অব্যক্ত ভালোবাসা

অব্যক্ত ভালোবাসা

কলিংবেল বাজছে। আমি তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠতেই মা বলে উঠলো, “যা করছিলি তাই কর। আমি খুলে দিচ্ছি।” ‘কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলাম?’- ভাবতেই চোখ পড়লো হাতে ধরে রাখা ফোনের দিকে। এতক্ষণ তো আমি মায়ের ফোনটা নিয়েই গেম খেলছিলাম। আর যাই হোক, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিশ্চয়ই না। তাহলে মা ওইভাবে বলল কেন? পরক্ষণেই মনে হলো, মা নিশ্চয়ই রাগ করে কথাটা বলেছে। কেননা আমার হাতে ফোন দেখলেই তো মায়ের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আচ্ছা, পৃথিবীর সব মা-ই কি এই রকম হয়?  আমার চিন্তায় ছেদ ফেলে বাবা সামনে এসে বলে উঠলো, “কী রে মা, কী করছিস বসে বসে?” আমি তৎক্ষণাৎ ফোনটা আড়াল করে প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবো, এমন সময় মা পাশ থেকে বলল, “সারাদিন যা করার তাই করছে।” মায়ের কথা শুনে মনে মনে রাগ হলেও সেটা প্রকাশ করলাম না। কারণ সব জায়গায় সবকিছু প্রকাশ করতে নেই। হিতে বিপরীত হতে পারে।

আমি প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য মুচকি হেসে বললাম, “বাদ দাও তো মায়ের কথা। তুমি কি বাজার থেকে ফিরলে?”
বাবা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তে করে বলল, “হ্যাঁ রে মা।” বাবার মুখ থেকে হ্যাঁ কথাটা শুনে আমি একটা স্বস্তির ঢেঁকুর তুললাম। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী নিয়ে এসেছ? আমি যে বলেছিলাম গরুর মাংস আনতে, সেটা এনেছ? রোজ রোজ ওই নিরামিষ খেতে খেতে মুখটা একদম পচে গেছে। কতদিন গরুর মাংস খাই না। আজ বেশ জমিয়ে ঝাল ঝাল করে মা’কে রান্না করতে বলবো, কেমন?” আমার কথার বাবা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। গুটিগুটি পায়ে পাশের রুমে চলে গেল। আমি আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। বাজারের ব্যাগের কাছে ছুটে গেলাম মাংস দেখার জন্য।

মা একটা করে জিনিস বের করছে, আর আমি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি। প্রতিবার একটা করে জিনিস যখনই বের করে আমি ভাবি এইবার নিশ্চয়ই মাংসের থলিটা বের করবে। কিন্তু বারবারই হতাশ হতে হয়। নিজের মধ্যে চাপা উত্তেজনা আর দমিয়ে রাখতে না পেরে বাজারের ব্যাগটা একবারে উল্টো করে ফেললাম। মেঝেতে সব জিনিস লুটোপুটি খাচ্ছে। সব জিনিসগুলো যখন হাতরে বেরাচ্ছি তখন মা হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলো, “মাংস কি বাপের ঘরের তালুক পাইছস যে চাইলেই পাওয়া যায়? নবাবজাদী মাংস খাইবো। মাংসের দাম কত জানস সেটা?” মায়ের কথা শুনে মেজাজটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। রাগের বশে নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে বলে বসলাম, “এক কেজি মাংস আনার মুরোদ যখন নেই, তখন ছেলেমেয়ে জন্মাতে কে বলেছিল?”

আমার কথা শুনে মায়ের চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। কথার কোনো প্রতিবাদ না করেই মুখে আঁচল টেনে রান্নাঘরের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। মনের ভেতরে কেমন বিজয়ী বিজয়ী একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে গর্জনরত একটা সিংহকে এক নিমেষেই যেন কুপোকাত করে ফেলেছি। আজ করিম ভাই এসেছিলেন। মেয়ের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।”- খাবার টেবিলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা কথাগুলো ছুঁড়ে দিলো। আমি প্লেটের ভাতে হাত নাড়ছি আর ভাবছি, “আমি বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কেন কিছু জানতে পারলাম না?” অবশ্য আমার জানা আর না জানা একই কথা। আমি তো আর ইনকাম সোর্স না। তাহলে আমার সবকিছু জানা মানায়ও না। মা’কে উদ্দেশ্য করে বাবা প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো, “দাওয়াত কবে?”

“শুক্রবারে।”
“যাবে নাকি?”
“সেটা আমি কী জানি।

ঘরের সাথে ঘর। না গেলে মানুষ খারাপ বলবে না?” “হাত তো পুরো ফাঁকা। দেখি দু’দিনের ভেতর কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।”- কথাগুলো বলেই বাবা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। “কী রে রিনি, খাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছিস কেন? ভাতগুলা তো শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে নাকি?” মায়ের কথা কানে যেতেই আমার সম্বিত ফিরল। চিন্তা জগৎ থেকে বেরিয়ে বললাম, “খেতে ইচ্ছে করছে না।” “খেতে ইচ্ছে করছে না মানে? প্লেটের সব ভাতই তো পড়ে আছে। শিগগির খাওয়া শেষ কর।”

আমি বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বললাম, “কতবার বলবো, এই একই জিনিস রোজ রোজ খেতে আর ইচ্ছে করে না।” মা এবার কাছে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল, “এখন একটু জোর করে খেয়ে নে। কাল বাদে পরশুই তো দাওয়াত৷ তখন নাহয় ইচ্ছেমতো খাবি।” মায়ের কথা শুনে একপ্রকার নিমরাজি হয়েই খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। অবশেষে আসলো সেই কাঙ্খিত দিন। আমিও বেশ নতুন জামা পরে আয়নায় নিজেকে বারবার দেখে নিচ্ছি। পনেরো বছরের কিশোরী আমিটাকে যেন নিজেই আজ চিনতে পারছি না। বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে। মা একটা সাদামাটা শাড়ি পরেছে আজ। তবুও যেন চোখমুখে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা খেলা করছে। বেশ ভালো লাগছে দেখতে।

সামনে বিভিন্ন ধরনের খাবার সাজিয়ে রাখা, অথচ কেন জানি খেতে ইচ্ছে করছে না একদম। বলতে গেলে এই এক সমস্যা আমার। দাওয়াত বাড়িতে কখনো ঠিকভাবে খেতে পারি না। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে সবার সাজপোশাক দেখতেই অর্ধেক সময় পার হয়ে যায়। সমস্যা হয় বাড়িতে ফিরে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটল না। বাড়িতে আসতে না আসতেই পেটের মধ্যে ছুঁচো বাবাজী যেন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। মা’কে বললে নির্ঘাত এখন বকা খেতে হবে। খাবার টেবিলে বসে আছি। মা ভাত বাড়ছে। বাবা বিছানায় বসে কী যেন হিসেব কষছে। ভাতের প্লেটে চোখ পড়তেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। মা ইশারায় চুপ করতে বললেও উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে না পেরে বেশ জোরেই বলে উঠলাম, “মা, তুমি এখন মাংস কোথায় পেলে?”

আমার কথা কানে যেতেই বাবা সব কাগজপত্র সরিয়ে রেখে বিদ্রুপের সুরে বলে উঠল, “নিশ্চয়ই দাওয়াত বাড়ি থেকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছ? এতবছর সংসার করেও ছোটলোকি অভ্যাস আর গেল না। এজন্যই কোনো দাওয়াত বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না।” বাবার কথার মা কোনো প্রতিবাদ করলো না। চুপ করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকলো। বরাবর বাবাকে সাপোর্ট করলেও আজ কেন জানি মায়ের পক্ষ নিতে ইচ্ছে করছে খুব। একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না মা ভুল কিছু করেছে। আর যাই হোক, আমি এর মধ্যে ছোটলোকি কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। বরং মায়ের এই কাজের মাঝে দেখতে পাচ্ছি সন্তানের প্রতি মায়ের এক সাগর ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কাছে বাকি সবকিছুই তুচ্ছ।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে মা এবার বলল, “দুপুরে তো ভালোভাবে কিছু খেলি না। লোকজনের সাজ দেখতেই দিন পার করলি। ঘরে তখন ভাতও ছিল না যে তোকে খেতে দেবো। শিগগির হা কর দেখি চোখ থেকে অজান্তেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু ঠোঁট জুড়ে এক অদ্ভুত হাসি খেলা করছে। আনমনে মা’কে উদ্দেশ্য করে বললাম, “মা, তুমি আমায় খুব ভালোবাসো তাই না?” মা আমার কথার কোনো পাল্টা জবাব দিলো না। শুধু আলতো করে চোখ মুছে দিয়ে বলল, “তোর আর ছেলেমানুষি গেল না। কতবার বলেছি খাবার সামনে নিয়ে চোখের জল ফেলতে নেই। বকবক না করে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর তো।”

আমি জানি, মা কখনোই মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলবে না। আমারও কখনো বলা হবে না ‘মা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি’। আসলে কিছু অনুভূতি অব্যক্ত থাকা ভালো। কেননা সবকিছু প্রকাশ করতে নেই। কিছু জিনিস বুঝে নিতে হয়। মন পড়ে জেনে নিতে হয়।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত