মুক্তি

মুক্তি

মাত্র দু সপ্তাহর নোটিশে বাড়িওয়ালা আমাদেরকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্যে বলে দিলেন।

ব্যাচেলরদের এমনিতেই ঢাকায় কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না।

অনেক কষ্টে যাওবা এই বাসাটা পেয়েছিলাম, সেটাও মাত্র আট মাসের মাথায় ছেড়ে দিতে হবে ভেবেই মাথা গরম হয়ে গেলো।

মোস্তাফিজ ওরফে মোস্তা আর আমি মিলে পরদিন থেকে রীতিমত পাগলের হয়ে বাসা খুঁজতে লাগলাম।

আর এই বাসা খুঁজতে গিয়েই মুক্তির সাথে পরিচয়।

মুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়া ছাত্রী। শান্ত, বিষণ্ণ চোখের কম কথা বলা মানুষ। গলার স্বর মেয়েলী কিন্তু দৃঢ়।

প্রতিবারই ওর সাথে কথা বলতে গেলে মনে হয় নিজের কথাগুলো, ধারণাগুলো ভীষণ পোক্ত করে তারপর মানুষের সাথে কথা বলে সে।

মুক্তির সাথে পরিচয় বাসা খুঁজতে গিয়ে। আমি আর মোস্তা দুজন আলাদা হয়ে বাড়ি ভাড়ার সাইনবোর্ড খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম।

গ্রীষ্মকাল, তপ্ত রোদে পুড়ছিলাম। মাথার উপর কিছু কিছু গাছের কারণে ছায়া ছিল আবার তীব্র রোদও ছিল।

হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্রমেই ভীষণ রকমের তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমার চোখের মণি ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ।

এরমাঝে একটি পুরানো হলদে বাড়ির সামনে ‘বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে’ সাইনবোর্ড দেখে আমি থমকে গেলাম।

ছাইরঙা গেট পেরিয়ে দেখি একতলা ফ্ল্যাটের জানালার কাছে হাতের উপর মুখ রেখে চুপচাপ একটি মেয়ে বসে আছে।

সাতপাঁচ না ভেবেই আমি হড়বড় করে বলেছিলাম- ‘এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন?’

মেয়েটি আমাকে এক নজর দেখেই কোনও কথা না বলে জানালার পাশ থেকে উঠে চলে গিয়েছিলো।

আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তের মত দাঁড়িয়ে থেকে ছাইরঙা গেটে দিয়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

-সে কি? পানি খাবেন না?

রিনরিনে দৃঢ় কন্ঠ শুনে আমি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখেছিলাম বারান্দায় বসা মেয়েটি এক গ্লাস পানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি বহু বছরের তৃষ্ণার্ত পথিকের মত ঢক ঢক করে পানি খেলাম।

ডীপ ফ্রিজের ঠান্ডা পানি তিরতির করে আমার গলার ভেতর দিয়ে নেমে আমার সমস্ত শরীরকে শীতলতায় জুড়িয়ে দিলো।

আমি পানি খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও না ফেলে অস্ফুট কন্ঠে বললাম,

‘আরেক গ্লাস পানি খাবো’।

তারপর তৃতীয় গ্লাস পানি খেলাম।

ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে আসার সময় মেয়েটি আবারও রিনরিনে কন্ঠে বলল,
‘ভাইয়া, এতো গরম পড়েছে, বাইরে বের হবার সময় একটা পানির বোতল সাথে নিয়ে বের হবেন। কেমন?‘

সাধারণ একটা কথা, কিন্তু সে সময় এই কথায় কী খুঁজে পেয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ করেই মেয়েটিকে ভীষণ মমতাময়ী মনে হচ্ছিলো।

শেষ কবে আমাকে কেউ খুব যত্ন নিয়ে, মমতা নিয়ে কিছু বলেছে বলে আমার মনে পরে না।

‘পানির বোতল সাথে নিয়ে বের হবেন। কেমন?‘ এই কথাটার মাঝে কেমন যেন একটা মায়া খুঁজে পেলাম।

কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে, কিছুটা ঘোরের মধ্যেই বলে ফেললাম,
‘কাল বিকেলে আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবেন? আমি পাঁচটার পর চারুমামার ছবির দোকানে আড্ডা দেই’।

আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বলে উঠেছিলো, ‘আচ্ছা। দেখা যাক’।
দেখা যাক কথাটির অর্থ হতে পারে, আমি আসার চেষ্টা করব, বা হ্যাঁ আমি কাল আসব কিংবা আরও কিছু। আমি সঠিক জানি না।

শুধু জানি আমি সেদিন রাতে মেয়েটির বলা শেষ কথাটির কত রকমের অর্থই না খুঁজে বেড়িয়েছিলাম!

*
আমার সাথে মেয়েটির দেখা হয়। আমি মেয়েটির নাম জানতে পারি।

নাম মুক্তি, বাবা ভালোবেসে ডাকেন অপরাজিতা, মা মাঝে মাঝে ডাকেন মৈতালী। নামের অভাব নেই মুক্তির।

আমি মাঝে মাঝে ওকে খোঁচানোর জন্যে বলি,

‘আমরা গরীব ঘরের মানুষ তাই আমাদের একটাই নাম’। এসব ছেলেমানুষি কথা বলে মুক্তিকে ক্ষেপানো যায় না।

মুক্তি শান্ত, ভেবে চিন্তে, থেমে থেমে গুছিয়ে কথা বলা মানুষ।

আমার সস্তা রসিকতা, অহেতুক খোঁচানোর অভ্যাস ও যত্ন করে এড়িয়ে যায় কিংবা বলা যায় যত্ন করে মেনে নেয়।

আমরা পাশিপাশি হাঁটি। মুঠোফোনে অজস্র কথা হয়। ক্ষুদেবার্তায় ভরে ওঠে ইনবক্স।

আসাদগেটের মোড়ে ‘আড্ডা’ নামের একটি ঘরোয়া রেস্তোরাঁ আমাদের আড্ডা দেওয়ার পাকাপাকি স্থান হয়ে যায়।

মাটিতে মাদুর পেতে বসে গল্প করি আমরা। মুক্তি মাঝে মাঝে আমার গল্প শোনার সময় খুব মনোযোগ দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।

আমার ও-কে দেখে তখন কেমন যেন খুকি খুকি মনে হয়।

একদিন মনে হয় এভাবে শুধু আড্ডা দিয়ে, গল্প করে, ঘুরে বেড়িয়ে আর কতদিন?

আমার সাথে একটি মেয়ের এত ঘনিষ্ঠতা, এই সম্পর্কের একটা নাম তো দেওয়া দরকার।

মুক্তি আমাকে পছন্দ করে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমার। আমি অবশ্য দেখতে শুনতে পাত্র হিসেবে মন্দ না।

আর আমাকে অপছন্দ করলে নিশ্চয়ই মুক্তি আমার সাথে এতো মেলামেশা করতো না?
মুক্তিকে নিয়ে পরদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে হাতিরঝিল চলে যাই।

মুক্তিকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলবো ভাবতেই মন উথাল-পাথাল করে! হাতিরঝিলের প্রশস্ত পথ, আমরা একটু একটু করে আগাই।

আকাশে নীল, ধূসর, লালচে রঙের বাহার। দেখলে মনে হয় কৃষ্ণচূড়া ফুল মনে হয় হঠাৎ একদিন নীল আকাশের প্রেমে পড়েছিলো।

নীলে-লালে মিশে থাকা ওদের ভালোবাসা তাই আকাশবন্দী।

ঝিলের পাড়ে ঘাসের উপর বসে কিছুক্ষন চুপ করে থাকি আমি। তারপর কোন রকমের ভনিতা না করে বলি,

‘মুক্তি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার এই ছোট্ট জীবনটা আমি তোমাকে নিয়ে পার করতে চাই। যদি তুমি চাও তো…’

মুক্তির চোখে মুখে বিকেলের রোদের মত কিছুটা বিস্ময় খেলা করে, কিছুটা চঞ্চল রোদ।

তারপর নিজেকে খুব দ্রুত সামলে নিয়ে, নিচু কন্ঠে ও বলে ওঠে,

‘আমিও তোমাকে অনেক পছন্দ করি, অনিক। আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি আমাকে এমন কিছু বলতে পারো।

তবে কী জানো? আমাকে নিয়ে ছোট্ট জীবনে থাকার আগে আমার বিষয়ে কিছু কথা জানতে হবে তোমাকে।‘

‘বলো। আমি আপন কন্ঠে জানতে চাই।‘

মুক্তি তার রিনরিনে কিন্তু স্পষ্ট কন্ঠে জানায়, পিয়াল নামের এক ছেলের সাথে ওর তিন বছরের সম্পর্ক ছিলো।

ভবিষ্যতে একে অন্যকে বিয়ের করবে বলে দুজনের সম্পর্কের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

তবে সময়ের সাথে সাথে কিছুদিন পর পর নানা বিষয় নিয়ে বিবাদ হয়ে থাকে দুজনের।

এর মাঝেই একদিন মুক্তি বুঝতে পেরেছিল সে প্রেগন্যান্ট। পিয়াল সেই সময় মুক্তির পাশে থাকেনি।

এক সহপাঠি ও স্কুলের পুরানো এক বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে বহু ঝড়-ঝঞ্জা পেড়িয়ে তিন মাসের এক অনাগত প্রাণকে হাসপাতালে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছিলো মুক্তি।

পিয়ালের সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিল তখনই। পুরানো সম্পর্ক ফেলে এসেছে বছরখানেক হয়েছে, ভেবেছিল হয়ত নতুন করে আর কখনই কাউকে ভালো লাগবে না।

আমি জীবনে এসে ওর এই ধারণা বদলে ফেলেছি। আমাকে এই কথাগুলো বেশ অনেকবার বলতে গিয়েও বলেনি।

আজ বলছে কারণ এই কথাগুলো না বললে ওর মন শান্তি পেত না।

*
মুক্তিকে সেদিন বেশ যত্ন নিয়ে ওর বাসায় পৌছে দেই আমি। আমার হত-বিহবল মন প্রথমে অনেক কিছুই ঠাহর করতে পারে না।

ঝাপসা লাগে চারপাশ। তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে একটু একটু করে। দপ করে নিভে যায় মনের আনাচে-কানাচে জ্বলজ্বল করা বাতিগুলো।

আকাশ কালো করে ঝড় ওঠে মনের আকাশে। কালবৈশাখি ঝড়। আমি সেই ঝড়ের মাঝে ঘুর্ণির মত ঘুরপাক খেতে থাকি।

ভালোবাসার আনন্দের চেয়ে খুব সম্ভব ভালোবাসার বেদনার তীব্রতা বেশি থাকে।

আমি বুঝতে উঠতে পারি না আমার মনের এই ঝড়ের উৎস কি? মুক্তির বিষণ্ণ চোখ, রিনরিনে স্বর আমার কাছে ক্রমশ ঘোলাটে হতে থাকে।

আমি দেখতে পাই আমার সামনে থেকেই মুক্তি এক ছেলের সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়েছে।

ওর চুল—চোখ—ঠোঁট—চিবুক—কন্ঠনালি সমস্ত দেহে অন্য কারও স্পর্শ। আমি দেখতে পাই ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত।

আমার মাথা দপ দপ করতে থাকে। আর সবকিছুভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে।

আমার ভেতর থেকে দলাপাকানো কষ্ট চিড়ে বের হতে চেষ্টা করতে থাকে। আমি অসহায় বোধ করি। পরাজিত হই।

আমার মনে একই সাথে ভয় জেগে ওঠে। সে ভয় হারানোর নাকি হারিয়ে যাবার তা জানি না!

আমার মনে হয় আমার বুক চেপে ধরেছে কোন অদৃশ্য দানব। আমি আর্তনাদ করে ছুটতে থাকি…

ছুটতে থাকি…

আর ছুটতে থাকি।

*
মুক্তিকে নিয়ে আমি আমার ছোট্ট জীবন কাটানোর স্বপ্নটুকু আর বাস্তব করতে পারি নি।

মুক্তির কাছ থেকে নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে নিয়েছি ক্রমশ।

আমার এই গুটিয়ে যাওয়া মুক্তি আমার আগের করা সব ছেলেমানুষিগুলোর মতই মেনে নিয়েছিল।

আর জানা কথা ওর আত্ন-সম্মানবোধ প্রখর। মাথা নোয়ানো বা ভেঙ্গে পড়ার মত মেয়ে সে নয়।

মুক্তি তেমন কিছুই আর কখনও বলেনি আমাকে। শুধু একদিন ফোন করে কিছুটা শ্লেষ নিয়ে বলেছিল,
‘ভালো থেক। মুক্তি তোমাকে মুক্ত করে দিয়েছে।‘

নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে দাবী করি না আমি। কিংবা আমি হয়ত একজন খারাপ মানুষ। দুর্বল মানুষ।

আধুনিকতার আচ্ছাদনে লুকিয়ে থাকা একজন পেছনের কাতারের মানুষ। গোঁড়া। আমি আর দশটা সাধারণ ছেলের মতই একজন।

সততা, উদারতা যাদের কাছে শব্দমাত্র।

ঐশ্বরিয়ার মত কোন মেয়ের চোখ দেখলে আমার চোখ আটকে যায়, দুটো ব্ল্যাক সিগারেটের ধোঁয়ায় জীবনের মানে খুঁজে বেড়াই।

মন্দকে মন্দ বলি, তবে নিজে ভালো কিছু প্রতিষ্ঠা করার বল পাই না। জটিলতামুক্ত থাকতে চাই।

সিনেমার মত জীবনটা হলে ভালো হয়, বা হয়ত একদিন হুট করে অনেক ধনী হয়ে যেতে পারি, এই স্বপ্ন দেখি।

এর গণ্ডির বাইরে যাওয়া আমার জন্য কষ্টসাধ্য।

পিয়াল নামের ছেলেটি কর্ম, মুক্তির ভ্রুণ হত্যা, মুক্তির চোখের বিষণ্ণতা আমার মনে খারাপ লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়।

এরচেয়ে বেশি কিছু অনুভব করার বা চেষ্টা করার সাহস আমার নেই।

আমি চাই মুক্তির জীবনে অনেক উদার কোন পুরুষ আসুক। সেই পুরুষ তার উদারতা, বিশালতা দিয়ে মুক্তির সব দুঃখ ভুলিয়ে দিক।

আমি হয়ত মুক্তিকে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসিনি অথবা আমি হয়তো ভালোবাসতেই শিখিনি!

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক · ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত