২৮জুলাই ২০১৬,আমি তখন সবে মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি।ভর্তি হওয়ার পরই নতুন আপদ এসে হাজির হলো থাকবো কোথায়? ঢাকার বাহিরে থেকে আসার কারনে তেমন চেনা পরিচিতিও তেমন নেই, হলেও সিট হবে কিনা সন্দেহ আছে।এলাকার এক বড় ভাইয়ের মেসে ছিলাম মাস খানেক জিগাতলার দিকে।কিন্তু ফ্রি তে আর কত থাকা যায় অন্যদিকে নতুন বাসা যে ভাড়া নিবো এমন পরিস্থিতিতেও নেই।কলেজ শেষে পুকুর পারে বসে আনমনে ভাবছিলাম কি করা যায়,টিসি টা নিয়ে বাড়ির আশেপাশের কোন কলেজে ভর্তি হওয়াই মনে হয় ভালো হবে। হঠাত কারো কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছনে তাকালাম।
দেখি এক বড় ভাই দাড়িয়ে আছে।আমার পাশে এসে বলল,”কোন সমস্যা? অনেক্ষন হলো দেখছি আনমনে কি যেন ভেবে চলেছো,দেখে তো মনে হচ্ছে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র”আমার কেন জানিনা ভাইয়ের উপর ভরসা হলো সবকিছু খুলে বললাম ভাইকে।চিন্তা ভাবনা করে করে বলল ঠিক আছে বিকেলের দিকে চলে এসো জিনিসপত্র নিয়ে আমার রুমে একটা সীট ফাকা আছে তবে ডাকলে মাঝেমাঝে যেতে হবে কিন্তু।ঢাকায় আসার এক মাসের মধ্যেই বুঝে গেছি কোথাও যেতে হবে মানে দুই একদিন কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতে হবে।তবে আমার চিন্তাকে ভুল প্রমান করে ভাই বলল, “ভয় পেয়োনা, তোমাকে কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতে হবে না ” আমি এতেই খুশি।ভাইয়ের সাথে গিয়ে রুম দেখে এসে জিনিসপত্র নিয়ে বিকেলবেলাই হাজির আমি।
রুম নম্বর ৩১৬,সাউথ হলে সীট হলো ভাইয়েরসাথে।ভাই আসলেই একটা দিলখোলা টাইপের ভালো মানুষ। কিছুদিন থাকার পরই বুঝতে পারলাম ভাইকে আসলে যতটা ভোলাভালা ভাবছিলাম অতটাও না জুনিয়র রা ভাইকে যথেষ্ট সমীহ করে আর মাঝে মাঝে যেতে হবে বলতে ভাই আমাকে মাঝেমাঝে উনার গার্ল ফ্রেন্ডের কাছ থেকে খাবার আনার কথা বলেছিলেন।আকাশ ভাই তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের শেষের দিকে আর সোনালী আপু অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন ঢাকা সিটি কলেজে।
নামটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তখনকার দিনে সিটি কলেজের পোলাপানদের সাথে আমাদের কলেজের পোলাপানদের মামাতো ভাই খালাতো ভাইয়ের সম্পর্ক। ধানমন্ডি সায়েন্সল্যাব এলাকাটাকে প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পত্তি মনে করতাম।আর এই সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়েই যত ঝামেলা, যখন যে যেদিক দিয়ে পায় তখনই আদর করে দেয় পোলাপানদের।আর আমাকেই কিনা সকাল সকাল সিটি কলেজের গেটের সামনে দাড়িয়ে আপুর জন্য অপেক্ষা করে খাবার নিয়ে আসতে হবে!উপায় নেই পড়ছি মাইনকার চিপায়, হলের সীটের মায়ায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। ভাইয়া অবশ্য আশ্বাস দিয়েছিলো ব্যাটা বুক ফুলিয়ে যাবি যা হবে আমি দেখবো।
এমন কোন দিন নেই আমারে দিয়ে এই কাজ করানো বাদ দেয়নি ভাই।এমন কি কুত্তামারা শীতের মধ্যেও ভাই আমারে পাঠাইছে আপুর কাছে। মাঝেমাঝে আমিও অবাক হয়ে যেতাম আপুর ধৈর্য দেখে,একটা মেয়ে কিভাবে তার বয়ফ্রেন্ডের জন্য প্রতিদিন সকালের নাস্তা নিয়ে আসতে পারে।অবশ্য ভাই একা একা খেত না মাঝেমাঝে আমারো কিছু জুটতো।এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয় তখন যদি আজকের মতো ফুড পান্ডা বা পাঠাও এর মত খাবার ডেলিভারির কোন সুযোগ থাকতো তাহলে আপু আর ভাইয়ের এই নাস্তা আদান প্রদানের সাথে আর দুই একটা খাবার পৌছে দিয়ে চার্জের টাকায় নিশ্চয় এতোদিনে ধানমন্ডি এলাকায় দুই একটা ফ্ল্যাট কেনা হয়ে যেত। তারপরও ভাইকে দেখতাম একটু গা ছাড়া ভাবের।
দুজনের মধ্যে ঝগড়া হতো তুমুল লেভেলের।ভাবতাম৷ আজকেই শেষ এদের সম্পর্ক।কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমান করে পরেরদিন সকালে সোনালী আপু নিজেই ফোন দিতো আমাকে।ফোন দিয়েই পুরো রাগটা আমার উপর তুলতো আমি কেন খাবার নিতে আসিনি?খাবার কি দোষ করছে? ফোন কেটে ভাইয়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকাতেই বিচ্ছিরি একটা হাসি দিয়ে বলতো যা নিয়ে আয় ক্ষুধাও লাগছে দুজনে খাওয়া যাবে।প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো তবে আস্তে আস্তে বিষয়টা ভালো লাগায় পরিনত হয়েছিলো। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম এই দুটোকে দেখে কত ঝগড়া গালাগাল তবুও দিনশেষে সবকিছু ভুলে আবার নতুন দিনের শুরু করে এক্ষেত্রে আপুর অবদানটাই বেশি।
ডিসেম্বরে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে গেছি।হঠাত একদিন আকাশ ভাইয়ের ফোন। যে মানুষটারে এতোদিন সবকিছুতেই নির্লিপ্তভাবে থাকতে দেখেছি সেই মানুষ টা ফোন ধরেই কেদে দিলো।তারপর পুরো ঘটনাটা শুনলাম ভাইয়ের কাছ থেকে।আপুর সেই সময় সেমিস্টার পরীক্ষা চলছিলো।বাস দিয়ে আসার সময় বাম হাত টা অসাবধানতায় নামার সময় আপু সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে যান আর পাশের একটা লেগুনা আপুর পায়ের উপর দিয়েই চলে যায়।ডাক্তার বলেছে পা পুরোপুরি ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বাকি জীবনটা স্ক্র্যাচে ভর দিয়েই কাটাতে হবে।আপুও ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে কারন হিসেবে উনি দাড় করিয়েছেন উনার শারীরিক অক্ষমতাকেই।কিছুই বলার মতো ছিলোনা আমার।
ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরেই দেখি ভাই পুরো পাগলপ্রায়।সারা রুমে সিগারেটের প্যাকেট, কাপড় চোপড় এলোমেলো।ব্যাগ রেখেই আপুকে ফোন দিলাম।ধরতেই বললাম আকাশ ভাইয়ের বিয়ে সামনে আপনার সাথে দেখা করতে চায় শেষবার৷ আপনি পাচটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন।ফোন কেটেই ভাইয়ের দিকে তাকাতেই ভাই রাগে যেন খেয়ে ফেলবে।আমি ভাইকে বুঝালাম আপনার বউয়ের আত্নসম্মান বোধ বড়ই প্রখর এভাবে হবেনা সরাসরি বিয়ে করতে হবে পারবেন??ভাই কিছু না বলে বেড়িয়ে গেল। কিছুক্ষন পর এসে বলল আমি রাজি। আমি বললাম তাহলে তিনজন সাক্ষী হাজির করেন।
বিকেল বেলা সোহরাওয়ার্দীতে গিয়ে দেখি আপু আগেই এসেছে।ভাইকে বললাম এবার আপনি বলেন আমি ওইপাশটায় দাড়াচ্ছি।আমি নিশ্চিত ছিলাম দুইটাই যে লেভেলের খুব বেশি হলে দশ মিনিট লাগবে ভুল বুঝাবুঝি থামতে।একটু পরেই ভাইয়া ডাক দিয়ে বলল,”চল তাহলে যাওয়া যাক”আমি অবাক হয়ে বললাম কই?মগবাজার কাজী অফিস।শাহবাগ থেকে রিক্সা নেয়া হলো। এক রিক্সাতেই তিনজন। কেন জানিনা খুবই ভালো লাগা কাজ করছিলো মনের মধ্যে।বিয়ে হলো লুকিয়ে তবে ভাইয়ার চাকুরি হওয়ার পরেই বিষয়টা জানানো হবে আর সবকিছুই আগের মত চলবে।
শুনে মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল তারমানে এই কুত্তামারা শীতেও আমারেই যাইতে হবে খাবার নিতে।ভাইয়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকালাম ভাই বুঝিয়ে দিলো কিচ্ছু করার নাই, মাইনকার চিপায় পড়ছো তুমি।এরপরের দিন খাবার নিতে গিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।আপু কে জিজ্ঞাস করলাম দুইটা কেন?আপু বলল,”তোর ভাই আর তোর নাকি খাবার কম হয়ে যায়। হাজার হলেও একটা মাত্র দেবরজি তুই ঢাকাতে।ইচ্ছা করছিলো আবেগে কাইন্দা দেই আপাতত সেই চিন্তা বাদ দিয়ে হলে ফিরে খাবার টা খাওয়াই শ্রেয় মনে হলো।এর পর থেকে এই দুইটার মধ্যে ঝগড়া ঝাটির পরিমান বাড়তেই থাকলো আর মাঝখান থেকে দুইটাই ফোন দিয়ে আমারে জ্বালাইতো।
আমিও ফোন টা লাউড দিয়ে টেবিলে রেখে দিতাম।অবশ্য বছর খানেকের মধ্যেই ভাইয়ের চাকুরি হলো জনতা ব্যাংকে। বিয়ে সাদি করে ভাই আর ভাবি উঠলেন আজিমপুরের দিকে ছোট্ট একটা বাসায়।আমি হতভাগা ভার্সিটি এডমিশনের জন্য হল ছেড়ে ফার্মগেটের দিকে গেলাম।তবুও মাসে ভাইয়ের বাসায় ভালোমন্দ রান্না হলেই আমার ডাক পড়তো।মাঝেমাঝে এই ভালোবাসার সাথে এখনকার ভালোবাসার মধ্যে মিল খুজার চেস্টা করি।কিন্তু কিছুই পাইনা ভাই আর আপুও মাঝেমাঝে এসব দেখে মনে মনে শোকরিয়া আদায় করে হয়তো।