ঘরের সাথের এক চিলতে বারান্দাটায় হাঁটাহাঁটি করে বিকেলটা বেশ ভালই কেটে যায় তন্বীর । মাঝে মাঝে বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ে, কখনো বসে কফি খায়, আবার কখনো শুধুই গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে । সেইসাথে আরেকটা কাজ সে নিয়মিত করে । রাস্তার ওইপাশে যে হালকা নীল রঙের বাড়িটা আছে, সেটার তিনতলায় যে শ্যামলা মতন ছেলেটা থাকে, তাকে খুব মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করে । অবশ্য কাজটা সে করে অত্যন্ত সাবধানে । যেন ছেলেটা কখনো বুঝতে না পারে যে সে ছেলেটাকে দেখে । এবং তন্বী মোটামুটি ভালোরকমের কনফিডেনট, যে সে ছেলেটার কাছে কখনো ধরা পড়েনি !
ছেলেটার নাম সম্ভবত অয়ন । একদিন ওর এক বন্ধু ওকে এই নামে ডাকছিল । তখন তন্বী নামটা শুনেছে । নামটা জানার আগেই অবশ্য তন্বী মনে মনে ছেলেটার একটা নাম দিয়ে রেখেছিল । নামটা ছিল উসি । অয়নের মাথার চুলগুলো সবসময় উসকোখুসকো হয়ে থাকে । এই উসকোখুসকো থেকে উসি নামের উৎপত্তি । উসি নামের এই ছেলেটা যাই করে, তন্বীর কেন যেন তার সবই ভালো লাগে । কখনো ছাঁদে ছোটাছুটি করে ক্রিকেট খেলে, কখনো বারান্দায় বসে গীটার বাজায় । আবার কখনো ইয়া মোটা একটা চশমা এঁটে, বই পড়ে আর নিয়মিত বিরতিতে অভিনব স্টাইলে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মাথা চুলকায় । ইস ! ছেলেটা আসলেই খুব সুইট !
কিন্তু গত সপ্তাহখানেক ধরে খুব অস্বস্তিতে আছে তন্বী । বেশ কয়েকদিন ধরে অয়নের কোন খোঁজ নেই । বারান্দায় আসেনা, ছাঁদে ওঠেনা । এমনকি রাতে ওর ঘরে আলোও জ্বলেনা । খুব অস্থির লাগছে তন্বীর । অনেক চেষ্টা করেও অস্থিরতাটাকে চাপা দিতে পারছেনা ও । আশ্চর্য ! হলো কি ছেলেটার ! কাচের জানালার পেছনে বসে মিটমিট করে দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসছে অয়ন । তাকিয়ে আছে সামনের বাসার বারান্দায়, তন্বী নামের মেয়েটার দিকে । মেয়েটা অস্থিরভাবে এমাথা ওমাথা পায়চারী করছে, আর অয়নের বারান্দার দিকে বারবার তাকাচ্ছে । এখন আর লুকিয়ে তাকানোর সামান্যও চেষ্টা করছেনা সে । যাক ! ফিচলেমি বুদ্ধিটা অবশেষে কাজে লেগেছে ।
যেদিন প্রথম তন্বীকে দেখেছিলো অয়ন, সেদিন থেকেই অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে ওর ভেতরে, মেয়েটার জন্য । কিন্তু কখনো তন্বীর দিকে সরাসরি তাকানোরই সাহস পেতনা ও । আর কথা বলতে যাওয়া তো দুরের কথা ! তাই লুকিয়ে লুকিয়েই ওকে দেখত অয়ন । আর এই লুকিয়ে দেখতে গিয়েই সে আবিস্কার করে বসে যে তন্বীও ঠিক একইভাবে লুকিয়ে ওকে দেখে ! ওকে না দেখতে পেয়ে তন্বীর মাঝে কোন পরিবর্তন আসে কিনা তা দেখার জন্যই ইচ্ছে করে এই কদিন বারান্দায়, ছাদে যায়নি ও । এবং ওর প্ল্যান সাকসেসফুল ।
আজকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সরাসরি তন্বীর দিকে তাকিয়ে আছে অয়ন । মুখে স্নিগ্ধ এক টুকরো হাসি । আরেহ ! এই মেয়ে দেখি লজ্জা পায় ! অয়নের চোখে চোখ পরতেই লজ্জামাখা হাসি ঠোঁটে নিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল তন্বী । অয়নের মুখের হাসিটা আরও চওড়া হলো । যাহ ! প্রেমটা বোধহয় এবার হয়েই গেল ! স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মাথা চুলকালো অয়ন ।
ভাবছে, তারমানে সত্যিই চোখে চোখে প্রেম বলে কোন একটা জিনিস পৃথিবীতে আছে …….
হালের কর্পোরেট ভালোবাসার যুগেও, চোখের অনুভূতি কিংবা ঠোঁটের স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে শুরু হওয়া কত কত অকৃত্রিম পবিত্র ভালবাসা এখনও টিকে আছে !
আছে আমাদের আশেপাশেই । হয়তো বারান্দার গ্রিলের ঠিক ওপাশে, নয়তো ছাদের কোন এক কিনারায় ।