তোদের দিয়ে সময়মতো যদি একটা কাজও হয়! বের হয়েছেন তিনজনে, ফেরার নাম নেই আর! ” বাড়ির ভিতর থেকে একটি মেয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়েটার বয়স বেশি না, বড়োজোর ২৪/২৫ হবে, দুই তিন বছরের বাচ্চার মা সে। ” আচ্ছা এভাবে চিল্লাইলে সমাধান হবে, শুধু শুধু চিল্লায়ে পাড়া এক করে লাভ কি? ” এটা আরেকটা মেয়ে, এর বয়স প্রায় ত্রিশ ছুঁইছুঁই, চার বছরের মেয়ে আছে একটা। ” আমার কুট্টু পাখি, আমার পুচকু পাখি, কোথায় গেলো রে!
বাড়ির মাঝে বেশ বড় উঠোন আছে, সেখানে দুইটা বাচ্চা মেয়ের সাথে খেলা করছে দুইজন ছেলে আর একটা মেয়ে, কানামাছি খেলছে ওরা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে একটা ছেলে। আর যে দুজনের গলা প্রথমে শুনতে পেলাম, তারা একবার ঘরে যাচ্ছে, আবার বাইরে এসে পথের দিকে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। বেশ কিছু সময় পর দুপুর বারোটার দিকে, দুইজন পুরুষকে বাজার নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখা যায়, পুরুষ বললাম কারণ তাদের ছেলে বলার বয়স পেরিয়ে গেছে। বাজারের ব্যাগে ছিলো পোলাও চাল, খাসির মাংস, রান্নার মশলাপাতি, মিষ্টি, দই, কোল্ড ড্রিংকস, বাচ্চাদের জন্য চিপস চকলেট, আর বড়দের জন্য ভাজাপোড়া। বেশ ভীতভাবেই দুজনে বাড়িতে ঢুকছে, তাদের সাথে আরেকজন ছিল, সে কি একটা জিনিস আনতে বাজারে থেকে গেছে। কি পাঠকগণ? বাড়ির ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয়ই! ইচ্ছে করছে এ বাড়ির গল্প শুনতে? তো চলুন আমার সাথে………
বাড়ির গেইটের উপরে সুন্দর করে লেখা আছে, ” ইচ্ছেঘুড়ি “। হুম, বাড়ির নাম ইচ্ছেঘুড়ি, তবে এটাতে কেউ সবসময় থাকে না, অবসরে এখানে আসে সময় কাটাতে, কারা আসে? প্রথমে যে মেয়ের গলা শোনা গেছে সে নিশি, আর পরের মেয়েটি শরমি। নিশির মেয়ে রাত্রি, শরমির মেয়ে ঢেউ। উঠোনে যারা ঢেউ, রাত্রির সাথে খেলছে, তারা হচ্ছে সাহেদ, বাপ্পী আর ফারিয়া। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে যে, সে আকবর। পরবর্তীতে যারা বাজার নিয়ে ফিরেছে তারা হচ্ছে ঈশান (শরমির স্বামী) আর শিহাব (নিশির স্বামী)। আর যে মহামানব এখনো বাজারে আছেন উনি তারেক, উনি আসলে কিছু কিনতে নয়, দেরি করে ফেরার জন্য নিশি শরমি যে ঝাড়ি দেবে তা যেন শিহাব আর ঈশানের উপর দিয়ে যায়। বাপ্পী, সাহেদ, এরা নিশির ভাইয়ের মত, তবে শরমির বন্ধু; আকবর দুইজনেরই বন্ধু, ফারিয়া নিশির ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর তারেক দুইজনেরই ভাইয়ের মত। যদিও ওদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো ফেসবুকের মাধ্যমে কিন্তু এখন সেটা বাস্তবিক। তাই সবাই মিলে টাকা জমিয়ে শহরের এই নিরিবিলি স্থানে বানিয়েছে বাংলো বাড়ি, যার নাম ইচ্ছেঘুড়ি।
– এতক্ষণে আসার সময় হলো, রান্না কখন করবো আর খাবে কখন সবাই? (নিশি)
– একটু দেরি হয়ে গেলো আর কি? (শিহাব)
– একটু? গেছো নয়টায় আর এখন বাজে বারোটা, এই একটু? (নিশি)
– বাজারে তো যাও না, বুঝবে কি করে, কি চলে বাজারে? (শিহাব)
– এই শোনো রাত্রির আব্বু, সারা বছর মাসের বাজার অধিকাংশ আমিই করি, আমাকে বাজার চেনাও? (নিশি)
– হয়ে গেলো, যাও দুলাভাইরা একটু বাজার করে এনেছিলো,
এখন এই নিশি ঝগড়া করে রান্নায় আরো দেরি করে ফেলবে! (আস্তে করে বলে বাপ্পি) (ওদিকে ঈশান বাচ্চাদের হাতে চিপস চকলেট দেয়, আর ফারিয়াকে দায়িত্ব দেয় বাকিদের মাঝে ভাজাপোড়া খাবার বিতরণ করতে)
– আহ নিশি, তুমি বুঝতেছো না, ঘুরে ঘুরে তোমাদের লিস্ট মত জিনিস আনতেই দেরি হলো আর কি? (ঈশান)
– ঈশান ভাই, আপনিও কি ওর দল নেবেন? (নিশি)
– আচ্ছা তুই কি এবার রান্না করতে যাবি, নাইলে সত্যিই কিন্তু দেরি হবে! (শরমি)
– হ্যাঁ যাও, যাও, এখন ভাল করে বিরিয়ানি রান্না করো গিয়ে (সাহেদ)
– যত্তসব ফাউল, সব কয়টা আজাইরা। এই শরমি চল। ফারিয়া, তুমি আবার দাঁড়িয়ে থেকো না, এসো আমাদের সাথে। (নিশি)
– আসছি (ফারিয়া)
– পাপ্পা, পাপ্পা, আসো না খেলি। (ঢেউ) (চুপি চুপি দরজা দিয়ে ঢুকছে তারেক)
– সব ঠান্ডা তো? (তারেক)
– আপনি তাইলে ইচ্ছা করেই দেরি করে আসছেন? (বাপ্পী)
– এসব বুঝতে হয় ভাই, বিয়ে করো বুঝবে! (তারেক)
– ও, এই জন্যই তুমি বউকে এখানে আনো না (সাহেদ)
– না না তা হবে কেন? তারেক এমনিই বউ আনে না (আকবর)
– আপনি সারাজীবন বোকাই থাকবেন নাকি ভাই (ঈশান) (সবাই একসাথে হেসে দেয়। অতঃপর বাচ্চাদের সাথে খেলতে থাকে) রান্নাঘরে কাজ করছে তিনজনে,
– পুরুষ মানুষ কি কোনদিন শুধরাবে না? (নিশি)
– শুধরালে তো হয়েই যেতো, আমার জনকে দেখিস না, সেই যে বিদেশ গিয়ে পড়ে আছে। (ফারিয়া)
– তারা আমাদের ভাল রাখার জন্যই কাজ করে, হ্যাঁ হয়তো তার জন্য একটু আধটু ভুল করে। (শরমি)
– হঠাৎ উল্টো গান গাচ্ছিস যে তুই? এই তো বলিস, ঈশান সময় দেয় না, দেরি করে ফেরে, হেন তেন, এখন পক্ষ নিচ্ছিস! (নিশি)
– পক্ষ নিচ্ছি না, বাস্তবতা দেখাচ্ছি। এরা যতই আমাদের কষ্ট দিক, দিন শেষে দেখবি আমাদের ভাল রাখতেই তারা ব্যস্ত। (শরমি)
– কথাটা কিন্তু শরমি মন্দ বলে নি (ফারিয়া)
– নিশি, দেখ তো, আলু পেঁয়াজ মসলা সব ঠিক আছে কি না? (শরমি)
– বাচ্চারা খাবে, ঝাল কম করলে হয় না? (নিশি)
– মাংস কষানো হলে তুলে আলাদা রাখবো, পরে কম ঝাল দিয়ে রান্না করে দিবো। (শরমি)
– আরে বিরিয়ানির মধ্যে দিলে ঝাল এত বেশি হবে না! (ফারিয়া)
– হুম সেটাও হয়। (শরমি)
এভাবে তিনজনে গল্প করতে করতে রান্না করতে লাগলো, ওপাশে ওরা খেলাধুলা আর ছাদ দিয়ে ঘোরাঘুরি আর ছবি তুলতে লাগলো। বাপ্পী আবার টিকটক ভিডিও এক্সপার্ট, সে ঢেউ আর রাত্রির ডান্স ভিডিও টিকটকে দিচ্ছে। আবার এর মধ্যে ছাদে রাখা পানির ড্রামের মধ্যে পড়ে যায় আকবর, আসলে পড়ে যায় নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় কেউ সেটাই প্রশ্ন।
রান্না শেষ করতে প্রায় দুইটা পার হয়ে তিনটা বেজে যায়, খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে সবাইকে ডাক দিয়ে নিশি, শরমি, ফারিয়া ফ্রেশ হয়ে আসে। এরমধ্যে সবাই হাত পা ধুয়ে রেডি, গন্ধেই বলে দিচ্ছে খাবার আজ অমৃত হয়েছে।
খেতে খেতে নানা গল্প আড্ডা চলে ওদের, প্রায় চার মাস পর ওরা এক হয়েছে, চার মাসের যত গল্প জমা সব করছে। তারেকের বউয়ের গল্প, বাপ্পীর বিয়ের পাত্রী দেখা, আকবরের বিয়ে কেন দেরি হচ্ছে, সাহেদের বিয়ের তারিখ ঠিক করার ব্যাপার, ঈশানের অফিসের বদমেজাজী কলিগ, শিহাবের ব্যবসায়ের উঠাপড়া, শরমির অফিসের চাপ, আরো কত গল্প। এভাবে প্রায় দেড় দুইঘন্টা বসে গল্প করে করে ওরা খাবার শেষ করে। শেষ পাতে দই মিষ্টি আরো আধাঘন্টা গল্পের খোরাক। অবশেষে খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে সবাই এক এক গ্লাস কোক নিয়ে ছাদে আড্ডা দিতে দিতে সূর্যাস্ত দেখবে।
বেশ আনন্দঘন দিন গেলো আজ ওদের, আরো দুইদিন কাটাবে এরা এখানে। আবার হয়তো এমন দিন আসবে চার পাঁচ মাস পর। আবার চার পাঁচ মাসের জন্য ইচ্ছেঘুড়ির দরজায় তালা ঝুলবে, এভাবেই চলবে সময়, চলবে বন্ধুত্ব, বাড়বে স্মৃতি, ইচ্ছেঘুড়ির স্মৃতি।