বড় অবেলায় পেলাম তোমায়

বড় অবেলায় পেলাম তোমায়

‘আমায় একবার মেঘের দেশে নিয়ে যাবে ইরিত্রা?’ আমি ফারাবীর দিকে একটু তাকালাম। ছেলেটা ভীষণ আকুতি মিনতি ভরা কণ্ঠ নিয়ে আমায় কথাটা বলেছে।

‘মেঘের দেশে যাবে?’
‘হ্যাঁ, খুব ইচ্ছে করছে যেতে জানো তো।’
‘কিন্তু কিভাবে যাব বলো তো?’ ছেলেটা এবার একটু নিচের দিকে তাকাল। হুট করেই কী জানি কী ভেবে বলে উঠল,
‘চলো, উড়ে চলে যাই সেখানে।’ আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম।

‘আমরা তো পাখি না।’
‘তাও তো ঠিক।’
‘আচ্ছা, তুমি মেঘের দেশে গিয়ে কি করবে?’
‘মেঘগুলোকে খুব কাছ থেকে একটু দেখব।’
‘শুধু এজন্যই?’
‘না না, আরও আছে।’
‘কি শুনি?’ ছেলেটা এবার আনমনে হয়ে মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকাল। তারপর কী যেন নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল।

‘আচ্ছা ইরিত্রা, মেঘ কী খাওয়া যায়?’
‘মেঘ খাবে?’
‘হ্যাঁ, খাওয়া যায়?’
‘উহু, যায় না। তুমি শুধু ছুঁতে পারবে।’
‘হাওয়াই মিঠাইয়ের মত যদি খেতে পারতাম!’
‘হুর, কী যে বলো না তুমি!’
আমার কথা শুনে ছেলেটা তার সবগুলো দাঁত বের করে উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
‘জানো ইরিত্রা, আমার না খুব হিংসে হয় তোমাকে দেখলে।’
‘আমায় দেখলে? কেন কেন?’
‘এই যে তোমার কত সুন্দর চুল, অথচ আমার চুলই নেই।’ কথাটা বলেই ছেলেটা মন খারাপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘আরে বোকা, মন খারাপ করছ কেন হ্যাঁ?’
‘ইশ, আমার যদি চুল থাকত!’ কথা বলতে বলতে কখন যে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি।
‘আচ্ছা শুনো, আমি এখন যাই।’

‘এখনই?’
‘হুম।’
‘আবার কখন আসবে?’
‘এইতো বিকেলে।’
‘আচ্ছা একটা আবদার করি?’
‘কী শুনি?’
‘আমায় একটু তোমায় হাতে খাইয়ে দিয়ে যাবে?’ আমি ছেলেটার দিকে ভালো করে একবার তাকালাম। ছেলেটার চোখ দুটো ছলছল করছে।
‘আচ্ছা, খাইয়ে দিয়ে তবেই আমি যাব। খুশি?’
‘হ্যাঁ, খুব খুশি।’

অনেকদিন পার হয়ে গেছে ছেলেটার সাথে একসাথে বসে খাওয়া হয় না। আসলে সময় করতে পারি না। পরিবার, অফিস এসবকিছু সামলে খুব একটা সময় পাওয়া যায় না। আজকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। যদিও ছুটি দিতে চাইছিল না, কিন্তু অনেক অনুরোধ করার পর ছুটিটা পেয়েছি। অন্যের অধীনে চাকরি করলে সচরাচর যা হয় আর কী। সহজে ছুটি পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ পর দু’জনের জন্য খাবার এনে ফারাবীকে খাইয়ে দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। ছেলেটা আমার জন্য পাগল। একটু বেশিই পাগল। আমাকে একদিন না দেখলে পুরো পাগলের মতো হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে আমার অফিসের নিচেই দাঁড়িয়ে থাকে আমাকে একনজর দেখার জন্য। আমি অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই আর আমাকে একনজর দেখে চলে যায়। কী যে একটা অফিস! ছুটি না হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুতেই বাইরে বেরোনো যাবে না।

‘বিকেল তো হয়েছে। চলো একটু হেঁটে আসি।’
‘হাঁটতে ভালো লাগে না।’
‘আরে চলো তো।’

ইদানীং ছেলেটা একেবারেই বাইরে বেরোতে চায় না। তার কাছে নাকি বাইরের পরিবেশ কেমন অস্বস্তি লাগে। যেখানে সবার বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো লাগে সেখানে নাকি ছেলেটার বাইরের পরিবেশ একেবারেই ভালো লাগে না। এই ছেলেটা কেমন যেন। হুট করেই কোনো জিনিস ভালো লাগে, আবার হুট করেই কোনো জিনিসের প্রতি অনিহা নিয়ে আসে।

‘ইরিত্রা?’
‘হুম।’
‘তুমি আমায় ভীষণ ভালোবাসো তাই না?’
‘উহু। একটুও ভালোবাসি না।’
কথাটা শুনে ছেলেটা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘তোমায় দেখছি।’
‘আমায় কী নতুন দেখছ নাকি?’
‘না, তা অবশ্য না।’

‘তাহলে?’ ছেলেটা আর কিছু বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করল।
‘এই ছেলে শোনো?’ ছেলেটা পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাল।
‘ভালোবাসি সেইটা কি মুখে বললেই প্রকাশ হয়ে যায়?’ ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘শোনো ছেলে, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা আমি নিজেও জানি আর তুমিও জানো।’
‘হু, জানি।’
‘তাহলে আমায় একা রেখে চলে যাচ্ছ কেন শুনি?’
‘যেতে তো চাইছি না কিন্তু…।’
‘থাক আর কিছু বলতে হবে না। আমার হাতটা ধরে আমায় নিয়ে যাও।’
ছেলেটা আমার সামনে এসে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা এসো। হাতটা ধরো।’ আমি ছেলেটার দিকে আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। তারপর ছেলেটা আমার হাতটা ধরে সামনে আগাতে লাগল।

‘আইসক্রিম খাবে ইরিত্রা?’
‘না, তোমার ভীষণ ঠান্ডা।’
‘থাক না সমস্যা কী?’
‘চুপ করো। আইসক্রিম খেতে হবে না।’ ছেলেটা আমার ধমক শুনে একেবারে চুপ হয়ে গেল। আমাকে ভীষণ ভয় পায় সে। কারণ আমার রাগটা খুব বেশি।
‘আচ্ছা তাহলে চলো ফুচকা খাই।’
‘তা খাওয়া চলে।’

ফুচকার দোকানে গিয়ে এক প্লেট ফুচকা নিলাম। দু’প্লেট নিতে বলেছিলাম কিন্তু ছেলেটা আবদার জুড়িয়ে বসেছে এক প্লেটেই দু’জনে মিলে খাবে। সে আমাকে খাইয়ে দিল আর আমি তাকে খাইয়ে দিলাম। আসলে ভালোবাসার মধ্যে কোনো কিছু ভাগাভাগি করে খেতে আসলেই ভীষণ ভালো লাগে। অসম্ভব রকমের ভালো লাগে।

‘এবার কোথায় যাবে ফারাবী?’
‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে।’ প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে বাইরে। হালকা হালকা অন্ধকার নামছে।
‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।’
‘হা হা।’
‘হাসছ কেন?’
‘তোমার কথা শুনে।’
‘কেন? কি এমন বলেছি?’
‘অন্য সময় তো আমি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসতাম, আর এখন তুমি।’
‘নারী-পুরুষ সমান অধিকার।’
ছেলেটা আকাশের দিকে তাকিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি দেখতে লাগল।
‘কিছু ভাবছ?’

‘হুম।’
‘কি?’
‘বাসায় ভীষণ একা লাগে তোমায় ছাড়া।’
‘বিয়ে করে ফেলো আমায়।’
‘আরে আমি তো কিছুই করি না। আর তাছাড়া আমি তো ক’দিন পরই চলে যাব দেশের বাইরে।’
‘সমস্যা কোথায়? আমায় বিয়ে করে চলে যেও।’
‘উহু, সম্ভব না।’
‘কেন সম্ভব না?’

‘আমার বাসায় তোমাকে কেউ মেনে নিবে না।’
‘তোমার ফ্যামিলিকে একটু মানাও।’ আমার কথা শুনে ছেলেটা চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘তোমায় নিয়ে না আমার খুব স্বপ্ন ছিল ইরিত্রা।’
‘কি স্বপ্ন ছিল শুনি একটু?’
‘আমরা বিয়ে করব, আমাদের এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা হবে।’
‘ওরে ফাজিল রে! তলে তলে এত চিন্তাভাবনা!’ কথাটা বলেই ছেলেটার পিঠে দু’তিনটা কিল বসিয়ে দিলাম। ছেলেটা আমার কান্ড দেখে অনবরত হাসতে লাগল।
‘বাসায় চলো।’
‘হু, চলো।’
‘ম্যাডাম, ৩ঃ০০ টায় আপনার অপারেশন আছে না?’
‘হ্যাঁ, আছে। তুমি সবকিছু রেডি করো।’
‘জ্বি, ম্যাডাম।’

গতকাল রাতে ব্লাড ক্যান্সারে মারা যাওয়া ছেলেটার ডাইরি পড়ছিলাম। ছেলেটার নাম ফারাবী। পুরো ডাইরিটা জুড়ে শুধু একটাই নাম, ইরিত্রা। আজকে সকালে তার মৃতদেহ পরিবারের লোকজন বাসায় নিয়ে গেছে। যতদূর মনে হচ্ছে, ইরিত্রা ছিল ফারাবীর প্রিয়তমা।

সামান্য একটা ক্যান্সারের কারণে হারিয়ে গেল সত্যিকারের একটা ভালোবাসা। ডাইরিটা যতক্ষণ পড়ছিলাম ততক্ষণ চোখ দিয়ে শুধু পানিই পড়েছে। এখনও অনবরত পড়ছে। আচ্ছা, এভাবে আর কত ভালোবাসা সামান্য কিছু রোগের কাছে হেরে যাবে?? এমন করে আর কত ভালোবাসার গল্পগুলো শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যাবে অরণ্যের গহীনে?? জানা নেই আমার। আচ্ছা, এই ইরিত্রাটা কে?? মেয়েটা দেখতে কেমন?? বাসা কোথায়?? না, ইরিত্রাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। আমি তাদের গল্পটা শুনতে চাই। হ্যাঁ, পুরো গল্পটা শুনতে চাই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত