহেতু অন্ধকার তাহলে অসুবিধা কী। পোশাকগুলো আমার সাথে কথা বলতে বলতে খুলে নাও।
আমি তোমাকে ফোনে আদর করছি। এমন করো। সূতোহীন হও। দেখবে ভালো লাগছে।
– এটা করতে পারব না। ভোর হতে চলেছে। একটু পরেই ঘরে আলো ফুটবে। আম্মা জেগে থাকবেন।
হুট করে যদি ঘরে চলে আসেন? তোমাকে তো বলেছিলাম এই ঘরের ছিটকিনিটা নষ্ট।
– ডিসগাস্টিং! কিছুই যখন করতে পারবে না, তাহলে কিছু অন্তত বলো আমার জন্য।
যে কোন কিছু বলতে পারো। কিংবা আমার নাম ধরে ডাকতে পারো।
– পারছি না। হয় না আমাকে দিয়ে। আজকের মত বাদ দেওয়া যায় না? ঘুমাতে চেষ্টা করো প্লিজ।
– আহহা! নিজেকে শান্ত না করতে পারলে তো ঘুম আসবে না আমার। সোনামণি একটু চেষ্টা করো। ডাকো।
নাম ধরে ডাকো। আস্তে, আস্তে। ধীরে, ধীরে। আবেগ দিয়ে।
মুনিয়া ঢোঁক গিলল। সময় নিল। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস গোপন করে বিষণ্ণভাবে বলল, জাহেদ। জাহেদ…
– এত ব্যাকডেটেড কেন তুমি? সিনেমা দেখ না নাকি? উফ। বন্ধু বান্ধবও নেই যে কিছু শিখাবে। সুন্দর করে ডাকো।
কণ্ঠ বদলাও মেয়ে। কণ্ঠ বদলাও। আমার মত করে ডাকো। মু… নি…য়া। তুমি বলো এখন। গলা ভেজাও। বলো, জা…হে…দ…
সে প্রাণপণে নিজের ভেতরের বিস্ফোরণ ঢাকার চেষ্টা করতে করতে বলে,
– জা…হে…দ…
– আরেকটু চেষ্টা করো সোনা আমার। পাখি আমার। আরও কিছু বলো। কণ্ঠ বদলাতে না পারলে ফিসফিস করে বলো।
জানাও, আমাকে তুমি কত ভালোবাসো। বুঝাও, আমি কত আপন তোমার। তোমার ডিভোর্সের পরও তুমি কিন্তু আমার কাছে নতুন।
আমি তোমাকে চাই। তোমার আব্বা-আম্মাও আমাকে খুব পছন্দ করেন। অল্প দিনে আমাদের বিয়ে হবে। তুমি কত ভাগ্যবতী।
আমাকে পেয়ে কত খুশি হবে, কী কী করবে বলো। প্লিজ।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি জাহেদ। আর আমি তোমাকে…
– উফ! হচ্ছে না। এত বোরিং কেন তুমি?
দেখো এভাবেই যদি আমাকে নিরাশ করতে থাকো, সাহায্য না করো তাহলে দশ মিনিটের ফোন কল ঘণ্টায় পরিণত হবে।
তুমি কি তা চাও? আমারও কাল অফিস আছে। একটু শান্ত করো আমাকে। নইলে ফোন রাখতে পারব না।
কণ্ঠ তো নয় যেন আদেশ। মুনিয়ার গা গুলায়। মাথা ঝিমঝিম করে উঠে। কথাগুলো শুনে মনের মধ্যে দানবীয় আঘাত কাজ করতে থাকে।
আর কোন বাহানা কিংবা কৈফিয়ত, কিছু দিতে ইচ্ছে করে না তার। বালিশে মুখ গুঁজে সে মুঠোফোনটা পাশে রাখে।
স্বর্ণলতার মত অসহায়ত্ব যেন শরীরের প্রতিটি কোষ বেয়ে উঠে যায়। বালিশের কোণ বালিভেজা সমুদ্রের মত ভিজতে থাকে একটু একটু করে।
তোতা পাখির মুখস্থ বুলির মত বলে,
– আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি জাহেদ। আমার সবকিছুই তোমার।
তুমি যা যা আমাকে বলতে বলবে আমি তাই বলব। যা করতে বলবে তাই করব।
– এই তো! হচ্ছে এখন হচ্ছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি শিখিয়ে দেব। বলো, জাহেদ তুমি আমাকে শরীর খুঁড়ে ফেলো।
বলো, তোমার মত আমাকে কেউ আদর করতে পারবে না।
মুনিয়া বাধ্য ছাত্রীর মত সব কথা বলতে থাকে। আর অন্যদিকে চিরচেনা আট বাই দশ ফুটের ঘর তার অচেনা লাগতে থাকে।
এই বিছানা, এই পড়ার টেবিল, জানালার সবুজ পর্দা, আলমিরার পাশের লম্বা আয়নাটা সব কিছু কেমন যেন জীবন্ত মনে হয়।
নিঃশব্দে তার কোন কিছুর মধ্যে লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সমস্ত যন্ত্রণাকে ম্যাচবক্সে পুরে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
রান্নাঘর থেকে কাপ পিরিচের টুং টাং শব্দ হয়। মুনিয়ার ভেতর থেকে কে যেন ডেকে ওঠে, আম্মা। আম্মা আমার…
একটু পরেই জানালার বাইরের নারিকেল গাছের পাতাগুলো সকালের ওমভরা রোদে চকচক করতে শুরু করবে।
পাখিরা গান গাইবে গুনগুন করে। কার্নিশে সন্তর্পণে হেঁটে বেড়াবে বিগহেড নামের বিশাল কালো হুলো বিড়ালটা।
সবজি বিক্রির গাড়ি চলে আসবে সুর করে ডাকতে ডাকতে। এত চেনা অচেনা পরিবেশে মুনিয়ার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে খুব।
সবকিছু ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে সে শেখানো বুলি বলতে থাকে ভেজা কণ্ঠে।
ফোনের ওপাশের মানুষটা এখন থেকে থেকে হাঁপাচ্ছে। ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। ঘসঘস শব্দ হচ্ছে একটু পর পর।
এটাই জীবন। কয়েক বছর আগে যখন সে আরেকজনের সাথে সংসার করত সেটাও জীবন ছিল।
প্রতিরাতে শিকারির মত বস্ত্র উন্মোচন করে সে যখন অর্ধমৃত হরিণীর মত মুনিয়ার দেহটুকু ক্ষতবিক্ষত করে বিছানায় আছড়ে ফেলত সেটাও ছিল জীবনেরই অংশ।
সারাদিন দুই রুমের একটা বাসায় বন্দী থাকা আর ঘড়ির টিকটিকের সাথে পাল্লা দিয়ে বিড়ালছানার মত ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকা মানুষটা মুনিয়াই ছিল।
এমনকি প্রতিবার মারধোর করে, শরীরটাকে বিপর্যস্ত করে সে নরম স্বরে ক্ষমা চাইত। গায়ে, পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। শান্ত সুরে কথা বলত।
আর জিজ্ঞেস করত, “বেশি কষ্ট দিয়েছি তোকে বউ? অনেক ব্যাথা পেয়েছিস? তাহলে মার আমাকে, মার। মেরে আমাকে শাস্তি দে। মার।”
মুনিয়া পুরানো গলিত মৃতদেহের মত অনড় পরে থাকত। সে জানত এই কোমলভাব ক্ষণিকের।
সে কিছু বলতে গেলেই আবার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সেই শিকারি।
সারা দিনের ক্লান্তি, পরাজয়, বিরক্তি , সন্দেহ, অসুস্থতা ঝেড়ে ফেলার একটা জীবন্ত ট্র্যাশ বাক্স সে। তার বলার কোন অধিকার নেই।
আর পদাবনত, বশ্য বানাতে পারলে কে সেই সুযোগ ছাড়ে? তবে সব দৃশ্যেরই সমাপ্তি থাকে।
তাই তো এক মধ্যরাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে ঠোঁট দিয়ে ঝরঝর করে ঝরতে থাকা রক্তের রেখা নিয়ে এ বাড়িতে পালিয়ে আসতে পেরেছিল সে।
– মুনিয়া… মুন… ইয়া…
– হুঁ!
– আর কিছুক্ষণ কথা বলব। কিছুক্ষণ। বুঝোই তো… শত শত চুম্বনের শব্দ ভেসে আসতে থাকে ওপাশ থেকে।
মুনিয়ার মনে হয় কাদাজলে অনেকগুলো শুয়োর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করছে।
আগের জীবন থেকে পালিয়ে এসে সে নির্ভার হয়েছিল। অল্প কিছুদিন প্রাণভরে শ্বাস নিয়েছিল।
কিন্তু ডেইলি সোপগুলোতে যেভাবে হুট করেই কোন পর্বে অভিনেতা বদলে যায় ঠিক সেভাবেই যেন ওর জীবনে নতুন মানুষের পদার্পণ ঘটল।
শহরের স্বনামধন্য ব্যাংকের কর্মকর্তা, শিক্ষিত , সুদর্শন প্রতিবেশী মুনিয়ার প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে পড়ল।
আব্বা-আম্মা যেন এই খবর জেনে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহটিকে হাতের মুঠোয় পেলেন।
বসন্তের আগমনী সুরের মত আনন্দ বইতে শুরু করল এই পুরানো বাসায়। শহরের সেরা ভালোমানুষটি মুনিয়াকে চায়।
আর তাদের আর কে পায়? আর বিবাহের কথা পাকা হবার পর যেন ভালোমানুষটি আরও রূপ দেখাতে থাকে।
মানুষ এত দ্রুত রূপ বদলায়, যে গিরগিটিও দেখলে হয়ত লজ্জায় প্রাণ জলাঞ্জলি দিবে।
অল্প কিছুদিন পরই যা ধর্মীয়ভাবে, সামাজিকভাবে পাওয়া যাবে সেটিকে আগে পাওয়ার কী প্রাণান্ত চেষ্টা।
আকুলি-বিকুলি, আদেশ-নির্দেশ দিয়ে যেভাবেই হোক তৃপ্ত পাওয়া চাই। বাস্তবে আগে না পেলেও কল্পনায় তা পাওয়া চাই।
আর সেই কল্পনার রসদ যোগাতে মুনিয়ারও থাকা চাই। এরা কখনও মানুষ কখনও পুরুষ কখনও বা চরম অমানুষ।
জীবনের এত রঙবদল আর ভালো লাগে না।
ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে গা ঘিনঘিন করা কথাগুলো অনবরত এসেই যাচ্ছে। মুনিয়া ডান হাতের তালু দিয়ে এবার চোখ ঢেকে রাখে।
সবুজ পর্দার পেছনে কমলা আলোতে ছেয়ে যাচ্ছে জানালার অংশবিশেষ। সেই আলো দেখতে দেখতে ভেতরটা কিছুটা হালকা হতে থাকে যেন।
একটু একটু করে ঘরটা আলোকিত হচ্ছে। কিন্তু তবুও এত অন্ধকার চারিদিকে।
ক্ষানিক পরেই জানালার পাশে ছোট্ট করে লাফ দিয়ে আসবে আদরের ‘বিগহেড’। কালো লোমশ গা ঘষে দিবে তার গায়ে।
মায়ার সুরে ডাকবে। মূক প্রাণী কী সহজেই বোঝাতে পারে ভালোবাসার কথা। মানুষ যদি পারত এমন!
মাসকয়েক আগে কে বা কারা নিয়ে গিয়েছিল বিগহেডকে। মুনিয়া তো ধরে নিয়েছিল মারা গিয়েছে ও। তারপর গত সপ্তাহে আবার ফিরে এলো।
সবই আছে আগের মত, শুধু একটা চোখ নেই। সেই চোখের অন্ধকার কোটরের জখম এখনও বেশ তাজা।
ও যখন বিগহেডকে জড়িয়ে ধরে টপটপ করে চোখ থেকে অশ্রু ঝরাচ্ছিল, বিড়ালটা তখন চুপ করে বসেছিল।
যেন খুব বুঝতে পারছে তার জখম অন্য কাউকে কত বেদনাতুর করে তুলেছে।
অথচ মুনিয়া যখন সেই রাতে পালিয়ে এসেছিল ওকে কেউ এক বিন্দু স্পর্শ করেও দেখে নি। কারণ ওর এ বাসায় ফিরে আসাটা ছিল অস্বস্তির।
জটিলতার। আনন্দ কিংবা আবেগের নয়। আসলে সময় পরিবর্তনে অনেক কিছুই নতুন রূপ নিতে পারে বইয়ের পাতাবদলের মত।
শুধু ভরা দুপুরের আলোর নাচনের মত নাচতে থাকে কষ্টগুলো। আয়নায় ভেসে উঠে অবয়ব। দেহ। অথচ কিছুই নেই সেখানে।
মরে গেছে বহু আগেই।
– মুনিয়া… এ্যাই মুনিয়া। মু… নি… য়া… মুন আমার। মুনিয়া সোনা। আর কিছুক্ষণ থাকব।
আহ… দশ থেকে এক পর্যন্ত গুনো তো তুমি। কী হল? গুনো!
গলার ভেতর একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ চেয়ার পেতে বসে আছে। ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে সেটাকে ঠেলে বের করে দেয়।
কিন্তু কিছুই করে না শেষে। শুধু গণনার কথা শুনে তার মনে হতে থাকে অনন্তকাল থেকে থেমে থাকা একটা দগদগে সময় শেষ হতে চলেছে।
অদেখা এক গোপন বাগানে ঝরছে ফুল। প্রাণপণে ভোরের বাতাসটায় নাক ডুবিয়ে রাখতে চায় ও।
তারপর মনের রাফখাতা জুড়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে ফ্যাসফেসে কণ্ঠে বলে ওঠে…
– দশ
মুনিয়া, সুন্দর কোন স্মৃতি নিয়ে ভাবো। ভেবে দেখো একবার নানুবাড়িতে তুমি ঘুড়ি উড়িয়েছিলে।
নীলসাদা আকাশে স্বগর্বে উড়েছিল তোমার লাল রঙা ঘুড়ি।
– নয়
ভেবে দেখো, রৌদ্রোজ্জ্বল এক দুপুরে লেইসফিতাওয়ালা দিয়ে গিয়েছিল তোমাকে গোলাপি রঙের ক্লিপ। বিনময়ে সে কোন টাকা নেয় নি।
– আট
সপ্তম শ্রেণিতে তুমি একবার পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলে। তারপর উপহার হিসেবে পেয়েছিলে একটি মেডেল আর তিনটি রাশান অনুবাদের বই।
– সাত
তোমাদের পুরানো বাড়ির উঠানজুড়ে ভোরবেলা পরে থাকত একরাশ শিউলিফুল। তুমি তা দিয়ে মালা গাঁথতে।
একটু বেলা বাড়লেই বাড়ির পেছনের বস্তি থেকে ছেলেমেয়েরা ছুটে আসত সেই মালা নেওয়ার জন্য।
– ছয়
আব্বার হাত ধরে মেলায় গিয়েছিলে তুমি। লাল ফ্রক পরে। সেদিন তুমি যা যা চেয়েছিলে আব্বা তাই তাই কিনে দিয়েছিলেন।
– পাঁচ
তোমাকে আর সেই ৩২/৫ মিরপুরের অন্ধকার বাসাটায় ফিরে যেতে হবে না। মনখারাপের মেঘসন্ধ্যার আকাশ এখন ঝকঝকে।
– চার
আর কেউ মধ্যরাতে ঘুঁষি মেরে মেঝেতে ফেলে দিবে না তোমাকে। নোংরা স্পর্শে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে না তোমার শরীরী আঘাতগুলো, অঙ্গগুলো।
– তিন
আসো, এভাবে উলটা করে বাদুরঝোলা না ঝুলে জীবনটা সোজা করে দেখতে শিখি।
– দুই
মুনিয়া! এবার তুমি পালাও। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে অন্য এক রোদের শহর।
– এক
মুনিয়া, মুনিয়া
এবার নতুন করে সাজাও
তোমার দুনিয়া।
গণনা শেষ হওয়া মাত্রই ওপাশ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ আসতে থাকে।
একটানা আর্তনাদের মত শব্দ শুরু হয়ে তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। এক সময় কেটে যায় ফোনের লাইনটা।
মিনিট পাঁচেক পর মুঠোফোনে ম্যাসেজ আসে।
‘আই লাভ ইউ জান। শুভ সকাল। এত সকালে জাগালাম বলে রাগ করো না। জানোই তো আমি মানুষটা ভালো।
মদ খাই না, সিগারেট খাই না, মাগিবাজি করি না। শুধু তোমাকেই…’
মুনিয়ার চোখ জ্বালা করে ওঠে। মুঠোফোনটা খুব দূরে ছুঁড়ে ফেলে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
ততক্ষণে ভোরের পাখিদের সুর চলে গিয়েছে অজানা বাগানের দিকে।
পড়ে থাকা যন্ত্রটা বুঝতে পারে না তার কী অপরাধ ছিল। সে মেঝেতে শুয়ে থাকে অবহেলায়।
পরদিন ঠিক ভোর পাঁচটার অনেকগুলো মিসড কল আসে। আর একটা ম্যাসেজ…
“সারাদিন কোথায় ছিলে? একটু ফোনটা ধরো। আজ শুধু পাঁচ মিনিট চাইব…বেশি না। জানোই তো…
মুনিয়া…
মুনিয়া..