টুং করে যখন মেসেজ টোন টা বেজে উঠল তখন প্রায় শেষ বিকেল।
ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে ভোকাট্টা ঘুড়িটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি….শীতের মিষ্টি রোদ এসে পায়ের কাছে গড়াচ্ছে আমার।
আমি প্রবল এক ধরণের অনাসক্তি নিয়ে মেসেজ ওপেন করলাম “কাল বিকেলে আমার সাথে হাঁটতে যাওয়া যায়?
দুপাশে গাছের সারি থাকবে, বিকেলের শেষ আলোকে মিলিয়ে যেতে দেখাব তোমাকে…. যদি ইচ্ছে হয়, বলো!”
মেসেজ থেকে চোখ সরিয়ে আমি আবার কারেন্টের তারে লেগে থাকা কেটে পড়া ঘুড়িটার দিকে তাকালাম।
ঘুড়িটা আমার মত। একা, বিচ্ছিন্ন। মেসেজদাতার কথা ভেবে আমি খানিকটা অবাক হলাম।
পরিচয়ের এত অল্পদিনের মাথায় কেও দেখা করতে চাইবে এভাবে, ব্যাপারটা খানিকটা অদ্ভুত ঠেকল।
আজকাল সবাই ভার্চুয়াল জগতেই সম্পূর্ণ পরিচয়ের পাট চুকিয়ে নেয়। আরো বহুদূর গড়ালে তবেই দেখা হয়। তাও কেন দেখা হয় এটাও প্রশ্ন।
আমি উদাস ভঙ্গীতে রোদের দিকে আমার দুই পা আরেকটু এগিয়ে মেসেজ টাইপ করলাম “বিকেল ৪ টায়। কাল।”
*
সোনালু ফুল রঙা শাড়ি আর কপালে খয়েরি টিপ পড়ে যখন পিচের রাস্তায় হাঁটছি, তখন ও নিজেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছি আমি..
যার ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারেই জানিনা, দেখা হলে সৌজন্যের হাসি হাসা হয়, শুধু দূর থেকে এটুকু শুনেছি মানুষ হিসেবে ভাল..
এমন কারো সাথে আলাদাভাবে দেখা করতে কেন রাজী হলাম? আর হলাম যদিও! শাড়ি কেন পড়লাম! আমি তো এমন না!
স্বভাব বিরুদ্ধ কাজের পেছনে কারণ খুঁজতে খুঁজতে একসময় দেখলাম আমার সামনে গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবি পড়া তালঢেঙা একটা মানুষ দাঁড়ানো।
আমি ঘাঁড় বাঁকিয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বেশ সাবলীলভাবে একটা হাওয়াই মিঠাই আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল “তোমার মেঘ।”
আমি অবাক হলাম না। ফেসবুক টাইমলাইন মন দিয়ে ঘাঁটলেই এই খবর জানা যায় যে আমি হাওয়াই মিঠাইকে মেঘ বলি, বা বলতাম হয়ত!
টুকটাক কথায় হাঁটতে হাঁটতে যখন উঁচু উঁচু গাছগুলোর একদম চুড়ায় সূর্যের শেষ সোনালি আলোকে হারাতে দেখলাম,
তখন ও আমি শুনে যাচ্ছি না জানা সব তথ্য। যা মানুষ দিনের পর দিন মেসেজে জানে, ফোন কলে জানে…..
আমি পিচের রাস্তা ধরে যেতে যেতে জানলাম সেসব।
সন্ধ্যে হচ্ছে দেখে আমি যখন বিদায় জানাচ্ছি তখন সে হঠাৎ ডাকলো আমাকে।
“তুরিন?”
পেছন ফিরে তাকাতেই আমার মনে হল মানুষটা আমার খুব পরিচিত। খুব বেশি। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম তাকে আমি ঠিক কবে থেকে চিনি।
সে গলা খাঁকারি দিয়ে বেশ স্পষ্টভাবে বলল “আমি তোমার সাথে দেখা করতে কেন চেয়েছি তুমি একবার ও জিজ্ঞেস করনি।”
আমি একরাশ নিরাসক্তি নিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম। আমার কোন প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্নগুলো সব মরে গেছে বহু, বহু আগে।
মানুষটা কি বুঝতে পেরেছে এতক্ষণ যে সে কোন মৃত স্বত্বার পাশে হেঁটে গিয়েছে?
আমি শুনলাম সে বলছে, “কদিন আগে আমার খুব জ্বর ছিল। জ্বরের ঘোরে একা একা পড়ে আছি। হঠাৎ করে দেখলাম তুমি পাশে বসা।
বেশ ঝাড়ি দিলে জ্বর কেন হল এসব নিয়ে। তারপর জ্বর কমতেই আমি ভাবলাম তুমি কেন! তোমার সাথে তো পরিচয় ই নেই আমার।
কিন্তু এরপর ও তুমি আসো। প্রায় সময়। কেন আসো আমি জানিনা।”
কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি মুখে হাসি ধরে রাখলাম। রাস্তার সাদা হলুদ বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে এখন।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে আমি ছোট্ট করে বললাম.. “বড় বেশি দেরি করেছেন আসতে। আজ আমি আসি।”
*
বাসায় ফিরে আম্মুর হাতের চা ভর্তি মগ নিয়ে যখন বসেছি, দেখলাম আমার ফোনে বেশ কয়েকটা কল।
ফোন বন্ধ করে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। ল্যাপটপের ওয়ালপেপারে সাদা কালো ছবিতে লেখা “দহন আমার থাক, তোমার থাকুক শুধু বহন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একবার। ভালবাসতে ভুলে যাওয়া ভয়াবহ বিষয়।
হয়ত এই মানুষটা আমার হওয়ার কথা ছিল, হয়ত আমি এই মানুষটার জীবনে জড়ানোর কথা ছিল।
আরেকবার নিশ্বাস ফেলে আমি মুভির ফোল্ডারে ঢুকলাম। আমি আমার জীবনে কাওকে চাইনা। চাইছিনা। খুব অদ্ভুত বিষয়।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একসময় এই আমি ই পরজীবী জাতীয় ছিলাম। ভালবাসতাম আমিও কাওকে….
কি মনে হতে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলাম, যদি এই আঁধারে আমার ভোকাট্টা ঘুড়ি দেখা যায়!
ভোকাট্টা ঘুড়ির বদলে রাস্তার পাশের সোডিয়াম আলোয় সবুজ পাঞ্জাবি পড়া তালঢেঙা একজন মানুষ দেখলাম।
মানুষটা একটু পর পর তার চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছে। এই ঠান্ডায় তার গায়ে কোন চাদর নেই।
আমার খুব ইচ্ছে হল মানুষটাকে চিৎকার করে বলি আমার ও কারো হাত ধরতে ইচ্ছে হয়।
আমার ভেতরেও কেও একজন বলে চলেছে আমরা একে অপরের জন্যই সৃষ্টি হয়েছি…..
কিছুই না করে আমি জানলা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিলাম।
শীতের বাতাস আসছে খুব। আজকে মুভি দেখব সারা রাত। কাল ছুটি। আমি বড় আনন্দিত।