টার্ন

টার্ন

একটা সাদা মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমার রুমের ছোট বেলকনি টাতে। মগ টায় সুন্দর করে লালচে বর্ণের তিনটি ওয়ার্ড লিখা। ইটালিক ফর্মে লিখা আছে, ‘I hate you’ । হেহে একচুয়্যালি যে এটা দিয়েছিলো ও আমাকে প্রচন্ড রকমের ভালবাসতো। সে আমার রাগমাখা চেহারাটাকে তার চাইতেও বেশি ভালবেসেছিল। তার পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে এটা আমাকে দেয়া। এটা দেয়ার সময় বলেছিল,

-শুনো ফারাবী এখান হেইট ইউ লিখা আছে।

-(আমি শুনেই রাগে মুখ শক্ত করে ফেলার ভাব)

-হু করো। বেশি করে রাগ করো। তুমি যখন প্রতিবার রাগ করো ওটা দেখতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। এই রাগটাই আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি।

-(এটা শুনে মুহুর্তের মধ্যেই আমার সব রাগ উধাও হয়ে গেছে।)

-আর হ্যা যখনই তুমি এই মগটা হাতে নিবা লিখাটা দেখেই তোমার রাগ উঠবে হেহে। এটা চিন্তা করে আমার তো এখন থেকেই ভাল লাগছে। (হাসতে হাসতে বললো) এবার আমি নিরবতা ভেঙ্গে বললাম,

-তুমি এত ইউনিক কেনো?

-কারণ তুমিও ইউনিক।

-একদম ই না। আমি খুবই সাধারন একজন আমজনতা। এর থেকেও যদি সাধারণ কিছু থাকে তবে সেটা আমি। বুঝছো?

-হ্যা বুঝছি। সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ।

-কেমনে?!

-কারণ এই যে দেখো, অন্য সব মানুষ হাসি দেখে প্রেমে পড়ে। আর আমি তোমার রাগমাখা চেহারার প্রেমে পড়েছি।

-হেহেহে (এবার সব লজিক টজিক ভুলে ফিক করে হেসে দিয়েছি)

হু খুব সুন্দর একটা অতীত এটা। যা কখনো ভুলবার নয়। মনে হতেই ঠোঁটের কোণায় আবার হাসি চলে আসলো। অবশ্য এখন আমি রাগ করে থাকলেও কারো কিছু যায় আসে না। কেউ আর এটা দেখতে আসে না। মেয়েটি যে না ফেরার দেশে চলে গেছে। ফারহা তো আর কখনোই ফিরে আসবে না। ওইদিন উপরওয়ালার প্রতি প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। হয়তো সেই রাগটি দেখেও ওর অনেক ভাল লাগতো। ওই সময়টায় খুব করে চেয়েছিলাম যেন আমাকেও তার কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সেটা আর হয় নি। আমি ঠিকই আছি এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে।

আজ এক বছরের মত হয়ে গেল সে নেই। আমারও টানা দুইটা সেমিস্টার ড্রপ গেল। ভার্সিটি থেকে চিঠি আসছে এটা নিয়ে। যদি আমি আর অ্যাটেন্ড না করি তাহলে আমার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাবে। আব্বু-আম্মু খুব চিল্লা-চিল্লি করলো। আম্মু তো সারাক্ষণ ই কান্নাকাটি করে আমাকে নিয়ে। কান্না করার ই কথা। যে ছেলেটার সিজিপিএ ছিল 3.75 আর আজকে তার এই দশা। খুবই জঘন্য।

নাহ এমনে আর না। এবার নিজের ফ্যামিলির জন্য হলেও অন্তত কিছু করা উচিত। যেই মানুষটা নেই তার কথা এত ভেবে কি ই বা হবে! যেটা আছে সেটাকেই নাহয় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। পরদিন সকালে ভার্সিটিতে গেলাম। সবকিছুই একটু কেমন কেমন জানি লাগছে। একটা অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে ডিন স্যারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তিন বার নক দিলাম। ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো,

-ইয়েস কাম ইন

-(আস্তে আস্তে গেলাম ভিতরে)

-হাও ক্যান আই হেল্প ইউ? (স্যার একটু বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো)

-স্যার, আই হ্যাভ অ্যান অ্যাপ্লিকেশন। উড ইউ প্লিজ চেক ইট আউট?

হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পড়ে নিলো। তারপর সাইন করে আমার হাতে দিতে দিতে বললো,

-রেজাল্ট তো বেশ ভালোই। তাহলে মাঝখানে ড্রপ দিয়েছিলেন কেন?

-একটু সমস্যা ছিল।

-ওহ আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি কি সমস্যা। আপনার চেহারা ই বলে দিচ্ছে। এই বয়সে এরকম অনেক কিছুই ফেস করতে শিখা লাগে। যাইহোক এখন থেকে ঠিকভাবে কন্টিনিউ করেন। বেস্ট অফ লাক। ভদ্রলোক চেহারা দেখে কি বুঝছে কি জানে । যাইহোক আমিও ভদ্রভাবে বললাম,

-জ্বি স্যার। থ্যাংক ইউ।

অ্যাপ্লিকেশন টা নিয়ে যাওয়ার সময় একটা সালাম দিয়ে ওনার রুম থেকে বের হলাম। এরপর রেজিস্টারের রুম থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করে চলে আসলাম। বাসে উঠলাম বাসার উদ্দেশ্যে। সিটে বসে থাকার কিছুক্ষন পর আবারও কেন জানি নিজের উপর খুব বেশি ঘেন্না লাগছে। একটা না থাকা মানুষের জন্য আমি আমার কাছের মানুষগুলোকেও কত কষ্ট দিচ্ছি। নিজের কথা তো বাদ ই দিলাম। যাইহোক আজমপুর নেমে গেলাম। যদিও আমার স্টপেজ ছিল এর পরেরটা। হাউজবিল্ডিং।

সামনের একটা ফুলের দোকানে ঢুকে দশটা টকটকে লাল গোলাপ নেই। আর একটু ভেতরে গিয়ে মার্কেট থেকে আম্মুর জন্য একটা মেরুন কালারের শাড়ি কিনলাম। মেরুন কালার অনেক পছন্দ ওনার। কেনার পর এগুলা আবার সুন্দরভাবে র‌্যাপিং করে নিলাম। এবার সোজা একটা রিকশা নিয়ে চলে আসি বাসায়। দরজার সামনে এসে কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথেই আম্মু দরজা খুলে দিল। খোলা মাত্রই আমি গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম।

-আই অ্যাম সরি। প্লিজ তুমি আমাকে মাফ করে দাও। (কান্না করছি) আম্মুও আর কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

-এই নাও এগুলা তোমার জন্য। অনেক ভালবাসি। (ফুলগুলো আর র‌্যাপিং করা শাড়িটা তার হাতে দিয়ে বললাম)

এগুলা হাতে নিয়ে ওনি আরও বেশি কান্না শুরু করে দিয়েছে। টপ টপ করে চোখের জল ঝড়তেছে। আমিও আর কিছু না বলে ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। অনেক তো কষ্ট পেল আমার জন্য। নাহ আর কষ্ট দিব না এই মানুষটাকে। ওনার কান্নাগুলো বাকি দিনগুলোতে হাসি দিয়ে ফিল আপ করে দিব।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত