জাসিয়া তারান্নুম নামে একটা মেয়ের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট আসলো হঠাৎ তপুর একাউন্টে। প্রোফাইল ঘেটে প্রথমে মনে হলো ফেইক একাউন্ট। কোনো ছবি দেয়া নেই৷ নায়িকা মেহজাবিনের ছবি দেয়া। প্রথমে মেহজাবিনের ছবি দেখে তপু ভেবেছিলো আসলেই হয়ত কোনো সুন্দরী মেয়ে তাকে রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। পরে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে বুঝতে পারলো এটা একটা নায়িকার ছবি। তপু ইগ্নোর করলো। দুই ঘন্টা পর মেয়েটা রিকুয়েষ্ট ক্যান্সেল করে আবার ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠালো৷ তপু আবার মনোযোগ দিয়ে মেয়েটার প্রোফাইল দেখলো। গত ছয় মাসে তপুকে কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে কি না সে বলতে পারছে না৷ হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো এই মেয়ের! সেই চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল তপু৷ ফেসবুকে মেয়ে মানুষের সাথে কথা হয়না বললেই চলে। রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করলো তপু। সাথে সাথেই মেয়েটার ম্যাসেজ৷
– রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করতে এতক্ষণ লাগে?
– কে আপনি?
– আমাকে আপনি চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।
মেয়েটাকে চেনার কোনো আগ্রহ দেখালো না তপু। হাতে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় গেল তপু। প্রতিদিন সকাল ন’টায় তপু বারান্দায় এসে এক কাপ চা খায়। অবশ্য উদ্দেশ্য যদিও অন্য কিছু। পাশের বাসায় অপ্সরীর মত দেখতে এক সুন্দরীর বসবাস। তপু সুন্দরের পুজারী না তবে এই মেয়েটাকে সে উপেক্ষাও করতে পারে না। আজ অবদি মেয়েটার সাথে একটা বাক্য কথাও বলতে পারেনি সে৷ খোঁজ লাগিয়ে শুধু নামটাই জানতে পেরেছে৷ মেয়েটার নাম ইরা। অবশ্য তপু এতটুকুতেই সন্তুষ্ট। বেশি গভীরে যেতে চাইলে হয়ত হিতের বিপরীত হতে পারে। আজ মেয়েটা বারান্দায় শুধু দু’মিনিটের জন্য এসেছিলো। চা শেষ করে তপু ঘরে গেল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে জাসিয়া তারান্নুম নামের মেয়েটি ম্যাসেজ দিতে দিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
– কি ব্যাপার এত ম্যাসেজ দিচ্ছেন কেন?
– কই ছিলেন আপনি?
– বারান্দায় ছিলাম।
– পাশের বাসায় কি কোনো সুন্দরী তরুণী আছে নাকি?
– আপনি এত কিছু জানতে চাচ্ছেন কেন? আপনার পরিচয় কি?
– পরিচয় না হয় পরেই দেই। আচ্ছা আপনি চা পছন্দ করেন নাকি কফি পছন্দ করেন?
– চা।
– আচ্ছা আপনি কি সবসময়ই কথা কম বলেন?
– হ্যাঁ। কথা কম বলা নবীজি’র সুন্নত।
– তো নিয়মিত নামাজ পড়েন?
– নিয়মিত পড়া হয় না।
– সুন্নত থেকেও কিন্তু ফরজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
– জানি। এখন একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো। যাই।
তপু আবার বারান্দায় ঢু মারলো কিন্তু ইরা নামক অপ্সরীর দেখা মিললো না বারান্দায়। তপু মন খারাপ করে বসে আছে। তপুর অবস্থা এমন হয়েছে যে মানুষটা চিৎকারের আওয়াজ সে শুনতে পায় না অথচ তারই নিরবতা সে শুনতে চায়। যে মানুষটা তার সাথে দেখাই দিতে চায় না সে আবার তার পিছে দৌড়ায়!
– আচ্ছা আপনি আমার সাথে দেখা করবেন?
– জ্বি না। আমি অপরিচিত মানুষের সাথে দেখা করি না।
– প্রতিদিন তো ঠিকই আমাকে দেখতে বারান্দায় হা করে বসে থাকেন।
– মানে? এই কে আপনি?
– জ্বি আপনি যার কথা ভাবছেন আমি সে-ই।
তপুর হাত কাঁপতে শুরু করলো। যে মেয়েটাকে একনজর না দেখতে তপুর দিন পানসে হয়ে যায় সে মেয়েটাই কি না তাকে দেখা করতে বলছে। যে মানুষটা চোখের কোণো লেপ্টে থাকা কাজলের মত তপুর অঙ্গে প্রত্যঙ্গে লেপ্টে আছে সেই মানুষটাকেই কি-না এতদিন অবহেলা করছিলো তপু। তপু রিপ্লাই করলো,
– সরি।
– সরি কেনো?
– আপনাকে আমি চিনতে পারিনি প্রথমে। আসলে আপনার পুরো নাম আমার জানা ছিলো না। আমি শুধু আপনার ডাক নামটাই জানতাম।
– জানা ছিলো না নাকি জানতে আগ্রহ হয়নি?
– আগ্রহ জমাতে চাইনি আমি। জানি আপনাকে আমি কখনোই পাবো না। তাই আপনাকে ভাবনার জগতেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। আমার আপনার আঁকা-বাঁকা দাতের মিষ্টি হাসিটা দেখলেই হলো।
– ভালোবাসেন?
প্রশ্নটা শুনে তপুর আঙ্গুল থমকে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর কি হওয়া উচিৎ? সে কি এক বাক্যে বলে দিবে যে হ্যাঁ “ভালোবাসি” নাকি ব্যক্তিত্ব খোয়ানোর ভয়ে চুপ থাকবে! এই যে রোজ নিয়ম করে বারান্দায় এসে মেয়েটাকে দেখে সে এতে তার আদৌও ব্যক্তিত্ব খোয়া যায়নি! সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তপু। কি বলবে ভেবে উঠতে পারছে না। এইদিকে প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মেয়েটা অনবরত ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে।
– এই যে আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি বারান্দায় আসেন। তপুর এই প্রথম বারান্দায় যেতে ভয় করছে৷ তাও কাঁপা কাঁপা পায়ে তপু বারান্দায় গেল। তপুর বারান্দা থেকে ইরার বারান্দা বেশি দূরে নয়। কথা বললে শুনা যায়। তপুকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে ইরা ডাক দিলো।
– এই যে লাজুক মানুষ! তপু কিছু বললো না। হাত ইশারায় হাই দিলো। ইরা তপুকে বলছে। ‘আপনি এত কম কথা বলেন কেন?’ তপু একটা মুচকি হাসি দিল। এবারও কিছু বললো না। ইরা বললো, ‘হাসছেন কেন?’ তপু হাত ইশারায় মোবাইল দেখতে বললো। ইরা এবার মোবাইলের দিকে তাকালো। তপুর ম্যাসেজ।
– আমার হাসতে ভালো লাগে।
– আমি শুনেছি যাদের হাসি সুন্দর তাদের নাকি কথাও সুন্দর।
– আপনি কথা বলতে অনেক বেশি পছন্দ করেন আর অনেক বেশি কথাও বলেন।
– জ্বি আর অনেক বেশি কথা শুনতেও পছন্দ করি। আচ্ছা আপনি কথা বলেন না কেন? আপনার নাম্বারটা দেন। সামনাসামনি না হয় লজ্জা পান ফোনে তো আর লজ্জা পাবেন না।
– আমি কোনো সিম ব্যবহার করি না। ওয়াই-ফাই দিয়ে ইন্টারনেট চালাই।
– ওমা সেটা কেমন কথা? কথা বলার ভয়ে সিম-ই ব্যবহার করেন না?
– না সেটা না৷ ব্যাপারটা অন্য কিছু।
– অন্য কিছু কি?
– ব্যক্তিগত সমস্যা। আপনাকে বলা যাবে না।
– আমি এত কিছু বুঝি না। আমাকে বলতে হবে। ইরা বাচ্চাদের মত জেদ ধরেছে। তপু পড়লো মহাসংকটে।
– কি হলো বলছেন না কেন?
– আচ্ছা আপনি যে তখন একটা প্রশ্ন করেছিলেন? সেই প্রশ্নের তো উত্তর দেয়া হয়নি।
– কথা ঘুরাচ্ছেন? ঠিক আছে ওই প্রশ্নেরই উত্তর দেন আগে৷
– আমি আপনাকে ভালোবাসি না।
ভালোবাসতে যোগ্যতা লাগে৷ ভালোবাসার মানুষের সমানে সমান হতে হয়৷ আমি কখনোই আপনার সমান হতে পারবো না৷ আপনি অপ্সরীর মত সুন্দরী। আপনাকে ভালোবাসার কোনো অধিকার আমার নেই। ভালো থাকবেন৷ আল্লাহ হাফেজ।
এই ছিলো ইরাকে দেয়া তপুর শেষ ম্যাসেজ। মনের মধ্যে কষ্টের পাহাড় জমে আছে তপুর। সেই কষ্টের পাহাড়ের শিখড়ে গিয়ে তপু ইরাকে ব্লক করে দিলো। তপু কথা বলতে পারে না। একজন বাকপ্রতিবন্ধী। তপু খুব ভালো করেই জানে সমাজে এমন মানুষদের জন্য শুধু অনুসূচনাই কাজ করে৷ এমন মানুষদের ভালোবাসা যায় না। এরা সবসময় অবহেলার স্বীকার হতে হতে এদের মাইন্ডসেট হয়ে গেছে যে তারা অন্যের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না৷ আর ইরা’কেও সেইসব মানুষদের কাতারে ফেলে দিলো তপু। আমি চাইলে গল্প এখানেই শেষ করে দিতে পারতাম কিন্তু তপুর শারীরিক এমন সমস্যার কথা শুনার পর ইরা কি করে সেটা দেখার খুব ইচ্ছে হলো। তাই তো হুট করেই ইরা’কে তপুর বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
এরপর ইরা বহুবার বারান্দায় আসলেও তপু আসেনি। তপুর পথ হয়ে গেছে ভিন্ন। ইরার সাথে যোগাযোগের সমস্ত পথ তপু বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু নাছোড়বান্দা ইরা কোনো উপায় না পেয়ে তপুর বাসায় চলে আসলো। তপুর মা ইরা’কে সব বলার পর ইরা ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে গেল। একটুপর কিছু না বলেই ইরা চলে গেল। যাওয়ার সময় তপুর নিষ্পাপ চেহারার দিকে ইরার চোখ পড়লো। অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়েও ইরা দাঁড়ালো না। এরপর কিছুদিন ইরা’কে আর দেখা গেল না। কিছুদিন বলতে বেশ অনেকদিন দেখা গেল না ইরা’কে।
এরপর প্রায় দু-মাসের ও বেশি কেটে গেল৷ ইরা’কে বারান্দায় বা মহাল্লার কোথাও দেখা গেল না। তপু ভেবেছিলো ইরা তার জীবন থেকে পালিয়েছে৷ মনের অজান্তেই নিজের প্রতি নিজেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। সে হাসি আরেকটু গাঢ় হলো যখন তার মা তাকে ইশারায় দরজা খুলতে বললো। সম্ভবত কেউ এসেছে। তাই হাসিটা আরেকটু চড়াও করে দরজা খুললো তপু। ইরা এসেছে। ইরার চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। ইরার হাসি দেখে তপু তার হাসি থামিয়ে ইরা’কে ইশারায় ভেতরে আসতে বললো। হঠাৎ তপু লক্ষ করলো ইরা সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলছে। ইরা ভেতরে আসতে চাচ্ছে না। তপুকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরতে চাচ্ছে! তপু ইশারায় বললো,
– এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি কথা বলতে পারিনা শুনে ভয়ে পালিয়েছেন? এখন কেনো এসেছেন এখানে?
ইরাও ইশারায় জবাব দিলো।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি চাইনি কমিউনিকেশন সমস্যার কারণে আমরা দুজন দুই মেরুতে চলে যাই। তাই দু-মাস ধরে সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখেছি আমি। তোমার সমস্যা স্থায়ী কিন্তু আমি তো চাইলেই তোমার মত করে তোমার সাথে কথা বলতে পারি৷ তোমার মত করে তোমাকে ভালোবাসতে পারি৷ ইরার এতগুলো কথার প্রত্যেকটা কথাই তপু খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে৷ তপুর চোখের কোণো হাল্কা জলের আবির্ভাব হয়েছে। ইরা তপুর চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, ” আমি তোমায় ভালোবাসবো তোমার মত করে,তুমি আমায় ভালোবেসো সারাজীবন ভরে”