———-
নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে টের পেলাম যে বেশ ভালোভাবেই সর্দি ধরেছে। বাম নাক বন্ধ। ডান নাক দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে।
তাতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। আর সর্দি লাগায় মাথাটা ভার হয়ে আছে। হাঁটতে নেশা নেশা লাগে।
এলোমেলো পা ফেলে এগুচ্ছি শাহবাগের দিকে। সর্দির আরেক নাম উপদংশ। সর্দি আর সিগারেট নিয়ে জ্ঞানীমহলে দুটি ধারণা প্রচলিত।
এক পক্ষের মতে- সিগারেট খেলে সর্দি গাঢ় হয়। তাই সর্দি হল তো সিগারেটকে না বলুন।
অন্য পক্ষ আবার এক কাঠি বাড়ন্ত- সিগারেটের ধোঁয়া নাক দিয়ে বের করলে নাকি সর্দি বাপ-মা-কাকা-খালা বলে পালায়।
দুই দলের কথা পুরোপুরি উল্টা। আমার ধারণা এদের এক দল আওয়ামীপন্থী আর অন্যদল বিএনপিপন্থী।
এরশাদ মামা এখানেও সুবিধা করে উঠতে পারেন নাই। এদের কথা থাক। আমি বরং বিখ্যাত কাউকে জিজ্ঞেস করি।
এই মুহূর্তে একজনের কথাই মনে আসছে- সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি জীবিত থাকাকালীন সময়ে সর্দি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছিলেন।
তাঁর লেখা “বেঁচে থাক সর্দি-কাঁশি” গল্পটি একটি সুপাঠ্য গল্প। মনে মনে মুজতবা আলী সাহেবকে ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে।
– হ্যালো। কে বলছেন?
– স্যার, আমি হিমু। সর্দি বিষয়ে আপনার সাথে একটু আলোচনা ছিল।
– বল কি বলবে। আমাকে আবার রসগোল্লা খেতে যেতে হবে। ঝান্ডুদা বসে রয়েছেন।
– আপনি বলেছেন ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে এক সপ্তাহে আর না খেলে সারে সাত দিনে।’- এর মানে কি?
– মানে কিছুই না। ঔষধে সর্দি ছাড়ে না- এটাই মনে হয় বোঝাতে চেয়েছি।
– তাহলে সর্দি থেকে রেহাই পাবার উপায় বাতলে দিন।
– রসগোল্লা খেয়ে দেখতে পার। রসগোল্লা সর্বরোগের ঔষধ।
– হুম। আপনি স্যার কোন পন্থী? আওয়ামীপন্থী না বিএনপিপন্থী?
– আমি ডানপন্থী। কারণ রসগোল্লা ডান হাত দিয়ে তুলে মুখে দিতে হয়।
মনে মনে কথা বলছি তাই মুখে বললাম ‘খাইছে আমারে’। এই বুড়ার জগৎতো রসগোল্লায় গোল্লাময়।
– কিছু মনে করবেন না স্যার। আপনার সাথে কথা বলে মাথা ধরেছে। আমি ফোন রাখব। বাই। টিসি।
– টিসি আবার কি??
– টেককেয়ারকে ছোট করে এখন টিসি ডাকা হয়।
ফোন রেখে বিএনপিপন্থীদের উপদেশ মেনে সিগারেট ধরালাম। নেশা নেশা ভাবটা আরেকটু বাড়লে মন্দ হয় না।
“হিমু। এই হিমু।”
“হিমু। এই হিমু।”
ভাবলাম হয়ত মুজতবা আলী সাহেব আবার ফোন করেছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই মেয়েলী কন্ঠে ডাকবেন না।
আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সামনে ডাস্টবিনে একটা কুকুর খাবার খুঁজছে। সেতো আর আমার নাম জানে না।
জানলেও সে নিশ্চয়ই আমার নাম ধরে ডাকবে না। তারউপর তার এখন পিক আওয়ার চলছে।
রাস্তার ওপাশে একটা পাজেরো দাঁড়ানো। সেখান থেকেই কেউ একজন ডাকছে। পাজেরো অর্থ পাহাড়ি যোদ্ধা।
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে এক নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লাম। একনাক দিয়ে ছেড়েছি বলে ধোঁয়ার পরিমান বেশি।
সিগারেট ফেলে ‘পাহাড়ি যোদ্ধা’র কাছে গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাসলাম। গাড়ির ভেতর রূপা বসে আছে।
ওকে আগের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের রূপ মনে হয় প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ে।
রূপা বোধহয় সেই টাইপের মেয়ে।
“গাড়িতে ওঠ।”
আমি ড্রাইভারের পাশে উঠে পড়লাম। এই ড্রাইভার নতুন। আমার দিকে চিকন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এর নাম ‘তুই চোর’ দৃষ্টি।
কাউকে চোর সন্দেহ হলে তার দিকে ‘তুই চোর’ দৃষ্টিতে তাকানো যায়।
বাসে কারো হাত মানিব্যাগে লাগলে আমরা যেইভাবে তাকাই অনেকটা সেইরকম। পাজেরোর ভেতর আরামদায়ক শীতলতা।
এর নাম ঘুম শীতলতা। ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘুমপাড়ানী মাসী এবং পিসী দুজনই নিজেদের কাজ শুরু করেছেন।
আচ্ছা ঘুমাপাড়ানি মাসী আছে; মেসো নাই কেন? নাকি তারা দুজনই বিধবা?
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ঘুম পাড়ানোর কাজ করতে হচ্ছে। তাদেরও হয়ত ছেলেমেয়ে আছে। স্কুলে পড়ে।
মাসী-পিসীরা ছেলেমেয়ের প্রশ্ন কেনার টাকা যোগাড় করার জন্য দিন-রাত খেটে যাচ্ছেন। কিন্তু ইদানিং আয়-রোজগার ভালো হচ্ছে না।
মানুষ এখন আর সহজে আগের মতো ঘুমাতে চায় না। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল বা চোখে ঘুম জড়িয়ে এল।
ঘুমের মধ্যে বাবাকে স্বপ্ন দেখলাম। বসে বসে রসগোল্লা খাচ্ছেন। চুক চুক শব্দ হচ্ছে। আরামে তার চোখ বন্ধ। বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছেন বোঝাই যায়।
‘বাবা, কি করছ?’
‘কানামছি ভোঁ ভোঁ খেলছি, ছাগল ছেলে। দেখিস না রসগোল্লা খাচ্ছি।’
‘তোমার কি শরীর খারাপ?’
‘শরীর ঠিকই আছে। মেজাজ খারাপ। অত্যাধিক খারাপ। তোর ব্যাপারটা কি?’
‘কোন ব্যাপার?’
‘গাড়িতে বসে ঘুমাচ্ছিস যে।’
‘কারণ এখানে দাঁড়িয়ে ঘুমানোর কোন চান্স নেই।’
‘তুই কি আমার সাথে রসিকতা করার চেষ্টা করছিস?’
বাবার সাথে কথাবার্তা আর এগুলো না। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি রূপাদের বাড়ি পৌঁছে গেছি।
‘কেমন আছ তুমি?’
‘আমি ভাল আছি রূপা।’
‘চা খাবে?’
‘হ্যাঁ, এককাপ পান করা যায়।’
রূপা বের হয়ে গেল। ওকে এখন আরো বেশি সুন্দর লাগছে। রহস্যটা কি? আমি বসে আছি রূপার রুমে।
পরিপাটি রুম বলতে যা বোঝায় রূপার রুম ঠিক তাই। দেয়ালে রূপার আঁকা একটা ছবি টাঙ্গানো।
ছবিতে সাপুড়ে সাপখেলা দেখাচ্ছে। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। তবে সাপটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়। মনে হয় অজগর।
কোন সাপুড়ে বীণ বাজিয়ে অজগরের খেলা দেখায় কিনা জানি না। ব্যাপারটা রূপাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে।
রূপা ট্রেতে করে দু’কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি চা নিলাম।
‘তোমার মহাপুরুষ হওয়া কতদূর? মহাপুরুষ হতে পেরেছ?’
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। এই হাসির নানা রকম অর্থ হয়।
‘অকারণে হাসবে না। তোমার হাসি মোটেও সুন্দর না। কুৎসিতের কিছুটা কাছাকাছি।’
আমি আবারও হাসলাম।
‘হিমু’
‘বল’
না চাইতেও সতর্ক হয়ে গেলাম। মেয়েদের এই স্বরের একটা বিশেষ অর্থ আছে। এটার মানে সামনে ভয়াবহ দুর্যোগ।
এটা তারই ইঙ্গিত। অনেকটা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো।
‘পরশু আমার বিয়ে।’
হিমুদের কখনো হকচকিয়ে যেতে হয় না। হিমুরা থাকবে সব বিষয়ে উদাসীন। তবুও আমি বেশ একটা ধাক্কার মতো খেলাম।
কিছু বলতে পারলাম না।
রূপার চোখে সন্ধ্যার বিষণ্ণতা ভর করে। সেই বিষণ্ণতা আমাকেও ছুঁয়ে যায়। রূপা হাসার চেষ্টা করল।
হাসিটা ঠিকভাবে ফুটল না। কষ্টের হাসি ঠিকভাবে ফোটে না।
‘তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করতাম?’
‘করতাম বলছ কেন? এখন আর করো না?’
‘না।’
‘না’ বলার সময় রূপার গলাটা কেঁপে গেল। প্রকৃতি এই ব্যবস্থাটা করেছে যেন কেউ মিথ্যা বললে অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝে যায়।
আমি হিমু। বাবার মহাপুরুষ বানানোর ট্রেনিং-এর চোটে আবেগ-টাবেগ পালিয়েছে বলেই ধারণা ছিল আমার।
কিন্তু ট্রেনিং-এ বোধহয় ভেজাল ছিল। গলার নিচে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠতে চাচ্ছে। চোখের আদ্রতাও বাড়ছে টের পাচ্ছি।
লক্ষণ সুবিধার না। আর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
ঘরের লাগোয়া বারান্দায় কার যেন ছায়া পড়েছে। আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।
তার মুখ অসম্ভব করুণ। রূপার কথায় বাস্তবে ফিরি।
‘তুমি কি শেষবারের মতো আমার হাতটা একটু ধরবে?’
রূপা আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল। আমার পাগল বাবা আমাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন।
ঠিক অন্যরা যেমন চায় তার ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক। এজন্য বাবাকে অনেকটা পথ চলতে হয়েছে।
তাই তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি রূপার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরতে পারি না। বরং যেন আরো দূরে সরে যেতে থাকি।
পরম ভালবাসায় ডোবানো এই হাত একবার ধরলে তা ছেড়ে দেয়া শত হিমুর পক্ষেও সম্ভব না।
ভালবাসার শক্তি অন্যরকম এবং তীব্র।
‘রূপা, চা শেষ। আমি আসি। ভাল থেকো।’
‘এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পার। তুমি কি জানো- মেয়েরা যে কোন কিছুকেই ভালো হিসেবে ধরে নিতে পারে।
কখনো সময় হয়ত একটু বেশি লাগে। তবে পারে।’
রূপা আবারো হাসার চেষ্টা করল। এটাও ফুটলো না।
রূপাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। রূপা বারান্দার এসে দাঁড়িয়েছে। না তাকিয়েও বুঝতে পারছি তার চোখে জল।
বিকেলের আলো তাড়াহুড়ো করে বিদায় নেওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত।
কোন এক তরুণীর চোখের জল সেই আয়োজনে বিঘ্ন ঘটাতে পারছে না। আমার এক চোখ ঝাপসা। ডান চোখ।
এটাও কি সর্দিজনিত সমস্যা কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একচোখ ভর্তি ভালবাসার উপহার নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি।
বারান্দার রূপা আর এগিয়ে যাওয়া আমার মধ্যখানে বাবা দাঁড়ানো। বাবার মুখে প্রশান্তি।
যেন ছেলের এসএসসির রেজাল্ট বের হয়েছে। রেজাল্ট ভাল। এ প্লাস। কিন্তু এই ভালো রেজাল্ট নিয়ে আমার ভালো লাগছে না।
ইচ্ছে করছে পেছনে ফিরে বাবাকে বলি, ‘বাবা, মহাপুরুষ হবার কোন ইচ্ছে নেই আমার।
রূপা নামক তরুণীটির হাত ধরে আমি বেশ সাধারণভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।’
পারলাম না। সবাই যা পারে হিমুরা তা পারে না। পড়ন্ত বিকেলের অস্থিরমতি হাওয়া গায়ে মেখে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাই।
মনে পড়লো, ছবির সাপটা অজগর কিনা রূপাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।