রেণু

রেণু

রেণুর সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল আম্মার ইচ্ছাতেই।আমার নিজের জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত অথচ আম্মা আমাকে জিজ্ঞাস পর্যন্ত করলেন না।অফিস বন্ধ তাই গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম ছুটি কাটাতে।এসেছি এক সপ্তাহ ও হয়নি এর মধ্যেই আম্মু এই কাজটা করলেন।অবশ্য যেই ছেলের শার্ট প্যান্ট জুতা পর্যন্ত মায়ের কিনে দিতে হয় সেই ছেলের বাকী জীবনটা যাতে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারে সেইজন্য এতোটুকু কঠোর তিনি হতেই পারেন কথাটা বুঝতে আমার প্রায় বছর খানেক সময় লেগে গিয়েছিল ততদিনে আমি আর রেণু পারফেক্ট স্বামী স্ত্রী না হতে পারলেও ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।তবে আমি কোনভাবেই চাইনি নতুনভাবে কারো জীবনের সাথে।আমি জানি মেয়ে মানুষ কতটা স্বার্থপর হতে পারে।

তখন আমি সবে মাত্র ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়া টগবগে যুবক।একই ডিপার্টমেন্টের এক মেয়ের সাথে আস্তে আস্তে কথা বলাটা সেকেন্ড ইয়ারে গিয়ে ভালোবাসায় রুপ নিয়েছিল।অবশ্য প্রোপোজ তা মিলি হ্যা মিলিই করেছিল।সত্যি বলতে মনের মধ্যে একটা ভালোলাগা থাকলেও সেটা কোনদিনই আমি প্রকাশ করিনি।কারন আমাদের মধ্যে বাস্তবতার বিশাল ফারাক।

আমি খুব ভালো করেই জানতাম কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে আমার মত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের জন্য বড্ড বেমানান।তারপর জড়িয়ে গিয়েছিলাম ভালোবাসার বন্ধনে।সেই ভালোবাসার গভীরতা এতোটাই গভীর ছিল যে বিদায় বেলায় কাদতে হয়েছে আমার একা।থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে বিকেলবেলা রমনাতে ডেকেছিল মিলি। তারপর একটা বিয়ের কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ছেলে আমেরিকাতে সেটেল্ড ডাক্তার মিলির দুরসম্পর্কের কাজিন হয় দেশে ফিরেছে শুধু বিয়ে করার জন্যই।মিলির বাবা তাই দেরি করেনি। আমি কার্ডটা নিয়ে মিলির চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম তুমি আটকাতে চেস্টা করোনি।কিন্তু সেদিন তার চোখে আমার প্রতি তার তাচ্ছিল্য ভালোভাবেই প্রকাশ করেছিল।

তারপরও বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল আমাকে বিয়ে করলে খাওয়াবে কি???তুমিতো এখনো বেকার।চুপচাপ উঠে এসেছিলাম নিরলজ্জের মত কার্ডটা হাতে নিয়ে।কিন্তু ভুলতে পারিনি। তার প্রতি আমি এতোটাই নির্ভরশীল ছিলাম যে সেই নির্ভরতা কাটাতে একটা বছর নস্ট হয়ে গেছিলো।ঠিকমতো খাওয়া নেই পড়া নেই সারাদিন মিলির পাঠানো টেক্সট আর ছবি গুলো দেখেই কাটাতাম।তখন হয়তো মিলি তার স্বামীর সাথে ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তায় রাতের আলো আধারিতে লং ড্রাইভের স্বপ্নে বিভোর।নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছিলাম ওর মোহে।সেই মোহ কাটাতে আমাকে যেই পরিমান পরিবর্তন করতে হয়েছে তা কল্পনাতীত। পরবর্তীতে আমি ভার্সিটির চিরকুমার ক্লাবের সাধারন সম্পাদক হয়েছিলাম।নারী বিদ্বেষী ভাবটা আম্মার কানেও পৌছে গেছিলো।এরপর ভার্সিটি লাইফ শেষ করে চাকুরি জীবনে প্রবেশ।

সব কলিগরা যেখানে মেয়ে কলিগদের সাথে ভাব জমাতে ব্যাস্ত অবসরে তখন আমি পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে রাখতেই পছন্দ করতাম।কিন্তু এই সুখের দিন আর সহ্য হলোনা আমার মায়ের।আমার দায়িত্ব অর্পণ করলেন রেণু নামের এই মেয়েটার উপর।আমি যে বিয়ে করেছি সেটা অফিসের বা বন্ধু মহলের কেউ জানেনা জানলে কিহবে সেটা ভেবে ভেবেই নিজেই কেপে উঠছি।অবশ্য রেণু মেয়ে হিসেবে খারাপ নয়।ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করা সদ্য হাস্যজ্জ্বল মায়াবী চেহারার অধিকারী।যে কারো চোখে পছন্দ করার মতই মেয়ে, রান্নার হাত ভালো তারপরও আমি কেন জানি রেণুকে বউ হিসেবে কল্পনা করতে পারতাম না।বাসর রাতে আমার অতীত সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে ছিলাম।সবকিছু শোনার পর বলল আচ্ছা আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা।

দেখা যাক না কতদূর যায়।তারপর দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আম্মা ঠিকি ধরে ফেলেছে কারন আম্মা আমারে হাড়ে হাড়ে চেনে।১৫দিনের ছুটি শেষ এবার ঢাকায় আসতে হবে অফিস করার জন্য।আম্মা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন বউমাকে নিয়ে যা সাথে।মেসে কি খাস না খাস আর নতুন বউ সবে বিয়ে করেছিস আমার সাথে কেন থাকবে??? আমি বললাম তোমার সেবা যত্ন করার জন্য হলেও তো ওকে রেখে যাওয়া দরকার তাইনা???আম্মার উত্তরে আরেকবার অপমান বোধ করলাম থাকা বাছাধন তোমারে আমি খুব ভালো করেই চিনি।এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা তোমাক।

টিকিট কাটা হলো।রাত ১১টায় বাস সাতমাথা বগুড়া থেকে।নির্ধারিত সময়ে বাসে উঠলাম তবে রেণু অবাক করার মত করে বলল আপনি জানালার সিটটায় বসুন।আমিও হুম বলে তাই করলাম।গাড়ি চলছে।চোখে হালকা ঘুম লেগে আসছে।ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুম ভাঙলো প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে।জেগে দেখি রেণু জানালার সাথে হাত দিয়ে আছে আর আমার মাথাটা ওর হাতের উপর তারমানে এতো ঝাকি সবকিছু ওর হাতের উপর দিয়ে গেছে শুধুমাত্র আমার মাথায় যেন আঘাত না লাগে।

এই প্রথম রেণূর জন্য ভালো লাগলো এই ভেবে মা ছাড়াও আমাকে দেখে রাখার জন্য কেউ আছে।আমি বললাম হাতটা সরান ব্যথা পাবেন।সরিয়ে নিলো তাকিয়ে দেখি লাল হয়ে গেছে হাত তারমানে ভালোই ব্যাথা পাইছেন।গাড়ি ফুড ভিলেজে যাত্রী বিরতি দিলে দুইজনে নেমে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম।এবার একঘুমে ঢাকায়।জেগে দেখি আমি রেণুর ঘাড়ে মাথা দিয়ে আছি আর ও আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।আমি ইশারায় কি জিজ্ঞাস করতেই লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরালো।

ঢাকায় ফিরার পর হলো আরেক ঝামেলা।আমি থাকি মেসে।কিন্তু নতুন বউকে কি আর মেসে রাখা যাবে এসব চিন্তা না করেই নিয়ে আসলাম।আমি যে প্রথম শ্রেনির একটা গাধা আম্মার সেই কথাটা আরেকবার প্রমানিত হলো।আমি বিয়ে করেছি কথাটা যেন বন্ধু মহলে বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়লো।আমাকে দাওয়াত না দেয়ার অপরাধে গালাগাল করতে এসে এক বন্ধু থাকার সমস্যা শুনে তার এক খালার বাসায় চিলেকোঠায় একটা রুম ফাকা আছে বলে জানালো।ব্যস সাথে সাথেই সেখানে যাওয়া হলো কথা বার্তা বলার জন্য।ভদ্র মহিলা রাজি তারপর বন্ধু মহল থেকে দাবি আসলো মামা বিয়ে করছো ভালো কথা কিন্তু ট্রীট দিতে হবে কবে দিবা পরিষ্কার করে বলো।

আমি রেণুর দিকে তাকিয়ে দেখি লজ্জায় লাল হয়ে আছে।ওদের ট্রীট দিবো বলে বিদায় করলাম। এরপর শুরু হলো ঘর গুছানো।আমি চিরকুমার ক্লাবের সাধারন সম্পাদক আমার সম্পদ বলতে একটা লেপ তোষক প্লেট মগ আর ছোট্ট একটা টেবিল ফ্যান।ব্যস এই দিয়েই আমাদের ঘর গুছানো শুরু।দুপুর বেলা হয়ে গেছে।ক্ষুধা লাগছে দুজনেরই কিন্তু বলতে পাচ্ছেনা রেণু হয়তো।এরই মধ্যে ভদ্র মহিলা এসে খাবার দিয়ে গেলেন।বাড়িওয়ালা এতো ভালো হয় জানা ছিল না। সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেছে।আমি অফিস যাতায়াত শুরু করলাম। রেণুর নজর পড়লো ফাকা ছাদটার উপর।

ইতিমধ্যে বাড়িওয়ালীর সাথে ভালো খাতির জমিয়ে ফেলছে।বাগান করা শুরু করলো ও।আসলে মানুষের সময় কাটানোর জন্য একটা মাধ্যম লাগে বাগান করেই হয়তো সময় কাটায়।আমি সকালে যাই সন্ধ্যায় ফিরি।দুপুরে কল দিয়ে বলবে ব্যাগের ভিতরে খিচুড়ি দেয়া আছে।ফেরত যেন না আসে নাহলে আম্মাকে জানাবো কিন্তু।ভদ্র ছেলের মত খেয়ে নেই।আসলে মেয়েটা মায়ায় বাধতে চাইছে আমাকে।অল্প কিছুদিনের মধ্যই লক্ষ করলাম আমি অনেকটা রেণুর উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি।আমার মনে পড়লো প্রাক্তনের দেয়া ক্ষতটা।নাহ মেয়ে মানেই স্বার্থপর ভালোবাসতে জানেনা।শুরু করলাম অযথা বকাবকি, রান্না নিয়ে খোটা তারপরও মেয়ের ধৈর্য দেখে অবাক।সবকিছু নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে।এরমধ্যে আজকে আমার ফোনে একটা মেসেজ এসেছে আমার সেই প্রাক্তনের নাম্বার থেকে।বাংলাদেশে এসেছে ওরা দেখা করতে চায়।আমার কাছে মনে হলো এটাই সুযোগ দেখিয়ে দেয়ার।রমনা পার্কেই।

দেখা করতে বলেছি বিকেলবেলা।অফিস থেকে ফিরে রেণুকে বললাম রেডি হয়ে নিন একটা জায়গায় যেতে হবে আমাদের।শাড়ি পড়বেন কিন্তু।দুজনে রেডি হয়ে রিক্সায় উঠলাম। রেণু চুপচাপ বসে আছে।হঠাত একটা স্পীড ব্রেকারে ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়বার যোগার।এই প্রথমবার আমি রেণুর কোমরের পিছন দিয়ে হাত দিয়ে রিকশার হুড ধরলাম।মেয়েটা লজ্জায় গাল লাল করে ফেলছে।রিক্সা থেকে নেমে পার্কে ঢুকেই দেখি মিলি বসে আছে।দুজনে গিয়ে মিলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম।মিলি হয়তো আশা করেনি আমার এই পরিবর্তনটা।তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আড্ডা দিয়ে ব্যস্ততার অজুহাতে উঠে গেল।আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি জল।

আসলে মিলির বিয়েটা ভেংগে গেছে। ডিভোর্সড হয়েছে মাস খানেক আগে।হয়তো আশা করেছিলো আমি ওর আশায় বসে আছি।কিন্তু যে কস্টটা পেয়েছি সারাজীবন মনে থাকবে।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আমি আর রেণু দুইটা প্রানী সোডিয়াম ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাটছি নিঃশব্দে।আজকে নিজেকে হালকা লাগছে।আচ্ছা এখন রেণুর খোপায় যদি একটা বেলীফুলের মালা পড়িয়ে দেই রেণু কি খুব রাগ করবে???শাহবাগ থেকে একটা বেলীফুলের মালা কিনে পড়িয়ে দিলাম খোপায়।আমি রেণুর চোখে মুখে দেখলাম আমাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ।রিক্সা উঠলাম দুজনে একটু পর খেয়াল করলাম রেণু আমার হাতের উপর হাত রাখলো।শক্ত করে ধরলাম হাত দুইটা।

চুপিচুপি কেদেই যাচ্ছে অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো।মুখটা এদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিলাম।আমরা দুইজনেই জানি আজকে একটা নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের কিন্তু আমরা কেউ কাউকেই ভালোবাসি বলছিনা।আসলে সবসময় ভালোবাসার কথা মুখে বলা লাগেনা।মাঝে মাঝে আচার আচরনেও প্রকাশ পায়।রিক্সা চলছে আপন গতিতে।আচ্ছা এই সময়টাকে যদি টাইম মেশিনে তাহলে কেমন হতো???থাকতোনা কোন জৈবিক চাহিদা কিংবা পার্থিব চাহিদা।থাকতো শুধু দুজনের জন্য দুজনের মন ভরা পবিত্র ভালোবাসা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত