আমি যখন সবেমাত্র চাকুরিতে জয়েন করেছি,ঠিক তখনই আম্মার জোড়াজুড়ি তে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার পড়ুয়া একটা মেয়েকে।আমি নিজেই শুরুতে বিষয়টা মেনে নেইনি কিন্তু আম্মা যখন আমার বিয়ের জন্য নাওয়া খাওয়া ছাড়লেন তখন বাধ্য হয়েছিলাম বিয়েতে রাজী হতে।আম্মা সেবার শীতে গ্রামের কোন এক বান্ধুবীর বাসায় বেড়াতে গেলেন আমিও কোন আপত্তি করিনি কিন্তু সেখানে গিয়েই যত বিপত্তি বাধিয়েছেন। আম্মার সেই একমাত্র বান্ধুবীর মেয়েকেই তার মনে ধরেছে একমাত্র বউ মা হিসেবে।কিন্তু বিপত্তি টা বাধলো অন্য জায়গায় দুজনের বয়সের ব্যবধান কম করে হলেও ছয় থেকে সাত বছর হবে পাশাপাশি মেয়েটির কাছে দুনিয়াটা কেবলমাত্র উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে আর আম্মা কিনা সেই মেয়েটাকেই বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাচ্ছেন। তাছাড়া আমি নিজেও এই বয়সের গ্যাপ টা কোনভাবেই চাইনা।
দুইটা মানুষের মন দুটোই যদি দুই মেরুর হয় তাহলে সংসার নামক জিনিসটা স্রেফ মানিয়ে নেয়া ছাড়া আর কিছুই না।তাছাড়া আজকাল পেপার পত্রিকা খুললেই পরকীয়া, খুন এসব দেখেই কলিজা শুকিয়ে যায় কিন্তু আম্মাকে কিছুতেই কিছু বোঝাতে পারিনি। আম্মার এক জবাব তোর আব্বার সাথেও তো আমার বয়সের অনেক ফারাক ছিল। কই আমি আর তোর আব্বাও তো সুখেই আছি। তাহলে তোর এত সমস্যা কিসের?? সত্যি বলতে আমি মাঝেমাঝে নিজেও অবাক হয়ে যেতাম আব্বা আম্মার কাহিনী দেখে।বাহিরে আব্বা একজন বাঘা গনিতের শিক্ষক, ছাত্ররা আব্বার মার খাওয়ার ভয়ে ডাবল প্যান্ট পরে যেত।আমি নিজেও বহুবার ডাবল প্যান্ট পড়ে গেছি কিন্তু সেই মানুষটাই বাড়িতে ফিরলে আম্মার সামনে চুপচাপ হয়ে যেত।আম্মার হ্যা তে হ্যা বলে যেত আর না তে না।
আমার বিয়ের বিষয়েও আব্বার পলিসিটাও ঠিক তাই আম্মা বলছে মানে আমাকে বিয়ে করতেই হবে।মেয়েটির নাম ছিল মিলিআম্মার সিদ্ধান্ত মেনে মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ওদের এলাকার একটা পার্কে।গিয়ে দেখি মিলি আগেই হাজির।আম্মা আমাকে আমাকে আগেই মেয়ের ছবি দেখানোর পাশাপাশি ফোন নাম্বারটাও দিয়েছিলেন যাতে কোন উল্টাপাল্টা না করি।চেহারা দেখেই চিনে ফেলেছি তাও ফোন দিলাম কনফার্ম হওয়ার জন্য।দেখলাম মিলি ফোন উঠালো। ফোন কেটে দিয়ে মিলির সামনে গিয়ে দাড়িয়ে জিজ্ঞাস করলাম মিলি?মিলি উল্টা প্রশ্ন করলো, “আপনি নিশ্চয়ই পরাগ?” আমি হুম বললাম মিলি বেঞ্চটার একপাশে সরে গিয়ে আমাদের বসার জায়গা দিলো।
আমি কিছু বলার আগেই মিলি বলল,”আপনার নিশ্চয় কোন জি এফ নেই আর থাকলেও ভুলে যান কারন আন্টির কাছ থেকে আগেই আমি অধিকার নিয়ে নিছি।”এবার বুঝলাম আম্মা আমারে সোজা করার জন্য এই মেয়ের পাল্লায় ফেলছে।আমি মিলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আমার মধ্যে কি এমন দেখলেন যে বিয়ে করার জন্য এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলেন?” তাছাড়া আপনি দেখতে শুনতেও যথেষ্ট সুন্দর আমার তুলনায়।” উত্তরে মিলি যা বলেছিলো শুনে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করার সাহস হয়নি আমার।উত্তরটা ছিলো এইরকম যে “শুনেন আপনার মধ্যে এমন আহামরি কিছু নেই যে আপনাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হবো। আন্টিরে শ্বাশুড়ি মা হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।নিজেরে এতো বড় ভাবার কিছুই নেই।চুপচাপ উঠে চলে আসছিলাম হঠাত মিলি পিছন থেকে বলে উঠলো, ” এইযে শুনুন আপনি তো দেখি আদব কায়দা কিছুই জানেন না।
একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে এসে তাকে একা রেখেই চলে যাচ্ছেন।আমি পিছনে ঘুরে বললাম, “তা আমাকে এখন কি করতে হবে? ” “রিক্সা ডেকে নিয়ে এসে আসেন।” মিলির কথামতো রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে বললাম,”এবার তো যেতে পারি নাকি।”মিলি চোখ দুটো ছোট করে বলল তাড়াতাড়ি ভাড়া দিয়ে দেন।কোন মেয়ের সাথে দেখা করতে আসলে যে ভাড়াটা দিয়ে দিতে হয় এটাও জানেন না।আমি চুপচাপ ভাড়াটা দিয়ে কেটে পড়লাম।ভাবছি আম্মা আমাকে ভদ্র বানানোর জন্য যে পরিকল্পনা করছে ভুলেও সেই ফাদে পা দেয়া যাবেনা। কিছু একটা বলে কেটে পড়তে হবে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই আম্মাকে বল্লাম,”আম্মা মেয়ে আমার পছন্দ হয়নি”আম্মাও যেন রেডি ছিলেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠার জন্য।চিল্লিয়ে বলা শুরু করলেন,তা পছন্দ হবে কেন?তোমার তো পছন্দ ওইজে হাতকাটা জামা পড়া ওড়না ছাড়া মেয়ে।শোন বাপধন যতই চাপাচাপি করো বিয়ে তোমার মিলি মামনিকেই করতে হবে।শুনে মেজাজ গরম করে বের হলাম বাসা থেকে।আম্মাও পেছন থেকে বলে উঠলো, “যাচ্ছো যাও, তোমাদের বাপ ছেলের দৌড় আমার জানা আছে।বিয়েতে রাজি হলেই কেবলমাত্র এই বাড়ি মুখী হবা নইলে এমুখো হওয়ার আশা বাদ দাও।” স্বর্গীয় নানাজানরে ইচ্ছামতো ঝাড়লাম ইচ্ছামতো এইরকম একপিছ প্রোডাক্ট তৈরি করার জন্য।আড্ডা দেয়ার জন্য বন্ধুদের ফোন দেয়া শুরু করলাম।
দুইজনে ফোন ধরে বলল, মামা মাফ কর,এই কুত্তামারা শীতের রাতের মধ্যে বের হইতে পারবোনা।বিবাহিত এক বন্ধুরে ফোন দিলাম।সেই হালায় ফোন রিসিভ করে আপনি যে নাম্বারে ফোন দিয়েছেন তা ব্যস্ত আছে বলে কেটে দিল।মেজাজ পুরাই গরম তারপর আবার কাল অফিস আছে।সিদ্ধান্ত নিলাম যা আছে কপালে তাই হবে।বাড়ি ফিরতে দেখেই আম্মার মুখে ফিলিপ্সের একশো ওয়াটের এনার্জি বাল্ব জ্বলে উঠলো।হাসিমুখে খাবার দিলেন।আমিও চুপচাপ খাবার খেয়ে রুমে ঘুমাতে চলে গেলাম।পরের দিন থেকেই মিলির নাম্বার থেকে সময় অসময়ে ফোন আসা শুরু হলো।ফোন দিয়েই কথার বন্যা বইয়ে দিতে শুরু করতো।প্রথম প্রথম বিরক্তি আসলেও আস্তে আস্তে ফোন না আসলেই যেন অসস্তি টা বেড়ে যেত।
নির্দিষ্ট দিনে দুই পরিবারের একটা ছোট খাটো অনুষ্টানের মধ্যে দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।যদিও মিলির সাথে ফ্রি হতে অনেক সময় লেগেছিলো।আর সত্যি বলতে আমি প্রেম করার মতো কোন প্রডাক্ট ও ছিলাম না। ক্লাস নাইনে সমবয়সী এক ক্লাস মেট কে ভালো লাগতো। পরে শুনি তার বি এফ ভার্সিটি তে পড়ে।এই কঠিন শোক পাওয়ার পর আর জীবনেও ওই পথে যাইনি। মিলিও মনে হয় বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল।তাই আমার থেকে আমার পরিবারকেই বেশি আপন করে নিয়েছিল বেশি।রোজ অফিস শেষে ফিরে যখন দেখতাম শ্বাশুড়ি বউমা মিলি চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে তখন বুক থেকে একটা পাথর নেমে যেত।সন্ধ্যা হলেই ছোট বোনটার সাথে লুডো খেলতে বসে যেত।সবমিলিয়ে নতুন কেউ এসে চিনতেই পারবেনা এটা নতুন বউ।ভাববে হয়তো এবাড়িরই মেয়ে।
মাস খানেক এভাবেই গেল। কিন্তু এভাবে আর কত।সকাল হলেই বিছানায় অফিস যাওয়ার আগে সব রেডি পেতাম,আমার মন জয় করার জন্য সকাল বিকাল শাড়ি চেঞ্জ করতো তবুও প্রশংসা না পেয়ে মুখটা এইটুকু করে রাখতো।রাত হলেই চলেন না একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি, অনেক বড় চাদ উঠেছে আজ।ইচ্ছা হলে বেলকোনী দিয়ে দেখো বলে কথা কেটে ঘুমিয়ে পড়তাম।কতশত ছোট ছোট আব্দার করতো।পূরন করার চেস্টাই করিনি।একই ছাদের নিচেই দুইটা মানুষ থাকা সত্ত্বেও মনে হতো আমরা যেন আলাদা দুনিয়ার মানুষ।এভাবেই চলছিল।
মাস দুয়েক পর আমার ফোনে একটা মেয়ে কলিগ ফোন দিয়েছিলো।আমি তখন গোসলে ছিলাম। মিলি ফোন ধরেই মেয়েলি কন্ঠ শুনে কেটে দিয়েছে।আমি বের হতেই আমার টিশার্টের কলার চেপে ধরে বলা শুরু করলো বলেন কে এই মেয়ে?আপনার সাথে কিসের সম্পর্ক।অফিসের ঝামেলায় এমনিতেই মন খারাপ ছিল।পুরো রাগটা এসে পড়লো মিলির উপর।ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় দিলাম। বেঘাতে ঠোটে লেগে কেটে দিয়ে রক্ত পড়া শুরু করেছে।চিল্লাপাল্লা শুনে আব্বু আম্মা এসে এই অবস্থা দেখে আম্মা মিলিকে নিয়ে গেল উনার রুমে।আব্বা খানিক বকাঝকা করলেন।সেরাতে মিলি আর ঘরে আসলো না।হয়ত আম্মা বা ছোট বোনটার সাথে ঘুমিয়েছিল।পরেরদিন সকালে উঠে দেখি অফিসের কিচ্ছু রেডি নেই তবুও চুপচাপ সবকিছু খুজে নিয়ে অফিস যেতেই আধা ঘন্টা লেট।অফিস শেষে বাড়ি ফিরে মিলিকে না দেখে ছোট বোনটারে জিজ্ঞাস করলাম মিলি কই।
ছোট বোন বাপের বাড়ি গেছে বলে চলে গেল।বাড়ির সবাই যেন আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো।কি আজব আজ রাতে কেউ বললনা চলেন আজকে একটু ছাদে যাই কিন্তু আমার খুব যেতে ইচ্ছা করছে।দুইদিন এভাবেই গেল।সবকিছু দুর্বিষহ লাগছিলো সিদ্ধান্ত নিলাম মিলির কাছেই যাবো।অফিস শেষে সোজা শ্বশুর বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে দাড়ালয়াম।বাসায় ঢুকার সাহস হচ্ছেনা।এখান থেকে মিলির রুমটার জানালা বেশ দেখা যায়। সাহস করে মিলিকে ফোন দিলাম।ফোন রিসিভ করতেই বললাম দরজা খুলো আমি তোমাদের বাসার সামনে।মিলি এসে দরজা খুলে চুপচাপ চলে গেল।সদা হাস্যজ্জ্বল মেয়েটা তিন দিনেই চোখের নিচে কালি জমিয়ে ফেলছে।শাশুড়ী আম্মা র সাথে কুশলাদি বিনিময় করে সরাসরি মিলির রুমে গিয়ে হাজির হলাম।দেখি উনি বেলকোনীতে দাড়িয়ে আছেন।
পিছন থেকে আস্তে করে কাধে হাত রাখলাম। প্রথমবার ছিটকে সরিয়ে দিলেও পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এক নাগাড়ে জমিয়ে রাখা সবকিছু খুলে বললাম পচা জামাইটাকে কি আরেকটা সুযোগ দেয়া যায়??মিলি সামনে ঘুরেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,”আবার যদি কাদাইছেন পাজি ছেলে দেইখেন কি করি।”মিলিকে বললাম ব্যাগ গুছাও।মিলি সবকিছু রেডি করে আম্মার কাছে গেলাম দুজনে।আম্মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলেন,”সেকি বাবা আজকেই বিয়ের পর প্রথম এলে না খেয়েই চলে যাবে?”মিলি উত্তর দিলো,”দুইদিন অনেক খাইছি অন্য আরেকদিন এসে খাবো বলেই আমার একহাতে ব্যাগ দিয়ে অন্য হাত ধরে হাটা শুরু করলো।রিক্সা চলছে গ্রামের রাস্তায়।
মিলি আমার কাধে মাথা রেখে শক্ত করে হাতটা জড়িয়ে ধরে আছে।হালকা বাতাসে মিলি কেপে কেপে উঠছে দেখে ব্যাগ থেকে চাদরটা বের করে জড়িয়ে নিলাম গায়ের সাথে।জোসনা উঠছে আকাশে পাশাপাশি আমার পাশেও একটা জোসনা নিয়ে যাচ্ছি।আসছি আর ভাবছি স্বামী স্ত্রীর বন্ধন মনে হয় এমনই হয়।যেখানে ছোট ঝগড়া ঝাটি, বয়স এসব বাহ্যিক বিষয় কোন ফ্যাক্ট হিসেবেই কাজ করেনা। দুই একটা সরিতেই যেখানে সম্পুর্কটাকে নতুন মাত্রা দেয়া যায়, সেখানে মানুষ কেন ইগো দেখিয়ে বন্ধন গুলোকে হালকা করে? মনে বলছি, “বালিকা তোমায় ভালোবেসে বাশে বাশময় হইতেও রাজি আছি, তবুও বালিকা তোমায় ভালোবাসি।”