প্রাক্তন প্রেমিকা

প্রাক্তন প্রেমিকা

আমি আমার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে সচরাচর যোগাযোগ করিনা। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়না তা না। মন খারাপ হয়, একসাথে কাটানো সময় মিস করি। তবুও নতুনভাবে মায়াজালে আটকে যেতে চাই না। তবে তাকে চিঠি লিখি। রোজ লিখতে না পারলেও প্রতি মাসে একটা চিঠি অবশ্যই লিখি। তবে ভুল করেও সে চিঠি তার এলাকার ডাকবাক্সে পৌঁছায় না। চিঠির স্থান হয় আমার ভেজা বালিশের নিচে কিংবা তোশকের তলায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটা চিঠি পাঠিয়েই দেই। দেখি উত্তর আসে কিনা। তখন সে চিঠিটার স্থান হয় টেবিলের ড্রয়ারে। সাহস করে পোস্ট করা হয় না। সেদিন প্রাক্তন ফোন দেয়। ঘুমাচ্ছিলাম তখন। ধরবো না ধরবো না ভেবেও শেষ পর্যন্ত ফোন রিসিভ করি।

— আসসালামু আলাইকুম।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম।
— ভালো আছেন?
–আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?
–হ্যাঁ ভালো। কি করছেন?
–ঘুমাচ্ছিলাম। তুমি?
–এইতো কিছু না। দুপুরে খেয়েছেন?
— না খাওয়া হয়নি। হোস্টেলের খাবার পছন্দ হয়নি।
–তাহলে বাইরে খেয়ে নিতেন।
–হাতে টাকা পয়সা নেই তেমন। সমস্যা নেই। তেমন ক্ষুধা লাগছে না।
–এক কাজ করুন।
–কি?
— সব সময় যেই রেস্টুরেন্টে খেতাম এখনি চলে আসুন। সন্ধ্যার পরে আমি বের হতে পারবো না। তাড়াতাড়ি আসুন। আপনার প্রিয় কাচ্চি খাওয়াবো।

ক্ষুধা লাগছিলো না কথাটা মিথ্যে। প্রচন্ড ক্ষুধা ছিলো। কাচ্চির লোভ সামলাতে না পেরে সাথে সাথে রেস্টুরেন্টের সামনে চলে গেলাম। ২০/২৫ মিনিট লেগেছে। সে আসতে কিছুক্ষণ লেইট করছিল। আমি সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে কখন এসেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ এক নারীকন্ঠ আমায় বলছে–

–এইসব না খেলে হয়না?
–হয়।
–তাহলে ছেড়ে দিন না। আপনার তো ফ্যামিলি হিস্ট্রিও আছে COPD এর। আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন।
–হ্যাঁ তাই ভাবছি।
–আচ্ছা এই ধরেন আপনার কাচ্চি। আপনি ফোন ধরছিলেন না তাই কিনে প্যাকেট করে নিয়ে আসছি।
–কোথাও বসি? বসে খেয়ে তারপর যাই?
— আচ্ছা চলেন।

রেস্টুরেন্টে বসে কাচ্চি, কোল্ড ড্রিংকস, চা খেলাম। টুকটাক কথা হলো। আমিই তাকে জিজ্ঞেস করলাম নতুন কারো প্রেমে পরেছে কিনা। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো–

— এসবে আর ইন্টারেস্ট নেই। নিজেকে সময় দিচ্ছি। ক্যারিয়ার ভালো হলে সব ই হবে।
— হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। আপনার প্রেমিকা কেমন আছে?
— ভালো আছে।
–আমার চেয়ে সুন্দরী? কতদিনের সম্পর্ক?
–হ্যাঁ। এইতো কয়েক মাস।
–প্যারা দেয়?
— না।

–আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন সে জানে?
–না। রুমে গিয়ে বলবো।
–রাগ করবে না?
— না। সেও একদিন তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে দেখা করেছিল।ভেবেছিল আমাকে বললে রাগ করবো কিনা। আমি মোটেও রাগ করিনি।
–রাগ করেন নি কেন?
— আমি তাকে বিশ্বাস করি আর আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। প্রাক্তন থাকলে মনে পরবেই। হুটহাট মনে খারাপ হবে। এটা এড়ানোর সুযোগ নেই। ভালোবাসলেই বন্দী করে রাখতে হবে এমন না। তাকে স্বাধীনতা দাও। যদি না ফিরে আসে তাহলে সে কখনোই ভালোবাসে না। বিশ্বাস টাই বড় বুঝলা?

–হুম। বাহ তাহলে খুব ই ভালো। বিয়ে-শাদি করেন। দাওয়াত খাই।
–কিছু সমস্যায় আছি। সমাধান হয়ে গেলে বিয়ে করে ফেলবো।
–অগ্রিম শুভেচ্ছা। আমার জন্য কিছু আনেন নি?
–এনেছি। কবি হেলাল হাফিজের কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বইয়ের ভেতর একটা চিঠি আছে। পরে নিও
–আচ্ছা। এই ব্যাগ টা ধরেন। এতে শুটকির তরকারি, শুটকি ভর্তা, পিঠা, গরুর গোশত আছে। রাতে খেয়ে নিবেন।
— আচ্ছা থেনক ইউ। উঠি তাহলে। বাসায় পৌঁছে একটা ফোন দিও।
— আপনি আর বদলাবেন না। আমি বাসায় পৌঁছানোর আগ অব্দি আপনি খাওয়া দাওয়া করতেন না। এতো দুশ্চিন্তা করতেন কেন? কখনোই কিন্তু বিপদে পড়িনি।

–বিপদ কখন আসে বলা যায় না। আমরা ছেলেরা তোমাদের নিরাপত্তা দিতে পারিনা। দেখোই তো দিন দিন রেইপের পরিমাণ কি হারে বাড়ছে। কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। এক কাজ করি। আমি তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি?

— আরে না। আমি এখন একাই রাস্তা পার হতে পারি। কাউকে লাগে না আমার।

কথাটা বলে ও মন খারাপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। ও কখনো একা রাস্তা পার হতে পারতো না। আমিই সব সময় হাত ধরে পার করে দিতাম। বাসে তুলে দিতাম। অথচ এখন সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। একা থাকার অভ্যেস হয়ে গেছে। ওকে বাসে তুলে দিয়ে আমিও ফিরতি বাস ধরলাম। আমিও প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। ও ফোন দিয়ে জানালো ও বাসায় গিয়েছে। দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম। আচ্ছা চিঠি টা আপনাদেরও দেখাই। প্রিয় অমুক,

এটাই হয়তো তোমাকে লিখা আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। এর আগেও চিঠি লিখার কথা থাকলেও কখনো লিখা হয়ে উঠে নি।তবে পুরো একটা ডায়েরি লিখেছিলাম তোমার জন্য। তোমাকে ঈষৎ ভয় পাই কিনা তাই ডায়েরিটা দেওয়া হয় নি। সামান্য বললে ভুল হবে। আমি তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভয় পাই।মাইগ্রেনের সাডেন সিভিয়ার থানডারক্ল্যাপ হেডএকের মতোই মারাত্মক তুমি। তোমাকে দেখলেই বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে যায়, প্রেসারও বাড়ে বোধহয়, চোখে ঝাপসা দেখি। তাই স্বেচ্ছায় তোমার সামনে পরতে চাই না সচরাচর।

বিচ্ছেদের এতদিন পরে হুট করে কিসের চিঠি ভাবছো না? ভাবাটাই স্বাভাবিক। চিঠি টা যখন লিখছি তখন রাত ১২ঃ৫৪ মিনিট। জ্বর ১০২ ডিগ্রী। তাই চিঠি টা’কে গুরুত্ব না দিলেও চলবে। ধরে নিও তীব্র জ্বরের ভ্রমে চিঠি লিখেছি।

কেমন আছো? ভালো থাকার কথা। ধরে নিলাম তুমি খুউব ভালো আছো। সেদিন পাহাড়ে গিয়েছিলাম। একদম পাহাড়ের চূড়ায় বসে মেঘ ধরেছি। তখনই জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, “তোমার কি মেঘ পছন্দ? তোমার জন্য মেঘ আনবো?” জানা হয় নি। তুমি সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছো। কিন্তু কখনো ভেবেছো কি প্রচন্ড মন খারাপের রাতে আমি কাকে বলবো, “কিছু ভালো লাগছে না। মজার কাহিনী শোনাও।?” আমার কথা এখন না ভাবার ই কথা। মায়া, পিছুটান বড্ড খারাপ জিনিস। যে একবার মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে চাইলেও আর বের হতে পারে না।

তুমি কি এখনো পরীক্ষার আগে দিন-রাত ঘুমাও? কে ডেকে তুলে দেয়? তোমার সাথে আমার বেশিদিনের সম্পর্ক না হলেও আমি তোমার প্রতিটি কথা, প্রতিটি মুহুর্ত খুব মিস করি। আমাদের প্রথম সাক্ষাতে তোমার পার্লারে গিয়ে শাড়ি পড়া, পার্কে তোমার শাড়ির আঁচল ধরে ঘোরা, সাপের ভয় দেখিয়ে হিজরাদের টাকা নিয়ে যাওয়া, তারপর ছুটির পর একসঙ্গে চা খাওয়া, শাড়ি পাঞ্জাবি পরে ঢাকায় ঘুরতে যাওয়া, রিক্সার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করা, তোমার শাড়ির কুচি ঠিক করে দেওয়া, তোমার হাসি, স্পর্শ, চুলের ঘ্রাণ সবকিছুই যেনো কত স্পষ্ট, জীবন্ত। আমি যেন চোখ বন্ধ করলেই সব দেখি।

তোমার মনে আছে সম্পর্কের শুরুতে একদিন ভোরবেলায় ফোন দিয়ে দেখা করতে বললে! ওমা, তুমি দেখি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছো। তোমাকে আমার কলেজেই ভর্তি করাতেই হবে। কি ভীষণ জেদি তুমি। তোমাকে বোনের বাসায় দিয়ে এসে সেদিন মনে হচ্ছিলো, আমি পাইলাম।অবশেষে ইহাকে পাইলাম।

অথচ সময়ের সাথে ভালোবাসা রঙ বদলায়। আমাদেরও ব্যতিক্রম হলো না। কত কাছে থেকেও আজকাল দুজন কতো দূরে। হুট করে দেখা হয়ে গেলে মনে হয় আমাদের কখনো দেখা না হলেই ভালো হতো। আমি জানি সব ভুল আমার ছিলো। কিন্তু কি করবো বলো? আমি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে পরাধীনতা মিস করি। প্রেম এসে যাযাবর কন্ঠে চুমু খেলে আমার মনে হয় বিরহস্মৃতির মতো দারুণ কিছু হতেই পারে না।

আমি পুরোপুরি মেনে নিয়েছি তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে না। কিংবা আমরা আলাদা হলেই মঙ্গল। ঈশ্বর যা করেন অবশ্যই মঙ্গলের জন্য করেন। কিন্তু, কিন্তু তবুও কিছু কিছু সময় আমার নিজেকে একা লাগে। সব সময় মনে হয় আমার কি যেনো নেই। কিছু একটা নেই। আমি জানি সেটা তুমি। তুমি ছাড়া আর কিচ্ছুটি হতে পারে না। নিজেকে সামলে নিয়েছি। যত কষ্টই হোক এখন আর যোগাযোগের চেষ্টা করি না। গাল-মন্দ শুনি না। সবকিছু পেয়ে গেলে জীবনের মূল্য থাকে না। আমি না হয় কিছু বিরহস্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকি। তুমি হয়তো ভাবছো আমি খুব সুখে আছি। কিন্তু বিশ্বেস করো কি দুঃখের আগুন জ্বলছে আমার দাঁড়িতে, উসকোখুসকো চুলে, চোয়ালে, মেরুদন্ডের হাড়ে, নাকের ডগায়, চোখের পাতায়, বুকে, পিঠে, পায়ের গোড়ালিতে! কেউ বুঝে না। অথচ কেউ একজন তো চাই যে চেহারা দেখেই বলে দিবে, “কি মন খারাপ কেন?” আমার নেই।কেউ নেই। কেউ না।।।। বিরক্ত হচ্ছো? থাক কথা বাড়াবো না। তুমি খুব ভালো থেকো। আমি বেঁচে আছি।

ইতি,
তোমার কেউ না রাতে মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখি সে আমাকে আনব্লক করেছে। তার ডায়েরিতে চিঠির উত্তর দিয়েছে। ছবি পাঠালো আমায়। পড়া শুরু করলাম।

“নাহয় নাইবা হোক বিষাদবিলাস, তাতে কি আসে-যায়?থামবে কি কবেকার উল্লাস? আকাশ-বাতাস জুড়ে তাবৎ দুঃস্বপ্নেরা আহ্লাদী পৃথিবীতে নেমে আসে যখন, এই শীত-বর্ষা-বসন্তের সে কতটুকু আপন? আদুরে, আলতো যে বীণা, তাতেও আজ ধুলো পড়েছে কিনা, জানানোর কি নিতান্তই প্রয়োজন? বীণার সুর কেটে গেছে প্রিয়! তোমার-আমার বিচ্ছেদের শুভেচ্ছা নিও। পরজন্মে যে চাইবোনা তার কি আছে ঠিক? পালাবে কোথায়? জানো কি কঠিন মায়াজালে ঘিরেছি চারিদিক?”

পড়া শেষ করে আমিও তাকে বিচ্ছেদের শুভেচ্ছা জানালাম। টুকটাক কিছু কথা বলার পর সে আবার ব্লক করে দিয়েছে। আবার সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমাদের আর দেখা না হোক। কথা না হোক। তুমি আমার না হও। তুমি থাকো তোমার না থাকা জুড়ে। আর দশজনের মতো তোমায় আমি ছলনাময়ী, বিশ্বাসঘাতিনী বলতে পারিনা। তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তোমার প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ কমবে না কখনোই। সব প্রাক্তন খারাপ হয় না। তুমি তার উদাহরণ হয়েই থাকো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত