– আমি একটু আসছি। (আবির)
– কোথায় যাবি? (আব্বু)
– একটু ছাঁদে যাবো।
– এই সময় হঠাৎ করে? এরকম একটা সময়ে ছাঁদে কেও যায় নাকি? (কিছুটা রাগীস্বরে)
– একটু সময় দরকার। কিছুক্ষনের জন্য একা ছেড়ে দাও।
ছাঁদের রেলিং উপর ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছি। কেমন যেন অসহ্য লাগছে সবকিছু। চোঁখটা বন্ধ করে কিছু সময়, কিছু মহূর্তের আগের সব ঘটনাগুলো চিন্তা করতে লাগলাম। মাত্র পাঁচ মিনিটে জীবনে এতোটা মোড় নিলো কিভাবে? পরিবারের একটা ভুলের জন্য দুইটা জীবন নষ্ট হবে। আমাদের যৌথ পরিবার। দাদা বেঁচে আছে। আব্বু আর বড় কাকা মিলে দাদার ব্যাবসা দেখাশুনা করে দাদার দুই ছেলে মিলে তিনজন নাতি। তার মাঝে আমি দ্বিতীয়। বিপত্তি ঘটেছে বড়টাকে নিয়ে। মানে আমার বড় ভাই।
বড় কাকার ছেলে। বয়সে আমার বছর তিনের বড়। আজকে তার বিয়ে ছিল। মেয়ে মেডিকেল স্টুডেন্ট। দেখতে অনেক সুন্দর। সবথেকে বড় কথা বড় কাকার সবথেকে কাছের বন্ধুর মেয়ে। আর তার সাথেই মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা। সবই ঠিক ছিল তবে মোড় নিয়েছে বড় ভাইয়ের জন্য। বিয়ের ঠিক আগের মহুর্তে তাকে বাসার কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না বললে ভুল হবে। একটা চিরকুটে লিখে গিয়েছে “সে এই মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না। সে অন্য কাওকে ভালোবাসে। আর তাকে কয়েকমাস আগে বিয়েও করেছে। তাকে ধোঁকা দিতে পারবে না”।
সবশেষে সবার মতে আমাকেই বিয়ে করতে হবে তাকে। দুইটা জীবন নষ্ট হওয়ার কথা বললাম কারনটা বেশ সহজ। জ্যাকুলিনকে আমার পছন্দ না। হ্যাঁ সদ্য বিয়ে করা মেয়েটার নাম জ্যাকুলিন। তার নামটা আমার খুব অদ্ভুত লাগে। আমি যে কাওকে পছন্দ করি সেটাও না। মেয়েটা রূপবতী, গুণবতী এমনকি সব দিকে দিয়েই ভালো। তবে তাকে আমি পছন্দ করি না। ওকে আমার সহ্য হয় না। ঘড়ির কাটাতে প্রায় রাত্রি আড়াইটা বাজে। ছাঁদ থেকে নিজে গিয়ে দিখে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পেছন থেকে কারো ডাক শুনলাম।
– আবির? (আব্বু)
– কি? (কিছুটা বিরক্তের সুরে)
– আমি জানি বিয়েটা তোমার অমতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না।
– হুম।
– যদি পারো মেয়েটাকে কষ্ট দিও না।
কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে আসলাম। সদ্য বিয়ে করা বউটা বিছানার একপাশে বসে আছে। হয়তো আমার অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমার এতে বিন্দুপরিমান কোন আগ্রহ নেই। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে কিছুটা নড়ে বসলো।
– দেখ জ্যাকুলিন তোমাকে আমি ছোট থেকেই জানি। তুমি যথেষ্ট পরিমান ভালো মেয়ে। তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমার কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে স্ত্রীর অধিকার দেওয়া সম্ভব না।
– তাহলে বিয়ে করলেন কেন? (ঘোমটা তুলে)
– কেন করেছি সেটা তোমার অজানা নয়।
-(চোঁখের কোনে পানি জমছে বুঝা যাচ্ছে)
– রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।
সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছে না। তবে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।সকালে জ্যাকুলিনের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো।
– এই যে শুনছেন?
– কি?
– সকাল হয়েছে। সবাই আপনার জন্য বসে আছে খাবার টেবিলে।
– যাচ্ছি। তুমি যাও।
কেমন জানি বিরক্ত লাগছে নিজেকে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম। কয়েকদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠান শেষ হলো। জ্যাকুলিনের বাসাতে জামাই আদারটাও ভালোই পেয়েছি। তাতে কি আমি তো তাকে পছন্দ করি না।
বেশ কয়েকমাস পার হয়ে গিয়েছে। মেয়টা আমার ভালোই কেয়ার করে। সবকিছু গুছিয়ে রাখে। কখন কি দরকার তার খেয়াল রাখে। হঠাৎ একদিন রাতে…
– এই ফর্মে আপনার একটা স্বাক্ষর দরকার। (জ্যাকুলিন)
– কিসের ফর্ম এটা? (আবির)
– আপনিই পড়ে নিন।
– আমার স্বাক্ষরের কি দরকার? তোমার আব্বুর স্বাক্ষর নিলেই তো পারো।
– না পারি না। কারন এখানে বিবাহিত উল্লেখ করা আছে। তাই আপনার নাম এখানে লিখেছি। তো আপনার স্বাক্ষর দরকার।
– এটা আবির আহম্মদ হবে। আহমেদ না।
– সরি।
– হুম।
– কোথায় যাচ্ছেন?
– ছাঁদে।
– আমিও যাবো।
– তাহলে যাও। আমি যাবো না।
– ঠিক আছে আপনি যান। আমি যাবো না। শুনুন বাহিরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। গায়ের চাদরটা নিয়ে যান।
ছাঁদে আসলাম চাদর ছাড়াই। আসলেই বেশ ঠান্ডা পড়েছে। শীত শীত করছে। হঠাৎ পেছন থেকে কেও বলে বসলো..
– চাদরটা নিন (জ্যাকুলিন)
– তোমাকে না ছাঁদে আসতে মানা করলাম?
– শুধু চাদরটা দিতে এসেছি। আচ্ছা আমি একটু আপনার পাশে দাড়িয়ে থাকি?
– কেন? তোমাকে না মানা করেছি আমার পাশে ঘুরঘুর করবে না।
– কেন ভয় পান?
– কিসের?
– যদি ভালোবেসে ফেলেন।
– রাগ ধরিয়ে দিও না।
– হুম বুঝি বুঝি। ভালোবাসেন এটা বললেই পারেন।
– মেজাজটাই খারাপ করে দিল। থাক তুই একাই ছাঁদে বসে।
তুই বুঝিস না তোকে আমার সহ্য হয় না? (চড় মেরে) রাগ করেই ছাঁদ থেকে চলে আসলাম। শুয়ে আছি ডিম লাইটের আলোতে। অনেক্ষন হলো কিন্তু এই মেয়ে এখনো আসছে না কেন? নিজের মাঝে ভয় কাজ করতে লাগলো। কোন কিছু হলো নাতো আবার। কিন্তু মনকে বুঝ দিলাম হলেই ভালো। আপদ সরবে। আরো অনেকক্ষণ পার হলো। শুয়ে থেকে এপাশ ওপাশ করছি। নাহ এবার আরেকটা না দিলে হবে না। এতো রাতে ছাঁদে কেন থাকবে। ছাঁদে গিয়ে দেখি জ্যাকুলিন নেই। নিজের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে। মেয়েটা কই গেল। সমস্ত ছাঁদ, রেলিংএর পাশ থেকে নিচের দিকে দেখলাম কিন্তু কোথাও নেই। নিচে নামার সময় দাদার রুম থেকে তার আওয়াজ পেলাম। দরজাটা হালকা খুলে শোনার চেষ্টা করলাম।
– বোনরে দেখ আমার নাতিটা কিন্তু খারাপ না। তিন ভাইয়ের মাঝে এই সবথেকে শান্ত।
– বাদ দাও দাদু এইসব। ওনি আমাকে পছন্দ করে না এতে আমার কোন অভিযোগ নেই।
– কিন্তু আর কতদিন এইভাবে চলবে?
– যতোদিন সে আমাকে ভালোবাসি না বলবে ততোদিন। (হা হা হা)
– না এভাবে আর চলতে দিলে হবে না। আমি আবিরের সাথে কথা বলবো। এর শেষ কোথায় এটা দেখবো।
– না দাদু তুমি এই নিয়ে কোন কথা বলবে না তার সাথে। আর বাসার কাওকে কিছু বলবে না। মা, বড় মা জানলে খুব কষ্ট পাবে।
আর শুনতে ইচ্ছে করলো না। রুমে চলে আসলাম। শুয়ে থেকে চিন্তা করতে লাগলাম, আসলে আমি কাজটা কি ঠিক করছি। শুনেছিলাম বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে যাকে সৃষ্টি করা হয় সেই নাকি বউ হয়। তাহলে জ্যাকুলিনকে কষ্ট দেওয়া কি আমার ঠিক হচ্ছে। আচ্ছা ভালোবাসার চেষ্টা তো করতে পারি। গতমাসে যখন জ্বর হয়েছিল সেই তো সারারাত জেগে আমার সেবা করলো। এতো অবহেলার পরেও যে মেয়েটা আমাকে আগলে রাখে সেই মেয়েকে দূরে ঠেলে দেয়া কি ঠিক হবে। জ্যাকুলিন রুমে এসেছে পরেছে এর মাঝে।
– এতোক্ষন কোথায় ছিলে?
– দাদুর রুমে।
– দাদা অসুস্থ তুমি জানো না? তবুও তাকে জেগে রেখে কথা বলা কি খুব দরকারি ছিল?
– আর হবে না।
– মনে থাকে যেন।
টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বেলে রেখে শুয়ে আছি। কেমন জানি মেয়েটাকে ভালো লাগে বেশ কিছুদিন ধরে। হালকা আলোতে তার মুখের দিকে তাকাতে বেশ বুঝলাম গালের লাল দাগটা তখনকার চড়ের। খুব জোরেই মেরেছিলাম। তার গালে হাত দিতেই সে লাফ দিয়ে ওঠে বসলো।
– কি করেছেন আপনি? (জ্যাকুলিন)
– কিছু না। (আবির)
– তাহলে গালে হাত দিচ্ছেন কেন? গলাটিপে মেরে ফেলার মতলব?
– আরে কি বলো যা তা? আমি কেন তোমার গলাটিপতে যাবো।
– তাহলে?
– সরি। ভুল হয়ে গিয়েছে। আর কখনো হবে না এমন।
মেয়েটা কাঁদছে। নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।
– তোমার পড়া শেষ হতে আর কতদিন লাগবে?
– সামনে পরীক্ষা। তারপর রেজাল্ট দিলেই শেষ। জিজ্ঞেস করছেন হঠাৎ। ডিভোর্স দিবেন? বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠলো কেমন জানি।
– ভালোবাসি।
– কি?
– সারাজীবন ভালোবাসবো। ক্ষমা করতে পারবে এতোদিনের খারাপ ব্যাবহারের জন্য।
মেয়েটা এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছে। তবে এটা সুখের কান্না সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
– আরেকটা কথা। আম্মু আর বড় মা সেদিন নাতি নাতনীর মুখ দেখতে চাইছিল। তো কতদিন লাগতে পারে তাদের আশা পূরণ করতে?
এবার কিছুটা লজ্জা পেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলো। ভালোবাসি মেয়েটাকে। আসলেই ভালোবেসে ফেলেছি।