বেলকনিতে বসে বসে বই পড়ছিলাম। আমার বেকার বড় ভাই এসে আমাকে বলল, শিরিন তোর কাছে পাঁচশ টাকা হবে?দুই-এক দিনের মধ্যে দিয়ে দিবো। আমি শুনেও না শোনার ভান ধরলাম।তাকে টাকা ধার দিলেও তা কেউ কোনদিন ফেরত পায়না।মনে মনে বললাম, বেকার কোথাকার,এভাবে ফেরত দিবি দিবি করে কতবার আমার থেকে টাকা ধার নিবি।একটাকাওতো পরিশোধ করিসনা।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভাইয়া টেবিলে থাকা আমার ব্যাগের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল,তখন আমি কথা বললাম,
আর কতকাল এরকম ফকিরের মতো মানুষের কাছ থেকে নিয়ে নিয়ে চলবি।মাস্টার্স পাশ করেছিস সেই দুহাজার আঠারোতে।তোর পরে মাস্টার্স পাশ করা পাশের বাসার আন্টির ছেলে সাবিতও চাকরি পেয়ে গেলো।সবাই চাকরি পায় শুধু তুই ছাড়া।
ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে একটা বেহায়া হাসি দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলল।আমি আগে থেকে ব্যাগ থেকে আমার টাকা সরিয়ে রেখেছি।আজ দুইটা টিউশনি ভাবত সাত হাজার টাকা পেয়েছি সে খবর নিশ্চয় মা ভাইকে দিয়েছে।ভাইয়া টাকা না পেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখিস আমি এবার চাকরিটা পেয়ে যাব।ভাইবা বোর্ডে ডাক পড়েছে আমার।
সরকারি চাকরি পেলে তোদের এই টাকাগুলা সব এক দিনে পরিশোধ করে দিব।এবারের মতো দে বোন।সরকারি স্কুলের আরেকটা শিক্ষক নিবন্ধন নিয়োগ দিয়েছে ওঠাতে এপ্লাই করব। আমি একটু ব্যাঙ্গ করে বললাম,সেই এক বছর ধরে তোর এই এক কথা বারবার শুনে আসছে আমাদের পরিবার,তবু তোর সেদিন আসলনা।একটা চাকরিও হলোনা। পরিবারে তোর মতো এরকম বেকার ভাই থাকা মানে বিপদ।নিজের কাছে নিজের টাকাও তোর কারণে নিজের ভাবতে পারিনা। আমি কামাই করলে সেই টাকা তুই তোর ভাবিস একশ টাকার বদলে সুদে-আসলে দুইশো নিস।তাও দে শূন্য পকেটে আর ভালো লাগছেনা।
–তুই যখন শূণ্য কপাল নিয়ে এসেছিস শূণ্য হয়ে থাকনা। আমার খালামুণি এতোক্ষণ দরজার ভাইরে দাড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনেছিলেন।আমার কথা শেষ হয়নি,উনি ভাইকে আমার সাথে পচানি শুরু করলেন।বললেন,হ্যা রে সেফায়েত তোর লজ্জা থাকা উচিত,নিজেতো একটাকা কামাই করিস না, আবার অন্যজনের টাকাও নিজের মতে করে খরচ করিস। ভাইকে আমি পচাইতে পারি,কিন্তু অন্য কেউ তাঁকে একটু মন্দ কথা বলে আমার মোটেও সহ্য হয়না,সে যে-ই হোক তার সাথে লেগে যায়।খালামুনির সাথেও লেগে গেলাম।
ভাই একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল, তোকে এই জন্যই আমার কলিজার মত লাগে তাই কিছু চাইতে তোর কাছে আসি।তুই ফকির বলিস আর যা-ই বলিস আমার কিন্তু তোর কথা খুব সহজে হজম হয়ে যায়।না দিলে নাই,কি আর করবো।গেলাম আমি,মাফ করে দিস। ভাইয়ের কথাগুলো আমারো কলিজায় লাগে।ওর কষ্টগুলো আমি সেদিন থেকে বুঝি,যেদিন চাকরি না পেয়ে ছাদের রেলিঙের ওপরে লাফ দিতে উঠেছিল আর আমি পিছন থেকে গিয়ে ওর হাত ধরে বলেছিলাম, তোর সাথে আমিও যাবো ভাইয়া।কেন আমাদের রেখে মরতে যাচ্ছিস?
ভাই তখন চমকিয়ে পিছিনে ফিরে বলল,চাকরিটা এবারো হয়নি বোন।অনেক টাকা চাইছে তাঁরা। আমি বললাম,তাই বলে কিছু অসাধু লোকের কারণে তুই আমাদের ছেড়ে যাবি? কি আর করব বল।নিজেকে অনেক বেশি আকাইম্মা লাগে।আসলে বোন বেকারের জীবনটায় অভিশপ্ত।তাঁরা যেদিকে যায় সবাই খালি জানতে চায়,চাকরি কেন করছোনা,নাকি চাকরি পাচ্ছনা।আর আমার বাবাতো পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন,আমাকে অনেক দিয়েছে আর খরচও দিবেনা। ভাইয়ের কষ্ট সেদিন টের পেয়েছিলাম ভীষণ।ও-যে নিজেকে কতোটা বুঝা মনে করেছে।
পরিবারের আর্থিক অবস্থাও তখন তেমন ভালোনা।বাবাও চাকরি থেকে রিটায়ার্ড নিয়ে নিয়েছে,পেনশনের টাকায় ঘর চলছে।হন্য হয়ে টিউশনি খুজেছিলাম বড় ভাইয়ের খরচটা আমি নিজে চালাবো বলে।ওকে শুধু বলেছিলাম,ভাই তুই পড়ে যা।তোর ট্যালেন্টের পাত্তা না দিয়ে যারা অর্থকে পাত্তা দেয়,ওদের কাছে নিজেকে সস্তা হিসেবে প্রকাশ করিসনা।একদিন সময় তোরও আসবে,যারা তোর মেধার কদর বুঝে তোকে কাজ দিবে।তোর দাম অনেক হবে তাদের কাছে।ভাই সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিল। তখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে বিধায় টিউশনি পেতে তেমন কষ্ট হয়নি।টিউশন করে যে টাকা পাই সব ভাইকে দিই।
বছর ধরে এরকম হয়ে আসছে।তবে আমাদের বয়সের ব্যাবধান তিন-চার বছরের হলেও ওঁকে সবসময় তুই বলে ডেকে আসতেছি।আমার ছোটবেলার অভ্যাস ভাইয়ের সাথে ঝগড়াটে কথা না বললে আমার পেটে ভাত হজম হয়না।ভাইয়ার সেই অভ্যাস রয়ে গেছে,ছোট বেলার মতো আমার ঝগড়াটে কথা না শুনলে ওর দিন যায়না।সে ইচ্ছেকৃতভাবে আমার সাথে ঝগড়া করতে আসে।টাকা অলরেডি তার বালিশের নিচে লুকিয়ে রেখে এসেছি জেনেও আমার কথা শুনতে আসে।
কিছুক্ষণ পর ভাইয়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম, তুই ফকিন্নির টাকা আমার লাগবনা।ব্যাংকের ভাইবাটা দিয়ে আসার সময় শামসুর রহমানের কবিতার বইটা আমি আমার বন্ধুর লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসব।দোয়া করিস যেন।
বুঝলাম ভাই টাকাটা পেয়েছে। টাকার সাথে একটা চিরকুট দিয়েছিলাম,শামসুর রহমানের “শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা”বইটা মনে করে নিয়ে আসিস।