‘এখানে কি করছ?’
‘বৃষ্টি দেখছি। খুব সুন্দর না?’
মেয়েটার বৃষ্টি খুব পছন্দ। বৃষ্টি নামলেই বেলকনিতে গিয়ে ইজি চেয়ারটায় বসে বৃষ্টি দেখবে।
‘ভিজবে?’
‘এই রাতের বেলায়?’
‘হ্যাঁ, সমস্যা কোথায়?’
‘এই শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর বাঁধবে শরীরে।’
মেয়েটা কোনো কথা বলে না। চুপচাপ বৃষ্টি উপভোগ করছে।
‘দুপুরে খেয়েছিলে?’
‘উহু।’
‘খাওনি কেন?’
‘ঘুমিয়ে ছিলাম।’
‘আমি অফিসে থাকলেই হয়েছে। সবকিছুতে খামখেয়ালি।’ মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘আচ্ছা একটা কথা বলবে ফারাবী?’
‘হু, বলো।’
‘তুমি আমায় ভীষণ ভালোবাসো তাই না?’ আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা হাসি দিলাম।
‘সন্দেহ আছে কোনো?’
‘তা অবশ্য নেই।’
‘তাহলে?’
সে আর কোনো কথা বলল না। খুব জোরে বৃষ্টি নামছে বাইরে। বেলকনি দিয়ে হালকা বৃষ্টি এসে মেয়েটার শরীরে লাগছে। সে মুচকি একটা হাসি দিয়ে আমায় বলল,
‘তোমায় ভিজিয়ে দিই একটু?’
‘ঠান্ডা লাগবে তো।’
‘ঠান্ডা খুব ভয় লাগে বুঝি?’
‘ভীষণ।’
‘আমার জন্যে একটু ভিজতে পারবে না?’ আমি মেয়েটার গালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম।
‘তোমার জন্য আমি সব করতে পারব অর্ন্যা।’ মেয়েটা বেলকনি দিয়ে বাইরে হাত দিয়ে একমুঠো বৃষ্টি এনে আমার শরীরে ছিটিয়ে দিল।
‘রাগ করলে না তো?’
‘রাগ করব কেন?’
‘তুমি তো আবার ঠান্ডা ভয় পাও।’ আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, কেমন ছেলেমানুষী করে এখনও। বয়স তো কম হয়নি।
‘আচ্ছা, একটা কাজ করবে প্লিজ?’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘একটা প্লেটে দু’মুঠো ভাত নিয়ে আসবা?’
‘ভাত দিয়ে কি করবা?’
‘ভাত দিয়ে মানুষ কি করে?’ আমি বুঝতে পারলাম সে এখন খাবে। দুপুরে খায়নি কিছুই। ক্ষুধা লেগেছে হয়তো।
‘একটা প্লেটে আমি আর তুমি খাব।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শুনো..!’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘তুমি কিন্তু আমায় খাইয়ে দিবে।’
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। তারপর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলাম। তারপর রান্নাঘরে চলে গেলাম খাবার নিয়ে আসার জন্য।
‘দেখি হা করো।’ মেয়েটা ছোট্ট করে হা করল।
‘আর একটু বড় হা করো।’
‘আই ছেলে, আমি কি রাক্ষস হ্যাঁ?’
‘আরে না না।’
‘তাহলে আর কত বড় হা করব?’ মেয়েটার ধমক শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। মেয়ে মানুষগুলো জানি কেমন। হুট করেই রাগ করে বসে।
‘এই শুনো…!’
‘কী?’
‘খাওয়া শেষ করে দু’জন মিলে বৃষ্টিতে ভিজব।’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ এক্ষুনি।’
‘আচ্ছা ভিজব।’ কিছুক্ষণ পর খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেল দু’জনের।
‘এই চলো।’
‘কোথায়?’
‘ছাদে।’
‘ছাদে কেন?’
‘মাত্রই না বললে ভিজবে।’
‘ও হ্যাঁ, চলো।’
অতঃপর মেয়েটার মন রক্ষার্থে তার সাথে ছাদে গেলাম বৃষ্টিতে ভিজতে। দু’ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই শরীরটা কেমন যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠল। বৃষ্টির ফোঁটা দেখে মনে হচ্ছে, একেকটা ফোঁটা কম করে হলেও এক কেজি ওজনের হবেই হবে। ‘কেমন লাগছে ভিজতে?’ আমার কাছে ভীষণ খারাপ লাগছে ভিজতে, কিন্তু অর্ন্যাকে তো বলা যাবে না। ‘হ্যাঁ, বেশ লাগছে তো।’ ‘সত্যি?’ ‘তোমায় মিথ্যা বলতে যাব কেন বলো তো।’ দু’জন মিলে বেশ আয়েশ করে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, হুট করেই কোত্থেকে জানি আম্মু এসে পড়ল। ‘বাবা, এই বৃষ্টির মধ্যে ছাদে ভিজছিস কেন?’ ‘আম্মা, আমি তো একা ভিজছি না। অর্ন্যাও আছে আমার সাথে।’
আম্মা কিছু বলছেন না। চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলের বউয়ের সাথে বৃষ্টিতে ভিজছি তাতে সমস্যা কী! ‘বাবা, নিচে আয়।’ ‘আম্মা, অর্ন্যার ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব।’ আমি অর্ন্যার দিকে তাকালাম আম্মাকে বৃষ্টিতে ভিজার কথা বলার জন্য, কিন্তু সেখানে তাকিয়ে আর অর্ন্যাকে দেখতে পেলাম। ‘অর্ন্যা, অর্ন্যা! কোথায় তুমি?’ ছাদের চারপাশটা তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালাম, কিন্তু কোথাও অর্ন্যাকে দেখতে পেলাম না। ‘আম্মা, অর্ন্যা তো এখানেই ছিল। আমার সাথেই ছিল। আমি ওকে ভাত খাইয়ে দিয়ে ছাদে নিয়ে এসছিলাম। কোথায় গেল মেয়েটা?’ আম্মার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম, আম্মার চোখ দু’টো ছলছল করছে। বাম চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি নিচে ঝরে পরছে। ‘আম্মা, তাহলে কি অর্ন্যা আজকেও না এসে আমায় ধোঁকা দিল?’
আকাশে হঠাৎ করে খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আমি দাঁড়ানো থেকে ছাদে বসে পরলাম। মাথাটা কেমন যেন ধরেছে খুব। হুট করেই আমার সবকিছু মনে পড়ে গেল। অর্ন্যা তো নেই। অর্ন্যা তো আমার মাঝে নেই। সে তো দু’বছর আগেই ক্যান্সারে মারা গেছে। আমাকে না বলেই চলে গেছে ওপারে। আমি কাঁদছি। ছাদে বসে থেকে কাঁদছি। কিন্তু চোখের জলগুলো স্পষ্ট না। বৃষ্টি পানিতে চোখের জলগুলো মিশে একাকার হয়ে গেছে। আমার মন খারাপের সাথে আজকে আকাশেরও ভীষণ মন খারাপ। তাই দু’জনেই কেঁদে চলেছি অবিরাম। এই কান্নার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। গন্তব্যহীন অশ্রু।