আইডিটা তরী খুলেছিল দিন পনেরো আগে। ওর পুরো নাম তরী আহমেদ নন্দিনী। কাজে লাগানোর সময় এসেছে এবার। প্রোফাইল পিকচার কি দিবে ভাবতে ভাবতে নিজের ছবিকেই এডিট করল সে, এমন এডিট করলো যেন তাকে চেনাই যায় না, অথচ দারুণ নায়িকাদের মতো লাগছে তরী কে। সেটিই দিয়ে দিল প্রোফাইলে। অনেক ভেবে সুন্দর একটি স্মার্ট নাম দিল, “মেহেরজাবীন নন্দিনী।”
উদ্দেশ্য আর কিছুই না, ফেক আইডি দিয়ে নিজের রূপ আর গাদাগাদা স্ট্যাটাসের ছলনা দিয়ে ভার্সিটির নতুন ক্রাশ অপূর্ব আহমেদ হিমু কাছে নিজের ইমপ্রেশন্স একটু বাড়িয়ে নেয়া। অপূর্ব সেই লেভেলের স্মার্ট ছেলে, ফেসবুকের প্রচুর ফলোয়ার তাঁর, প্রতিটি আপলোডেড ছবিতেই লাইক-কমেন্টের হিড়িক পড়ে, মেয়েদের যেন কমেন্টেই ভাললাগা গড়াতে থাকে তাকে দেখে। তরী যেমন ই হোক দেখতে,কীন্তু এতো শত ভার্সিটির সুন্দরী ফোলোয়ার মাঝে যে অপূর্ব তরী কে পছন্দ করবেনা তা নিশ্চিত জেনেই এ ফেইক আইডি খোলা! বেশকিছুদিন ঝুলার পর অপূর্ব ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করার পরই তরী রীতিমত আনন্দে উড়ছে, কিন্তু নক দেয়ার মত সাহস সঞ্চয় করতে পারছেনা। আসলে ছোটবেলা থেকেই লাজুক স্বভাবের মেয়ে, নিজের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর সাথে অপূর্ব কে ইমপ্রেস করাও।
কিছুদিন পরে অপূর্বই নক করলো তরীকে ।সাথে সাথে রিপ্লাই দিল তরী। এভাবে হাইহ্যালো করতে করতে বেশ ভালই কথাবার্তা বলতে লাগল। বলতে বলতেই অপূর্ব তরী র সুদর্শন চেহারার খুব প্রশংসা করলো। তরী এবার যেন আকাশে ওড়া শুরু করবে! কিছুদিন কথা বলতে বলতে অপূর্ব আর তরী বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে বেশ স্মার্ট এই ছেলেটিকে সেতো আগেই পছন্দ করেছে,এখন একটু আধটু ভালোবেসে ফেলেছে। এই ছেলে শুধু দেখতে ভাল তা না, কথাবার্তা কত সুন্দর। অথচ তরী যেন কথাই বলতে জানেনা।
ফেবু থেকে দুুজনের ভালো পরিিচয় আর এক ভার্সিটির হওয়াই গল্প আড্ডা যেন জমে ক্ষীর। অপূর্ব দেখা করার কথা যতই বলে, তরী যেন ততই পিছায়। এখন মাঝে মাঝে তরীর সন্দেহ হয়, আচ্ছা অপূর্ব কি ধরে ফেলেছে? সত্যিটা কি বলে দিব? তরীর চেহারা ততটা সুন্দর নয় যতটা না প্রোফাইলে, কিন্তু এতদিনের চেনাজানা এতো কথা বলা সবই কী বৃথা! অনেক ভেবেচিন্তে দেখা করার কথা চিন্তা করলো তরী। জায়গাও সেট হলো, কাছের একটি রেস্তোরাঁয়।
এবার মনের আনন্দে আইডি এক্টিভ করে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো তরী। “সকালসকাল সাজুগুজু করে ফিটফাট হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো তরী। অপূর্ব কে বলার জন্য ঠিক করা কথাগুলো যতবার মুখস্থ করেেেছে, এতবার যদি ক্লাসের পড়া মুখস্থ করতো তাহলে ভার্সিটির একমাত্র নামকরা স্টুডেন্ট ও ই থাকতো মনে হয়। রেস্টুরেন্টে ঢুকল। ঘড়িতে বাজে সকাল ১১.২৫। তরী আসার কথা ১১টায়। অপূর্ব খুব পাংচুয়াল ছেলে, দেরী হওয়ায় কি রাগ করে চলে গেল? ভয়পেতে লাগল তরী।
আরো ৩০মিনিট অপেক্ষা করে আর সহ্য হলো না। কারণ ততক্ষণ অবধি অপূর্বের দেখা মেলেনি ! তরী এবার বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলো, অপূর্ব নামের কেউ এসেছে কিনা। ম্যানেজার বলল, সে সকাল ১১টা নাগাদ একজন ভদ্র লোক এসেছে , বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাহিরে তাকাতে না তাকাতেই, কিছু একটা দেখে প্রচুর রেগে গিয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে কোথায় যেন চলে গেছেন। বুকটা ধক করে উঠল তরীীর।কি এমন দেখলো যে অপূর্ব এ ভাবে চলে গেল??আর কিছুক্ষণ থাকলে কি এমন হতো! আচ্ছা আপনি লোকটাকে দেখেছেন?
‘হ্যাঁ ম্যাাম। মটামটি লম্বা, ভদ্র, সুন্দর ফেসকাটিং, তবে মুখে চাপদাড়ি আছে’ এ কথা শুনে মাথা ঘুুুুড়তে লাগল তরী র।কারণ বিবরণ অনুযায়ী এ ছেলেটি অপূর্ব ছিল। এরপর , মোবাইলের ডাটা অন করতে না করতেই অপূর্ব র বিশাল সেড ইমুজি মার্কা মেসেজ পেল তরী। যা লেখা ছিল-তুমি এতো বেইমান আমার সামনেই আমাকে ছেড়ে অন্য ছেলের সাথে ডেটিং করতে পারলে? ছিহ্, আমি চললাম আর কোনদিন যোগাযোগই করবা না। তরীর ভাবনায় ছেদ পড়লো অপূর্বের মেসেজ দেখে ,আর ভাবলো এ কি করে সম্ভব? রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে তরী সামনে এগোতে ই দেখলো-তরীর মতোই একটা মেয়ে হাঁটছে ঠিক যেমনটা তরীর ফেইক আইডির ছবিটার মতো। মেয়েটির সাথে আছে অন্য একটি ছেলে।
তরীর বুঝতে বাকি রইল না আর কিছুই। অপূর্ব কে এভাবে একধাক্কায় হারিয়ে ফেলার শোকে কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেল তরী,তা সে নিজেও জানে না। জ্ঞান ফেরার পর তাকিয়ে দেখলো তরী তার শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে,আর তার মাথার পাশেই তার লেপটপের স্ক্রিনে ফেইক আইডি “মেহেরজাবীন নন্দিনী”এক্টিভ হয়ে আছে। তরী এতক্ষণে বুঝতে পারলো এটা তার বিষ্ফোরিত স্বপ্ন ছিল। একটু আগে যা যা ঘটেছে সব ছিল তার ভ্রম! বিছানা ছেড়ে অনেকক্ষণ বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে থাকার পর সোজা রুমে এসে লেপটপ নিয়ে বসল তরী।আর তার ফেইক আইডি থেকে অপূর্ব কে মেসেজ করে সব সত্যিকথা বলে দিয়ে আইডি টা ডিএক্টিভ করে দেয়।
সে বুঝতে পারলো কাউকে পছন্দ বা ভালবাসা করা ভাল,কীন্তু নিজেকে প্রযুক্তির অপব্যবহার+ ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করে সং সাজানো মানে হয়না,এতে কারো ইমোশন নিয়ে খেলাতো হয় সাথে নিজের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। মন থেকে চাওয়া জিনিসগুলো যদি একান্ত সর্বত্র সত্যি হয়,তবে তা একদিন না একদিন ঠিক পাবেই। 1.5year later আজ তরীর বিয়ে ,আর তার সহধর্মী কে হবে জানেন? সে হলো সেই ভার্সিটির নতুন ক্রাশ অপূর্ব।
সেদিনের ফেইক আইডির শেষ মেসেজ দেখে তরীর উপর প্রচন্ড রাগ ও ক্ষোভ হয়েছিল অপূর্বের। তরী এভাবে এমন টা না করলেও পাড়তো। কিন্তু দিনশেষে সেই মেহেরজাবীন নন্দিনীকেই মিস করতো সে। আস্তে আস্তে অপূর্ব বুঝতে পারলো,এট্রাক্টিভ, স্মার্ট, সুন্দরী আসবে যাবে জীবনে অনেক,কীন্তু হুট করে আসা সাধারণ রঙ্গিন ফিলিং গুলো কখনো তার তারতম্য হাড়ায় না বরং সে আরো অসাধারণ হয়। আর সে অসাধারণ তারতম্য খুঁজে পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অপূর্বের। সেদিনের সেই কাঠখড় পোড়ানোর ত্যাগের বিনিময়ের প্রাপ্তি হল আজকের বিয়ে।আর এটাই হলো জীবনের বিশেষ পূর্ণতা।