ইদানীং বউ ঘনঘন ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করছে। সকালে একটা, বিকেলে একটা আবার রাতে অন্যটা।আমি বললাম, কাহিনি কী বউ?ঘন ঘন প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করছো কেন? তুমি তো আর সিনেমার নায়িকা না!!
বউ মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, আমি তো আর তোমার মতো অকর্মার ঢেঁকি না,আমার কাজের পিছনে নিশ্চয়ই কারন আছে। ফ্যান ফলোয়ার বাড়াচ্ছি! আমি বললাম, এমনিতেই তো তোমার প্রোফাইলে ফ্যান ফলোয়ারের বন্যা বয়ে যাচ্ছে! যেই ছবিই আপলোড দিচ্ছ,সাথে সাথে হিট! লাইক কমেন্ট তুফানের মতো ছুটে আসছে!! আরও চাই। আরও! আমি সেলিব্রিটি হতে চাই!! শুধু ফেসবুকে ছবি আপলোড দিয়ে সেলিব্রিটি হয়ে যাবে! হাউ ফানি! জরিনার নানি!!
দূর গাধা! শুধু ছবি হবে কেন? এখন লোকজনের কাছে পরিচিত হচ্ছি। বইমেলায় বই বের করবো। আমি বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, কী বের করবে?? আরে হাদারাম! বই বের করবো বই।শুধু আমার ফ্যান ফলোয়ার আমার বই কিনলেই দেখবা বইমেলায় হৈচৈ পড়ে যাবে!!আমি হয়ে যাবো বিখ্যাত সেলিব্রিটি!!! আমি আধা ঘণ্টা ঝিম মেরে বসে রইলাম! হায় হায়! আমার বউ লিখবে বই? যে মহিলা বাজারের ফর্দ ঠিক মতো বানান করে লিখতে জানে না, সে লিখবে বই!!!
একদিন সত্যি সত্যি সে ফেসবুকে একটা স্টাটাস দিয়ে লিখলো, হাই বন্ধুরা তোমরা কেমন আছো? তোমাদের জন্য একটা সুখবর নিয়ে এসেছি । আগামী বইমেলায় আমি আসছি তোমাদের জন্য একটা অসাধারণ বই নিয়ে। তোমরা আমার সাথে থাকবে তো? লাইক কমেন্টের বন্যা শুরু হয়ে গেল। এক ঘন্টায় কয়েক,শ কমেন্ট পড়লো।এক ছাগল লিখলো,আমরা আছি মানে? ম্যাডাম, আপনি বই বের করুন, বিক্রি করার দায়িত্ব আমাদের! বই দিয়ে মহামারী করে ফেলবো না??
আরেক ছাগল লিখলো, ম্যাডাম, আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি আপনার বই এই মেলায় দারুণ হিট খেয়ে যাবে! লোকজন পঙপালের মতো ছুটে এসে আপনার বই কিনবে!! অন্য এক রামপঠা লিখলো, চোখের ঘুম তো হারাম করে দিলেন! খালি ভাবছি,ম্যাডামের বই কবে বের হবে! নিশ্চিত থাকেন ম্যাডাম,আপনার বই হবে মেলার বেস্টসেলার!! তরতরিয়ে বউয়ের ফ্যান ফলোয়ার বাড়ছে। কয়েক মাসে আমার চেয়ে বউয়ের ফ্যান ফলোয়ার হাজার গুন বেশি!
ফেসবুকে লেখালেখি করি। কেউ পাত্তা দেয় না।সারাদিন কষ্ট করে লিখে নামমাত্র কয়েকটা লাইক কমেন্ট পাই।যে কয়েকটা কমেন্ট পাই, বেশির ভাগ গালাগালি! একদিন এক পাঠক লিখলো,প্রোফাইল পিকচার দেখে তো মনে হয় হনুমানের মতো চেহারা! এই চেহারা নিয়ে লেখক হলেন কেমনে?রিকশা ভ্যান গাড়িওয়ালা হলে বেশ মানাতো!!
পাঠক মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয়,আমি যদি লেখালেখির পিছনে সময় ব্যয় না করে সেই সময়টা ছাগল চড়াতাম, তাহলে ভালো রাখাল হতে পারতাম!! একদিন বউ এসে বললো, কী বই লেখা যায়,বল তো? গল্প, উপন্যাস নাকি কবিতা? লেখ যা খুশি। বই যে লিখবে, প্রকাশক পাবে কোথায়? কে তোমার বই প্রকাশ করবে? আমি কি তোমার মতো ঘাস খাওয়া বলদ? প্রকাশক অলরেডি আমার পিছনে লাইন দিতে শুরু করেছে!
বলে কি! প্রকাশক লাইন দিয়েছে মানে? আমি শালা সারাজীবন প্রকাশকের পিছনে ঘুরে একটা বই বের করতে পারলাম না! আমি বললাম, দেখ বউ,জীবনে তো গল্প কবিতা দুই লাইন লিখে দেখনি,সারাদিন তো রূপচর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাক! লিখবেটা কী??? আমার হয়ে কয়টা কবিতা লিখে দাও না! আজকাল তো কবিতার বই ভালোই হিট খাচ্ছে!! মাথা খারাপ! আমার পেটে এটম বোম মারলেও দুই লাইন কবিতা বের হবে না!গল্প লেখাও সম্ভব না। আমি গল্প লিখলে লোকজন বকা দেয়!!
বউ হতাশ হয়ে বললো, তাহলে কি আবার বই বের হবে না! আমি সেলিব্রিটি হতে পারবো না!প্রকাশককে কি বলবো? এক কাজ কর,রূপচর্চার উপর একটা বই লিখে ফেল। আজকাল এই জাতীয় বই হেভি চলছে। তোমার কিছুই করতে হবে না, শুধু প্রতিদিন কীভাবে রূপচর্চা কর তার বর্ননা লিখে যাও,ওতেই কাজ হবে। গুড আইডিয়া! ভালো বুদ্ধি দিয়েছো! হায় আল্লাহ! এই বুদ্ধি আমার মাথায় আসেনি কেন???
বউ তক্ষুনি দৌড়ে চলে গেল বই লিখতে! একদিন শালী ফোন দিয়ে বললো, দুলাভাই, আপা নাকি বই লিখছে? আমি হতাশ গলায় বললাম, তাই তো দেখছি! সে আবার কী বই লিখবে? সে তো এসএসসিতে বাংলায়ই ফেল করেছিল! ওকে আদা লিখতে বললে গাধা লিখে বসে থাকতো!!ওর মাথায় এই ভূত চাপলো কীভাবে? জানি না রে বোন ! বইমেলার আগে আগে বউ বললো, বই লেখা শেষ। কি নাম দেওয়া যায় বল তো?
যেহেতু রুপচর্চা নিয়ে লিখেছো, এই জাতীয় একটা নাম দিয়ে দাও। ‘আয় রুপচর্চা করি’ নামটা কেমন হবে বলো তো? একটা অন্য রকম ভাব আছে না নামটার মধ্যে ? তা অবশ্য আছে। কথা হচ্ছে এই বই কে কিনবে? তোমার তো পুরুষ ফলোয়ার বেশি।লিখেছো তো রূপচর্চা বই।পুরুষ এই বই কিনবে? আরে কি বল! এখন পুরুষরাও লাইন দিয়ে রূপচর্চা করে! তুমি দেখ, এই বই বেস্টসেলার হবে। বউ কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে বইয়ের বিজ্ঞাপন চালিয়ে গেলো। একদিন শুনলাম দ্বিতীয় এডিশন চলছে!
প্রকাশককে ফোন দিয়ে বললাম, ভাই এখনো মেলা শুরু হয়নি, এরই মধ্যে দ্বিতীয় এডিশন আসলো কীভাবে? আপনারা তো দেখি ফাটিয়ে দিয়েছেন! এরিমধ্যে প্রথম এডিশন শেষ? ধুর মিয়া! প্রথম এডিশন বের করলে তো!! আমরা শুরুই করেছি দ্বিতীয় এডিশন থেকে!!! আমি অতি নিরীহ গলায় বললাম, ভাই, আমার একটা বই বের করা যায় না? আমি তো অনেক দিন যাবৎ লেখালেখি করি,,,, দূর মিয়া! আমরা আজেবাজে লেখকের লেখা ছাপি না।আমরা আগে লেখকের কোয়ালিটি দেখি! নিজের অজান্তেই বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো!
এক সপ্তাহ পর আবার বিজ্ঞাপন দেখলাম, দ্বিতীয় এডিশন শেষের পথে। প্রকাশক বিজ্ঞাপন দিয়েছে, বন্ধুরা, ‘আয় রূপচর্চা করি’ বইয়ের দ্বিতীয় এডিশন শেষের পথে। অনলাইনে প্রচুর পাঠক অর্ডার করছেন।আর কয়েকটি বই মাত্র অবশিষ্ট আছে। আপনারা কি চান তৃতীয় এডিশন বের হউক? আমাদের বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ নাই,যা চলছে আলহামদুলিল্লাহ! তবে আপনারা যদি চান তবে তৃতীয় এডিশন বের হবে!! প্রতিদিন বউ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই সাজুগুজু শুরু করে দেয়।কোনরকমে নাস্তা করে ছুটে বইমেলায়। সারাদিন কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে। প্রতিদিনই একটা করে শাড়ি পাল্টায়। আমি বললাম,ঘটনা কী বউ? বই বেঁচতে যাও নাকি ফ্যাশন শো করতে যাও?
বউ মুখ বাঁকা করে বললো, তোমার মতো বেকুব জীবনে দেখি নাই! কত টিভি ক্যামেরা ঘুরাঘুরি করে, কখন কার সামনে পড়ে যাই,এক শাড়িতে মান ইজ্জত থাকবে ? ফেসবুকে নানা মানুষের সাথে বউয়ের ছবি দেখি।বই হাতে পাঠক বউয়ের সাথে সেলফি তুলতে পেরে খুশি। সেলফি তোলার লোভে বুড়ো হাবড়া টাইপ লোকজনও রুপ চর্চার বই কেনে! কয়েকদিন পর আবার প্রকাশক বিজ্ঞাপন দেয়, অজস্র পাঠকের কথা বিবেচনা করে আমরা ‘আয় রুপচর্চা করি’ বইয়ের তৃতীয় এডিশন বাজারে আনতে বাধ্য হইলাম!!
একদিন আমি সেই বইয়ের স্টলে হাজির হলাম। প্রকাশক হাসি হাসি মুখে বসে আছে। বউ নায়িকাদের মতো সাজ দিয়ে এসেছে। পাঠকের সাথে সেলফি তুলছে। পাঠকের খোঁজে এদিকওদিক ঘুরছে। কেউ সেলফির লোভে বই কিনলেই তাকে সুন্দর করে না চাইতেও অটোগ্রাফ দিচ্ছে! আমি প্রকাশককে বললাম, কেমন চলছে বই? প্রকাশক হাসি দিয়ে বললো, ফাটাফাটি ভাই। হেভি চলছে! এক ছেলে তার মায়ের সঙ্গে এসেছে। ‘আয় রূপচর্চা করি’ বইটা দেখিয়ে বললো, আম্মু এইটা কিনবো!
আমি বললাম, বাবু, তুমি এই বইটা কিনবে কেন? এই বইটা সুন্দর! বুঝলাম সে প্রচ্ছদ পছন্দ করেছে! এক বুড়ো মতো লোক বই কিনে বউয়ের সাথে সেলফি তুলছে। আমি বললাম, চাচা কী বই কিনলেন? চাচা বললেন, উপন্যাস। চাচা এইটা তো উপন্যাস না। রূপচর্চার বই! ও আচ্ছা, এইটা রূপচর্চার বই? সমস্যা নাই। লেখিকা অনেক সুন্দরী। তার লেখা নিশ্চয়ই ভালো হবে! কী সুন্দর করে আমার সাথে ছবি তুললো!!
বউ আমাকে কাছে ডাকলো।কাছে যেতেই বললো, আমার সাথে বই হাতে একটা সেলফি তোল। আমি তাই করলাম। বউ সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড দিয়ে লিখলো, এইমাত্র বিখ্যাত লেখক হানিফ ওয়াহিদ আমার একটা বই কিনলেন। উনি জানিয়েছেন শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও শুধু আমার বইটি কেনার জন্য উনি মেলায় ছুটে এসেছেন!