রাত দেড়টার দিকে ছোটভাই একটা ইনবক্সে বললো,
‘এই জীবন রাখতে চাইনা ভাই বললাম,
‘গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া?’
‘নাহ’
‘ব্রেকাপ?’
‘গার্লফ্রেন্ড নাই ভাই’
‘ওহ, আব্বা বকেছে?’
‘নাহ’
‘আম্মা?’
‘নাহ’
‘বন্ধুরা তোমায় ফেলে সাজেক গেছে?’
‘নাহ’
‘কক্সবাজার গেছে?’
‘নাহ, ওরা কেউ কোথাও যায় নাই’
‘ক্রাশের অন্যকারো সাথে প্রেম হয়ে গেছে?’
‘নাহ’
‘বিয়ে হয়ে গেছে?’
‘নাহ, কোনো ক্রাশই নাই ভাই’
‘ওহ, পড়াশুনার টেনশন?’
‘নাহ’
‘রেজাল্ট খারাপ?’
‘নাহ’
‘পয়েন্ট কম?’
‘নাহ, ওসব কিছুনা ভাই’
রাগে আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো। মুখ ফেটে কাজি মারুফ বের হয়ে আসতে চাইলো। কোনোরকমে নিয়ন্ত্রণ করে টাইপ করলাম,
‘সমস্যাটা কি তাহলে?’ ছোটভাই উত্তর দিলো,
‘কোনো সমস্যা নাই ভাই’
‘তাইলে মরতে চাও কেন?’
‘এটাই সমস্যা ভাই।
ত্যক্ত হয়া গেছি একদম। একটাও সমস্যা নাই আমার। আমারে সমস্যায় ফেলেন। মহা সমস্যায়। জীবনডা ভাজা ভাজা করে ফেলে এরকম সমস্যায় ফেলবেন ভাই, আল্লার দোহাই লাগে আমি নিজেও এরকম সমস্যায় জীবনে পড়ি নাই। একটা মানুষ সমস্যায় পড়তে চাচ্ছে, আমাকে ভাবতে হবে কি করে তাকে জটিল সমস্যায় ফেলা যায়। কি অদ্ভুত! সারারাত ঘুম এলোনা আমার।
সকালে অর্পিতা আমার লালচে চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘গাঁজা ধরেছ কবে থেকে?’ আমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘এ কেমন কথা?’ ‘চোখের দিকে তাকাও’ ‘এই তো তাকিয়েছি’ ‘গর্দভ, নিজের চোখের দিকে তাকাও’ আমি গোল গোল চোখে অর্পিতার দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজের চোখের দিকে কি করে তাকাবো! এ কেমন ঝামেলা। অর্পিতার রাগ বাড়ে। ফোন হাতে টকাস করে আমার একটা ছবি তুলে দেখালো, ‘দেখো ছাগল, কেমন লাগছে?’ আমি তব্দা খাই। আসলেই চোখ লাল। মুখ ফসকে বলে বসি, ‘জেগে ছিলাম!’ অর্পিতা ভ্রুঁ কুঁচকে এক মুহূর্তেই কয়েকটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। জেগে থাকার সম্ভাব্য কারণসমূহ,
১. যেহেতু আমার সাথে ফোনে কথা বলোনি সারারাত, সেহেতু তুমি অন্যকারো সাথে বলেছো।
২. অন্য কেউ কে হতে পারে আমি আন্দাজ করছি। বরবটি। (বরবটি আমার বন্ধুর মতোন দেখতে একটা বান্ধবী। নাম, ববিতা। অর্পিতা বরবটি ডাকে। স্বাস্থ্য কম বলেই হয়তো।)
৩. বরবটির সাথে তোমার কঠিন গোপন প্রেম চলছে, যেটা আমি জানিনা।
৪. যেহেতু প্রেম চলছে, সেহেতু শারীরিক সম্পর্কও করে ফেলতে পারো। তুমি একটা লুইচ্চা।
৫. যেহেতু তুমি লুইচ্চা এবং চরিত্রহীন, সম্পর্কটা ইতি টানলাম!
অর্পিতা ঝপাট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি হাত চেপে ধরলাম। ভুলে হাত ফসকে ওড়নায় টান খেলো। অর্পিতা ভয়ানক ফাজিল। একহাতে ওড়না ধরে শরীর বাঁকা করে একটা অসহায় ভঙ্গি নিয়ে চিৎকার করলো, বাঁচাওওও! আমি আপাতত পুলিশ স্টেশনে আছি। ওসি নাকি এসি জানিনা, উনার নাম কাদের। আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। উনার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে এইমাত্র আমি দশটা মেয়ের ওড়না টেনে পাঁচটা মেয়েকে রেইপ করে এসেছি।
বরবটি থানায় এসে পৌঁছলো সন্ধ্যের দিকে।
আমি তখন চৌদ্দ শিকের ভেতর। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম বরবটিকে দেখে। যাক, এই মেয়েটা আমায় উদ্ধার করে নিযে যাবে তালা ভেঙে। এখুনি এসে শিকের ওপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদো স্বরে বলবে, ‘তোকে নিতে এসেছি রে আমি ঢোক গিলে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলবো, ‘জানতাম ববি, একমাত্র তুই, তুই আসবি আমায় নিতে।’ বরবটি সামনে আসলো একটু পর। শিকের ওপাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘শুয়োর… তুই এত নিচে নামছিস? আই কান্ট বিলিভ। পথেঘাটে মেয়েদের ওড়না টানছিস! ছিঃ’ আমি ঢোক গিলে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ি।
বরবটি চলে যায়, যাওয়ার আগে ওসি কাদেরের কানে ফিসফিস করে বলে,’রামঢলা দেবেন স্যার, একটা আমার পক্ষ থেকে।’ ওসি কাদেরের পরিশ্রম করে রামঢলা ঢলা দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। সারারাত্তির মশা পুরো শরীর ঢলা দিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে। যখন ছাড়া পেলাম, পরদিন সকালে। বাসায় পৌঁছার পর তাগড়া একটা ঘুম দেব ঠিক করেছি। আম্মু দরজা অর্ধেক খুলে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বললেন, ‘ও বাবা আসছিস তুই। নে বাবা নে, মাথাটা অর্ধেক ঢুকা দরজার ফাঁকে।’ আম্মু দরজার একপাশ ধরে আছেন শক্ত হাতে, মাথা ঢুকালেই চাপা দেবেন। কি সর্বনাশ! আমি আস্ত মাথা নিয়ে বের হলাম বাসা থেকে। বাসায় যাওয়া যাবেনা।
বরবটিও জায়গা দেবেনা। অর্পিতাও আম্মুর মতোন একিই কাজ করবে। সে হয়তো একধাপ এগিয়ে বলবে, ‘মাথা না, পা দাও। একদম উরু অবধি ঢুকায়ে দাও দরজার ফাঁকে। চ্যাগায়ে থাকো সোনা। এই তো, বাহ। গুড বয়।’
কল্পনায় ধড়াম শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম। নিচে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বন্ধু মেশকাত ই একমাত্র ভরসা। ফোন দেয়ার পর সে চিৎকার করে বললো, ‘তুই অর্পিতারে ছেড়ে কোন খানকির প্রেমে পড়ছোস হারামজাদা শুয়োর? তোরে সামনে পাইলে আমি কচলাইয়া খায়া ফেলবো। অর্পিতা কান্না করতেছে ফোনে।’ আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘বন্ধু, ভুল বুঝতেছে ও।
আসলে কাল রাতে একটা ছেলে মেশকাতের গলার স্বর এভারেস্টে উঠে গেলো, ‘ওয়াক থু, তুই গে হয়ে গেছিস শেষমেষ? ছ্যাহ ছ্যাহ.. অর্পিতার মতোন মেয়ে থাকতে ইয়াকককক! তুই তো আমারেও ছাড়বিনা। খবরদার আমার দিকে তাকাবিনা। সামনে পড়লে তোর ইয়ের ভেতর থেকে ইয়ে টেনে ইয়ে কেটে দেব!’ আমার হেঁচকি উঠে, ফোন কোনোরকমে কেটে পকেটে ঢুকাই। কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে, ইয়া খোদা। এই ভয়ংকর দুঃসময়ে পূর্ণার কথা মনে পড়লো। বরবটি, পূর্ণা, মেশকাত আর অর্পিতা আমরা সবাই বন্ধু। বিখ্যাত এক ফ্রেন্ড সার্কেল। আমি যদিও জানি, পূর্ণার একটু আধটু দুর্বলতা আছে আমার জন্য। অর্পিতার ভয়ে প্রকাশ করেনি কখনো। আজ এটাকে এই দুঃসময়ে কাজে লাগাতে হবে। অন্ততপক্ষে ও এইসব হিজিবিজি অন্যকারো কাছ থেকে শোনার আগেই।
পূর্ণার বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপার পরই পূর্ণা দরজা পুরোটা খুলে মুখের উপর দশ পনেরটা ওড়না ছুঁড়ে দিলো। রাগী স্বরে বললো, ‘ববিতার ওড়না টেনে মনের খায়েশ মেটেনি তোর? এবার আমার ওড়না লাগবে? নে, শুয়োর নে..’ আমি হকচকিয়ে গিয়ে বলি, ‘আমি তো ববিতার ওড়না টানিনি’ চুপ তুই। এখুনি যা। আব্বুরে ডাক দিবো নইলে।’ আমি এখন ফ্লাইওভারের নিচে বসে আছি। পাশে করিম চাচা বসে সারাদিনের ইনকাম হিসেব করছেন। আমি উনার কেনা পাউরুটি চিবোতে চিবোতে ফেসবুকে ঢুকেছি।
দেখি অর্পিতা আমার উপর রাগ করে মেশকাতের সাথে রিলেশনশীপ স্টাটাস দিয়েছে। বরবটি আর পূর্ণা সাজেক যাচ্ছে। আব্বা তাঁর আইডির ফ্যামেলি মেম্বার থেকে আমারে ডিলিট করে দিয়েছে। চাকুরির জন্য যে পরীক্ষা দিয়েছি, হতাশ রেজাল্ট দিয়েছে। আর রাতের সেই ছোটভাইটা মেসেজ দিয়েছে, ‘ভাই, সারাদিন ধরে ভাবছি। ত্যক্ত ভাই একদম ত্যক্ত হয়ে গেছি আমি। একটাও সমস্যা নাই। আমারে একটু ঝামেলায় ফেলবেন?’ আমি গলা উঁচু করে ফ্লাইওভারের উচ্চতা মাপলাম। নাহ, পারফেক্ট! ঝাঁপ দেয়াই যায়।