নামহীন সম্পর্ক

নামহীন সম্পর্ক

কিছুদিন হলো জীবন থেকে ঝরে পড়া কিছু স্মৃতির এলোমেলো ভাবনাগুলে মাথার মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে। কোনভাবেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না। বের করতে চাইলেই যেনো ওরা নিজেদের মত করে ওদের জায়গায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলায় ব্যস্ত হয়ে উঠছে। অযাচিত ভাবনাগুলোর তান্ডবে পারোমিতা অনুভব করলো মাথার মধ্যে চিনচিন করে ব্যাথা শুরু হচ্ছে। পারোমিতার এ ব্যাথা খুব চেনা। একটু বেশি ভাবনা চিন্তা করলেই ওর এই ব্যাথা শুরু হয়। পারোমিতা ব্যাথা উপশমের জন্য এক কাপ চা খাওয়ার জন্য রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

চা হাতে নিয়ে বেলকোনিতে এসে বসে পারোমিতা। জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ। বেশ ঠান্ডা। তবু বেলকোনিতে বসে চা না খেলে পারমিতার চলবে না। বেলকোনির একটা বিশেষত্ব আছে, ঝুলন্ত বেলকোনিতে নীল লাইট জ্বালিয়ে রাতে বসে চা খেতে আলাদা মজা পায় পারোমিতা। ওর মনে হয় চা খাওয়া মুহুর্তটুকু ও নীল আকাশের মাঝে অবস্থান করছে। আকাশের নীলে নিজেকে একটুকরো নীল প্রজাপতি মনে হয়। নীল প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলে আকাশের নীলগুলো যেনো বারবার ছুঁয়ে আসা যায়। ভাবতে গেলেই সমস্ত শরীরে এক অদ্ভুদ অনুভুতি অনুভব করে পারোমিতা।

সবে মাত্র একচমুক চা মুখে নিয়েছে ওমনি ফোন বেজে ওঠে। কিছুটা বিরক্ত নিয়ে চায়ের কাপ টি টেবিলে রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখে দেশের বাইরে থেকে কল এসেছে। দেশের বাহির থেকে কে তাকে কল করতে পারে! সাতপাঁচ ভেবে ফোন রিছিভ করে,

—-হ্যালো.. কে বলছেন?
—–হ্যালো।
—-কায়েস তুই!
—- এতগুলো বছরপর শুধু হ্যালো শব্দটুকুতেই আমাকে চিনতে পেরে গেলি!
—-কত বছর পর বলতো?
—-পাঁচ বছর তো হবেই।
—-মাত্র পাঁচ বছর তাতেই আশ্চয্য হয়ে গেলি অথচ যুগ যুগ পরও যদি তুই কল করতি তবু এই ছোট্ট শব্দেই চিনতে পারতাম।

—-তাই।
—-কেনো নয় বলতো!
—-তাহলে কেনো বলিস আমাকে ভালোবাসিস না।
—-কে বললো ভালোবাসি না? ভালোবাসার কি একটাই নাম হয় শুধু প্রেমিক প্রেমিকা!
—-তাহলে?
—-ভালোবাসা হয় প্রতিটা সম্পর্কে।
—–তাহলে তোর আর আমার সম্পর্কের নাম কি?
—–তা তো বলতে পারি না।
—আচ্ছা বাদ দে। তুই কেমন আছিস বল?
—- এখন খুব ভালো আছি। মনে হচ্ছে সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি।
—–আমারও মনে হচ্ছে সময়টা যেন হঠাৎ করই পঁচিশবছর পেছনে ফিরে গেছে। ছোট্ট তুই আমাকে শত বায়নায় অস্থির করে তুলেছিস, চোখের সামনে সব ভাসছে।

—-তাই।
—–হুম। জানিস প্রতিটা রাতে আমি ছোট বেলায় ফিরে যায়। তুই আমার গলা না জড়িয়ে কখনো ঘুমোতি না। তুই ঘুমিয়ে পড়লে তোর মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। তোর ঘুমুন্ত মুখখানা কি অপূর্ব সুন্দর ছিলো। এখনো প্রতিটা রাত তোর সেই মুখটা আমার মনে পড়ে যাই। কত সহজ সরল ছিলো সেই সম্পর্কগুলো।

—- আমিও খুব মিস করি ছোটবেলাকে। কেনো যে বড় হলাম আর তার সাথে জীবনের চাওয়া পাওয়া স্বপ্নগুলোও বদলে গেলো। জীবনের পূর্ণতাগুলো অপূর্নতায় ছেয়ে গেলো।

— কিছু ভালো লাগে না আমার। কেনো এভাবে আমরা একে অপরের থেকে দূরে সরে গেলাম বলতো।
—- দূরে সরে গিয়েছিস বলেই হয়তো বুঝতে পেরেছিস আমি তোর কতটা কাছের।
—– তুই সত্যি খুব বড় হয়েগেছিস।
—– তো কি ভেবেছিলি সেই আগের অবুঝ পারোমিতাই রয়েগেছি!
—– হুম। আমি তো কখনও ভাবি না তুই বড় হয়েগেছিস। আমার কাছে তো তুই সেই আমার ছোট্ট পুতুল বউ পারোমিতাই আছিস।

—– বউ!
—– আশ্চয্য হলি মনে হয়?
—– নাহ। আবারও নতুন করে মনে পড়ে গেলো তাই।
—-জানিস তুই যখন জন্মেছিলি সে কথাটা যখনই আমাদের কাছে এসে পৌছালো তখন নানাভাই আমাকে বলছিলো, কায়েস তোমার বউ হয়েছে চলো আমরা তাকে গিয়ে দেখে আসি। আমিও তখন অনেক ছোট ছিলাম। বউ কি তা বুঝতাম না। নানা আমাকে বুঝিয়েছিলো বউ হলো সর্বক্ষণের সাথী। তখন থেকেই তোকে আমার সকলে থেকে আলাদা মনে হতো। দিনের বেশির ভাগ সময় আমরা এক সাথে থাকতাম। আর তুই আমাকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারতি না। এমনকি রাতেও আমার সাথে ঘুমুনো চায়।

—-হুম। আমাকেও তো সবাই কায়েসের বউ বলে ডাকতো। আমিও মনে মনে নিজেকে তোর বউ ভাবতাম। হাহাহাহা…..

——হাসছিস যে?
—হাসি পেলো তাই।
—তুই হাসছিস আর আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। কেনো যে এমন হয়ে গেলো….
—-তুই নিজেই এমন করেছিস। জীবনের প্রথম ঠকা তো তুই ঠকিয়েছিস আমাকে। তাই তো সারাটা জীবন ঠকেই যাচ্ছি।

—-কি বলতে চাইছিস তুই?
—–না বোঝার কি হলো! পারিবারিক সমস্যার কারণে তুই আমাকে একা ফেলে চলে গেলি। নিজেকে খুব একা মনে হতো। একাকিত্ব ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করে চলেছিলো। জানিস আমি আজও ভেতর ভেতর বড্ড একা। তুই একা করে দিয়েছিলি জন্যই হয়তো কোনো সম্পর্কের বাঁধন আমায় বাঁধতে পারেনি।

—পারোমিতা….
—-কষ্ট পাচ্ছিস?
—— নারে বড্ড সুখ সুখ লাগছে।
—– কষ্ট পেয়ে কিছু লাভ নেই তাই কষ্ট পাস না।
—– কেনো লাভই কি নেই? আমরা কি পারি না সেই আগের মত হতে।
—- না পারি না। আগের আমরা কখনই হতে পারি না। পুতুল বর আর সত্যিকারের বরের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।

—-তাতে কি?
—–তাতেই সমস্যা। তুই যে আমার কাছে আজও সেই পুতুল বর হিসেবেই রয়ে গেছিস। বড় হয়েছি, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি তবু তোকে নিয়ে আমার ভাবনাগুলো ঠিক একি রকম রয়েগেছে। আমি জানি না তোর আর আমার সম্পর্কের কি নাম হয়।

—-পারোমিতা! তুই সারাটা জীবন এভাবেই আমাকে ফিরিয়ে দিবি?
—-ফিরিয়ে দেওয়ার কি আছে! আমি তো তোর আর আমার সম্পর্কটা কখনও অস্বীকার করিনি। তুই আমার যা তাই রয়ে গেছিস। শুধু তোর ভাবনাগুলোর বদল হয়েছে। তোর মনের মধ্যে আমাকে নিয়ে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব চলছে।

—— এটাই কি স্বাভাবিক না!
—-জানি না। ফুফা ফুফু এসেছিলো কেনো জানিস?
—–হুম। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলো।
—– শুধু ডাক্তার দেখাতে আসেনি।
—–তাহলে?
——ফুফা তোকে খুব ভালোবাসে জানতাম তবে এতটা জানতাম না।
—–সন্তানকে কে না ভালোবাসে বল!
—–তারপরও! আমি ফুফার চোখে পানি দেখেছি। তোর কষ্টগুলো ফুফাকে খুব ভাবায়। সে জন্যই হয়তো আমাকে তোর জীবনে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলো। আমাকে পেলেই তুই নাকি সুখী হবি। দাদার ওয়াদাও পূর্ণতা পাবে। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিলো একজন পিতার অসহায়ত্ব দেখে।

—–তুই কি বললি?
—-আমি আর কি বলবো বল! বললাম, ফুফা আমি খুব অসুস্থ তাছাড়া আমার জীবন সেই আগের জায়গায় নেই তাই আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। আপনি পছন্দ করে সুন্দরী মেয়ে দেখে ওকে বিয়ে দেন। আমার কথা শুনে ফুফা চিৎকার করে উঠে বলে, অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার হলে এতদিন বিয়ে দিয়ে দিতাম। তোর জন্য অপেক্ষা করতাম না। আরে তোর জন্মই হয়েছে আমার কায়েসের বউ হওয়ার জন্য। তোর দাদা আল্লাহর কাছে চেয়ে পৃথিবীতে এনেছে তোকে কায়েসের বউ করার জন্য অথচ তোর বিয়ে হয়ে গেলো অন্য জায়গায়। সেখানে ডিভোর্স হয়ে গেছে এখন তো কোনো বাঁধা নেই।

—–তারপর কি বললি তুই।
—-তবু না করে দিয়েছি। ফুফা খুব কষ্ট পেয়েছে। তবু হাল ছাড়েনি বুঝতে পারছি। তোকে আমার ফোন নাম্বার ঠিক পৌঁছে দিয়েছে। আসলে বাবারা সন্তানের সুখের জন্য সব পারে। ফুফার ধারণা তুই আমাকে পেলে দেশে ফিরে আসবি। দেখ দেশে ফিরে আসিস রিকুয়েস্ট রইলো। কায়েস তুই তো জানিস অযাচিত ভাবে আমার বিয়ে হয়েগেছিলো এক ভুল লোকের সাথে। ১৪ বছর পর মুক্তি পেয়েছি। এখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি। তবে কথায় আছে খারাপের মাঝেও কিছু ভালো থাকে। আমিও ভালো কিছু পেয়েছি। আমি এক সন্তানের মা হয়েছি। আমার ছেলেটা বেশ বড় হয়েগেছে। এবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে। আমি ওকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।

——তবু আমাকে পাশে নিবি না!
—-দেখ কায়েস আমি চাই আমাদের নামহীন সম্পর্কটাই অটুট থাক। “তোর জন্মই হয়েছে আমার কায়েসের বউ হওয়ার জন্য” ফুফার এ কথাটা আজ কদিন ধরে মাথারা মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তোর সাথে কথা বলে ভালো লাগছে।

—– তুই সারাজীবন একই রয়ে গেলি। তবে নামটা কিন্তু বেশ দিয়েছিস “নামহীন সম্পর্ক”। ভালো থাক তুই। পরে আবার কখনো কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ। পারোমিতা মাথা ব্যাথা অনেকটা কম অনুভব করছে। বেলকোনি থেকে রুমে এসে ঘুমন্ত ছেলের পাশে বসে মনে মনে ভাবে,তোকে নিয়েই আমি জীবনের বাকি পথ চলবো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত