সন্ধ্যা আনু মানিক সাড়ে সাতটা। সৈকত আর আমি। চায়ের কাপ হাতে গল্প করছি। অপরিচিত একটা নম্বরের ফোন। রিসিভ করতেই অপর প্রান্তের একটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর—
>তুই কোথায়—-?
একটু ক্রাশ খাবার উপক্রম। ধাক্কার রেস কাটিয়ে প্রশ্ন করলাম–কে বলছেন?
> আ আমি মইনুল বলছি। তুই কোথায়?
ততোধিক উত্তেজিত কণ্ঠ। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করে বললাম–আমি তো শরীয়ত পুর বাজারেই আছি—
আমার কথা শোষ হবার আগেই ওপার থেকে শুনতে পেলাম—
>তুই এক্ষুনি উপজেলা বাজারে দেখা কর। খুব আর্জেন্ট–। আমরা উপজেলা বাজারে বসে আছি। তোর কতোটুকু সময় লাগতে পারে?
>আধা ঘন্টার মতো—
>আচ্ছা ঠিক আছে—
লাইন কেটে গেল। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না মইনুল ভাইয়েরা এই সময় উপজেলায় কি করছে। কিই বা এমন আর্জেন্ট দরকার আমার সাথে। সৌজন্যতা বোধে তো অবশ্যয় না। কারন সেই ক্যাটাগরির রিলেটিভের মধ্যে আমরা পড়ি না। মইনুল ভাই আমার মেজো মামার ছেলে। আমার থেকে বছর দশেকের বড়। ওদের কোনো বড়ো রকমের দরকার না হলে আমাদের সাথে সচরাচর যোগাযোগ হয় না। সৈকতকে সাথে নিয়ে মটর বাইক নিয়ে ছুটলাম হন্ত দন্ত হয়ে।
.
উপজেলা বাজারে পৌঁছে দেখলাম ওরা ছয় সাত জন দাঁড়িয়ে। সবাই কেমন যেন এ্যাবনরমাল। আঁচ করে নিলাম সিরিয়াস কিছু হবে। মইনুল ভাই পাশে ডেকে নিয়ে একটা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল–
>এই ছেলেটিকে চিনিস? দেখেছিস কখনো?
আমি ছবিটা ভাল করে দেখলাম। ঠিক মেমোরিতে আনতে পারলাম না। সৈকতের হাতে ছবিটা চালান করে দিলাম—
>ঠিক চিনতে পারছি না। কি হয়েছে?
>ববি এই ছেলেটার সাথে পালিয়ে এসেছে।
আমার তো ভিমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার যোগাড়। কয়েক মূহুর্ত বাক রুদ্ধ হয়ে রইলাম। ববি আমার মেজো মামার বড়ো মেয়ে পপি আপারমেয়ে। কতো দিন আগে ওকে শেষ দেখেছি মনে নেই। তবে ও যে আবার একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে এটা শুনে রাগ করবো, নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছি না। ছেলের ব্যাক গ্রাউন্ড শুনে আরও বিশ্মিত হলাম। মেয়েরাও বোকা হয়? ভালবেসে যেনো তেনো একটা ছেলের সাথে ঘর ছাড়ে?
বড় দার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর মেয়ে নামটাতেই আমার এ্যালার্জি। বড়দা ছিল আমাদের পরিবারের নিউক্লিয়াস। বাবা মার সব স্বপ্ন বোধহয় ওর মাঝেই নিহিত ছিল। তাই যাবার সময়ও মাকে সাথে নিয়েই গেছে। ওকে বড় অসময় আমাদের মাঝ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে একটা মেয়ের নির্লজ্জ প্রতারনা। সেদিন যে অন্ধকার নেমে এসেছিল আমাদের জীবনে তা আর কোনোদিন আলোর মুখ দেখবে না এটা অবধারিত। মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা মমত্ব বোধ সেদিন থেকেই শুন্যের কোঠায়। সেই রকম একটা মেয়ে বাবা মার অবাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে পালালো এটা একটা নতুন বিশ্ময় আমার কাছে। বিশেষত এমন একটা ছেলের সাথে যার সাথে ববিদের পরিবারের আসমান জমিন ব্যাবধান। মেয়েরাও তাহলে জীবনের অংকে কাঁচা হয়?
মইনুল ভাই বললো –ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি সৈকত কে ছবিটা আপলোড করে নিতে বললাম। যদিও জানি ঠিকানা বিহীন একটা ছেলেকে শুধু ছবিকে নির্ভর করে খুঁজে বের করা কঠিন।
.
রাত ভর অনুসন্ধান চালিয়ে ভোর রাতে একটা অস্পষ্ট ধারনা পেলাম কোথায় পাওয়া যেতে পারে। সকালে টিম সমেত হাজির হলাম চর দিয়াড়। যে নামটি নিয়ে নানা গুঞ্জন শুনছিলাম প্রখম ধাক্কাটা ওকে দেখেই খেলাম যখন জাহিদ আমাকে দেখেই বলল–
>তুই এখানে কেন?
জাহিদ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। এস এস সির পর আমরা ছিটকে গেছি। পরে আর সেই ভাবে যোগাযোগ নাই। স্কুল জীবনেই দেখেছি রাজনীতিতে ওর স্বক্রিয় অংশ গ্রহন। এই ক বছরে ও এতো বড় দাদা হয়ে গেছে ভাবতেই পারিনি–
আমি ওকে সব খুলে বললাম। সব শোনার পর জাহিদ বলল—
>সরি দোস্ত আমি জানতাম না মেয়ে তোর রিলেটিভ। এখন কি করার তাই বল?
আমি সব দায়িত্ব ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলাম। এছাড়া আমার আর কিছু বলার মতো ছিল না। প্রেম ভালবাসা কতোটা স্পর্শ কাতর হয় তার জলন্ত প্রমাণ আমার ফ্যামিলিতেই আছে। একটা ভাই পুড়েছে এই আগুনে। তার উপর আবার ছেলের হিস্ট্রি শোনার পর সবার সামনে পজেটিভ এপ্রোচ টাও দেখাতে পারছি না।
জাহিদ শেষ মেশ বলল—যেহেতু তুই এসেছিস মেয়ে আমি তোর হাতে তুলে দেয়ার ব্যাবস্হা করছি। তবে দোস্ত তোকে ওয়াদা দিতে হবে এসব নিয়ে যেন কোনো বাড়াবাড়ি, থানা পুলিশ না হয়।
আমি অভয় দিলাম। পরে জাহিদ বলল–
>আগে চল তুই গিয়ে সামনা সামনি কথা বল–।
প্রস্তাবটা আমার কাছে চয়েজ ফুল হলো না। কেননা এই বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে কোনো কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না। তার উপর মইনুল ভাই আছে। পরে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটলে তা শোভনিয় হবে না। বড়দার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর এদের অনেক কথায় চপেটাঘাত মনে হতো। তার উপর সাথের সবাই বুঝে গেছে জাহিদ আমায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। মনে মনে বিষয়টা আমি ইনজয়ও করছি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম রায়হানকে সাথে নেব। ববির আপন মামা। আমার প্রায় সমবয়সি। ওর সামনে সব কথা হলে আমিও একটু স্বস্হি পায়।
.
গন্তব্যে পৌঁছে ববি আর মারুফকে যখন সামনে আনা হলো আমার সামনে তখন বড়দার করুন মুখটা ভাসছে। ভালবাসলে মানুষ বোধহয় এমনি হয়। হারাবার ভয়টা যেন প্রতিমূহুর্ত তাড়া করে বেড়ায়। মারুফের মুখে সেই শঙ্কাটা স্পষ্ট। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল। এমন দুটি অনুভূতিশীল হৃদয়কে দিখন্ডিত করার মিশনে এসেছি?
জাহিদ আমাকে দেখিয়ে ববিকে জিজ্ঞাসা করল–
>একে চেন?
ববি কোন উত্তর দিলনা। একবার তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে ফেললো। জাহিদ আবার বললো–
>ও আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমি জানতাম না তুমি ওর রিলেটিভ। জানলে রাখতাম না। ও যখন আমার কাছে এসেছে আমার বাবা বললেও আমি তোমাকে এখানে রাখবো না। তোমাকে ওদের সাথে চলে যেতে হবে।
এবার মুখ খুললো ববি—
>মামা, আপনি নিশ্চয় চাননা তুষার মামার ইতিহাসটা আবার ফিরে আসুক। স্বেচ্ছায় তো আমি যাবো না। আমাকে নিয়ে যেতে হলে মারুফকেও নিতে হবে। যদি তা না করেন আর একটা তুষার ইতিহাসের জন্য তৈরি থাকুন।
আমার সামনে তখন বড়দার মুখটা ভাসছে। কি নির্মম, কি বিভস্য। আরও একটা নোংরা মুখও ভাসছে। ববি আর ওই মুখটাতে কতো তফাৎ। একটা লোভী,বিকৃত লালসায় ভরা মুখ। আর একটা কি নির্লোভ, নিষ্পাপ। একটু থেমে ববি আবার বলল—
>আমি তো ঘর ছেড়ে পালাতে চাইনি মামা। বাবা, মাকে সব বলেছি, বুঝিয়েছি। ওরা বোঝেনি। মেরেছে আমায়। গায়ে হাত তুলেছে। তাই আমি পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।
এবার মারুফও মুখ খুললো–
>হ্যাঁ মামা। একবার যখন আমরা একসাথে হয়েছি। মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর আলাদা করতে পারবেন না। আমরা দুজন দুজনের জন্য জীবন দিয়ে দেবো। এটাই যদি আপনাদের চাওয়া হয় আমাদের আলাদা করে দিতে পারেন।
আমি চোখের জল লুকাতে পারলাম না। ববি বয়সে আমার ছোট। না হলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। রায়হানের দুচোখও ভিজে উঠেছে।
আমি ফোন করে মইনুল ভাইকে ডেকে নিলাম। সব ভেঙ্গে বললাম। এও বললাম আপনারা চাইলে আমি ববিকে একা নিয়ে যেতে পারি। তবে—
আমার কথার মাঝে রায়হান বললো—
>যা হবার অনেক হয়েছে। এর পর আর কিছু বলার থাকে না। করার থাকে না। ওরা যদি ভাল থাকে তো থাক—
আমার বিশ্বাসের সীমানা আমি পেরিয়ে গেছি। মেয়েরাও ভালবাসতে পারে। ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারে। ভালবাসার মানুষের হাত শক্ত করে ধরে রাখতে জানে। হয়তো সংখ্যার বিচারে নগন্য। তবুও পৃথিবী গর্ব করতে পারে এদের নিয়ে—-
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা