খুব সম্ভবত মিতুর সাথে আজ আমার শেষ দেখা৷ খানিক বাদেই মিতু গম্ভীর মুখ নিয়ে হাজির হবে আমার সামনে৷
আমার হাতে দু’টো তাজা গোলাপ৷ ফ্রি তে পেয়েছি৷ ইচ্ছে ছিল, শেষ দেখায় মিতুর জন্য স্পেশাল কিছু আনবো৷
মেসে মিলের টাকা আর বোনের কলেজ ফি দিয়ে পকেটটা ফাঁকা পড়ে আছে৷ একটা ৫০টাকা নোট আছে পকেটের কোণে৷ তা দিয়ে গোলাপ কিনবো ভেবেছিলাম৷ তা আর খরচ করতে হয়নি৷” “আজ অদ্ভূত কান্ড ঘটেছে পার্কে ঢুকতেই৷ লাল রঙের গাড়ি চড়ে আসা ভদ্রলোক সবাইকে ফুল দিয়ে বেড়াচ্ছে৷ ফ্রি তে৷” কেউ অতীব ভদ্রতা দেখিয়ে টাকা দিতে চাচ্ছে৷ জবাবে ভদ্রলোকের মুখে মিষ্টি হাসি৷”
মানুষটার গাড়ির পাশে দাঁড়ানো দু’জন মহিলা৷ একজনের চুল একটু সাদা হচ্ছে৷ আরেকজন একটু কমবয়সী৷ উনারা মানুষটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে৷” মিতুর কথা মনে পড়তেই আমার মনটা খারাপ হল একটু৷ মিতুর সাথে আমার এক পৃথিবী এক সাথে থাকা আর হচ্ছেনা সেটা একরকম নিশ্চিত হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে৷ দিনকয়েক আগে মিতু বলল, চল পালায়!” আমি মিতুর গাল এ হালকা গুতো দিয়ে বলেছিলাম, মাথা খারাপ হয়েছে তোর?” মিতু মুখ অন্ধকার করে বলল, পালাবিনা তাইলে?” আমি নির্লিপ্ত মুখে সামনে তাকিয়ে বললাম, নাহ৷” তারপর দু’জনই চুপ করে থাকি৷ কোনো কথা হয় না আর৷ শুধু শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনি৷ ঘন হচ্ছে শ্বাসের শব্দগুলো সময়ের সাথে৷” মিতু নিরষ গলায় বলল, আয় আমাকে এগিয়ে দিবি৷” আমি শুনলাম মিতুর কথা৷”
মিতুর সাথে আমার হুট করে প্রেম হয়নি৷ ধীরে সুস্থে হয়েছে৷ মিতু মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে৷ সুখী পরিবারের মেয়ে৷ আমিও অস্বচ্ছল কিংবা অসুখী পরিবারের ছেলে নয়৷ বাবা না থাকাতে মাসের শেষে একটু আধটু টানাটানি হয়৷
মাসের শেষের দিকে একবেলা না খেয়ে থাকি৷ আর বোনের কলেজের বেতনটা একটু আধটু টানাটানি হয়৷ এই আরকি৷” মিতুর সাথে প্রথমে আমার সাজেসন্স দেয়া-নেয়ার বন্ধুত্ব৷ তারপর ঠুকঠাক কথা বলার বন্ধুত্ব৷ তারপর অনুভূতিগুলো ভাগাভাগির বন্ধুত্ব৷ তবুও বন্ধুত্ব পর্যন্ত থাকে৷ প্রেমে আর ঘড়ায় না৷”
আমার হুটহাট মনে হয়,আমার একটা প্রেমিকা থাকুক৷ আবার ভাবি, না থাক৷” মাঝেমধ্যে মিতুকে বলতাম, রবি-সোম এই দু’দিন তুই আমার প্রেমিকা৷ কখনো তুই আমার শুক্রবারের প্রেমিকা৷ কখনো শেষ বিকেলে আমার গম্ভীর মনের প্রেমিকা৷” মিতু ভ্রু কুচকে বলতো, লাথি দিবো ফুটবলের মতো৷ শখ কত হুহ৷” তবুও মিতু আমার প্রেমিকা হতো৷ তুই এর বদলে তুমি করে বলতো৷ শাড়ি পরে আসতো৷ আমার হাত ধরে হাঁটতো৷ শেষবিকেলে ফুচকা গিলতো৷” আরেকদিন মিতুকে হুট করে শাড়ি উপহার দিয়ে বললাম, তুই কাল আমার প্রেমিকা৷” মিতু মুখ বাঁকা করে বলল, পারবোনা৷ এই শাড়ি তুই রেখে দে শালা৷” মিতু শাড়ি নেয়নি৷”
আমার মেজাজ খারাপ হল৷ তবুও সামলেছিলাম৷ শেষে মিতুর বান্ধবী নিরুপমার কাছে শাড়িটা বেছে দিয়েছিলাম৷”
নয়তো দূ’বেলা উপোস থাকতে হতো৷” তার দিনকয়েক পরে একদিন আমি বেরোলাম না৷ ঘরে বন্দি রাখলাম৷ শরীরটা সেদিন ম্যাচম্যাচ করছিল৷” একটু বেলা করে মিতুর ফোন আসে৷ জরুরী তলব৷ আমি ও হুড়মুড়িয়ে চলে গেলাম মিতুর কাছে৷” মিতুর সামনে যেতেই খপ করে ধরলো শার্টের কলার৷ আমি ভড়কালাম একটু৷ আমি মিতুর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালাম৷ চোখে মুখে রাগ আর অভিমান৷” কাষ্ঠ কন্ঠে বলল, নিরুপমাকে শাড়ি দিলি কেন? পার্মানেন্ট প্রেমিকা বানাচ্ছিস?” যা এখনই বলে আয়, কাল শাড়িটা ঠিকঠাক আমাকে দিতে৷ তোর পার্মানেন্ট প্রেমিকাকে দিতে!”
-পার্মানেন্ট প্রেমিকা কে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি৷ মিতু দু’হাত কোমড়ে দিয়ে রাগি মুখে বলল,
-কে আবার? আমি আমি৷”
দু’দিন পরে মিতু শাড়ি পরে হাজির হয়৷ আমি নিরুপমাকে টাকা ফিরিয়ে দিতে গেলাম৷ নিরুপমা আমার চুল টেনে বলেছিল, এটা তোর ট্রিট বন্ধু৷” আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম চোখে মুখে৷” তারপর থেকে মিতু আমার প্রেমিকা৷৷ এখনো তুই করে বলে৷ অামরা প্রেম করি৷ আমাদের প্রেমালাপগুলো এখনো বইয়ের পাতায় পড়ে আছে৷ আমি মাঝেমধ্যে বলতাম, তুই বেটি রোমান্টিক হ৷” মিতু চোখ বড় করে বলতো, চাকরি পেয়ে আমার বাবার সামনে যাবি৷ তারপর রোমান্টিক হবো৷”
মিতু প্রেমময়ী হতো৷ প্রায়ই হয়৷ আমাদের সবকিছু হয় নিয়ম করে৷ সব শেষ হলো নিয়ম করে৷ চাকরির বাজারে আমার চাকরি মেলেনা৷ টিউশন করে চলে আমার৷ মিতুর মুখ প্রায়ই গম্ভীর থাকে৷ আমার চাকরির প্রস্তাবের চেয়ে কয়েক শ গুণ তার বিয়ের প্রস্তাব৷ মিতু শক্ত চেহাহায় না করে৷” মাঝেমধ্যে মুখে ক্লান্তি এনে বলে, আর কত শুভ?” আমি মিতুর নরম হাতে হাত রেখে বলি, এইতো আর কিছুদিন৷” আর কিছুদিন আর হয়ে উঠে না৷ গত সপ্তাহে মিতু বলল, ভালোর চেয়ে ভালো একটা প্রস্তাব এসেছে৷ মিতুর মা এবার না করতে চাচ্ছে না৷” মিতুর বাবাকে আমি একটু আধটু চিনি৷ মানুষটা মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়৷ আমাকেও টুকটাক পছন্দ৷” আমার সাথে দেখা হয় মাঝেমধ্যে৷ আমার মুখ অন্ধকার থাকলে মানুষটা আমার কাঁধ চাপড়ে বলে, চাপ নিওনা ছেলে৷ সময় হলে উড়াল দিও৷” আমার সেই উড়াল দেয়ার সাহস হয়ে উঠে না৷”
মিতুর মা পুরো উল্টো৷ মেয়েকে বড় ঘরে দিবে৷ আয়েশে থাকবে মেয়ে৷ আয়েশে থাকলে সুখ পায়ে এসে লুটোপুটো খাবে৷ সেটা উনার ধারনা৷” “আমি এখনো বেন্ঞ্চিতে বসে আছি৷ মিতু আসছেনা এখনো৷ সম্ভবত আমার জন্য ঘড়ি কিনে আনবে৷ সেদিন বলল, তোর সময় জ্ঞান নেই৷ তাই যাওয়ার আগে ঘড়ি দিয়ে যাবো তোরে৷ আমারে নিয়েতো উড়াল দিতে পারবিনা৷ সময়মতো বিয়েটা করে নিস৷ দেবদাস হোস না যেন৷” আমি কিছু বলতে পারিনি৷” কাঁধে অপরিচিত হাতের ছোঁয়ায় আমার ভ্রম ভাঙে৷ ফ্রিতে ফুল দেয়া মানুষটা আমার পাশে বসা৷ মুখে মুচকি হাসি লেগে আছে৷ আমার মনটা একটু ভালো হয় সুখী মানুষকে দেখে৷”
-কার জন্য অপেক্ষা করো ছেলে?” আমি লজ্জা পেলাম একটু৷
-মনের মানুষ নিশ্চই?” আবার বলল উনি৷ জবাবে আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম, হ্যা৷”
-তা কতদিনের?” আমি সময়টা জানালাম৷
-বিয়ে কবে করছো?”
আমার মনটা খারাপ হল হুট করে৷ আমি চুপ থাকি আবার৷” ” আমার অসহায় মুখ দেখে মানুষটা কী বুঝলো জানি না৷ আবার আমার কাঁধে হাত রেখে সামনের দু’জন মহিলাকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে দু’জন দেখছো? যার চুলে পাক ধরেছে৷ উনি আমার বড় দিদি৷ পাশেরজন আমার প্রিয়তমা৷ বড় ঘরের মেয়ে৷ তার বড় ঘরের বদলে আমার কীছুই ছিল না৷ তবুও আমার হাত ধরে ঘর ছেড়েছে৷ আমার মা-বাবা নেই৷ আমার পৃথিবী বলতেই ছিল সেই৷ আমার এক পৃথিবী ভালোবাসার ভরসায় যখন সে ঘর ছাড়লো৷ আমি তখন ২০টাকার মালিক মাত্র৷ ২০টাকায় এই শহরে দু’টো বন রুটি পেতে হিমসিম খেতে হয়৷ সেখানে ২০টাকায় আমি সংসার চালাবো! আমার অন্ধকার দেখার কথা৷ তবুও আমার মন ফুরফুরে৷ আমার ভালোবাসা নিয়ে উড়ছি আমি তখন৷ চাচার বাসায় থাকতাম৷ আর গেলাম না ঐ নিষ্ঠুর বাড়িতে৷
ঐ যে দেখছো, আমার দিদি৷ এই পার্কেই ফুল বেছতেন৷ মানুষটার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না৷ এর চেয়ে বেশি কিছু৷” চাচীর বকা খেয়ূ আমি ঠিক এখানটায় এসে বসে থাকতাম৷ দিদিকে দেখতাম ফুল বেছতে৷ আমার নিঃস্বঙ্গ লাগতো৷ একদিন এগিয়ে দিদিকে সাহায্য করা শুরু করলাম৷ আমি দিদির পিছু পিছু হাঁটতাম৷ আমি দিদির বডিগার্ড৷ দিদি একটু নিশ্চিন্ত হল৷ এই শহরে মানুষরুপি অল্পসংখ্যক জানোয়ারের আনাগোনায় মাঝেমধ্যে দিদির আত্মায় কাঁপন ধরাতো৷ আমি তার পাশে দাঁড়াতে একটু নিশ্চিন্ত হল৷ তারপর থেকেই আমি প্রতি বিকেলে হাজির হতাম৷ এ বেলা ঐ বেলায় সময় পেরোলো৷ দিদি ফুল বেছা ছেড়ে কাপড় সেলাই শুরু করলো৷ কিন্তু সেদিনের পুচকে আমাকে ভুলেনি৷”
আমার প্রিয়তমার হাত ধরে দিদির কাছেই গেলাম৷ আমাকে ফেরাইনি৷ ছাড়েওনি আর৷ দিদির হাত ধরে প্রিয়তমাকে সাথে নিয়ে হারিয়ে গেলাম৷” দিদির বিয়ে দিয়েছি৷ কিন্তু সে তার পুচকে ভাইকে ছাড়বেনা৷ শেষমেষ দুলাভাইকে একরকম ঘরজামাই বানিয়ে ফেললাম হা হা৷ আজ দিদির জন্মদিন৷ তাই আবার ফিরে আসা” পাশে ফিরতেই দেখলাম মিতু এসেছে৷ মুখটা মলিন৷ ভদ্রলোক আমার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন৷ মিতু চুপচাপ আমার পাশে বসে৷” আমি ভদ্রলোকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ মানুষটা থেমে পেছন ফিরে তাকালো৷ আমাকে হাতের ইশারায় ডাকছে৷
আমি ছুটে যায়৷ পকেট থেকে ১০০টাকার ১নোট দিয়ে বলল, এই টাকাটা রাখো৷ ফুল বেছে পেলাম৷ আমি মৃদ্যু হেসে কৃতক্ষতা জানাই৷ পেছন ফিরতেই ভদ্রলোক আরেকবার ডেকে বললেন, টাকার পেছনে আবার নাম্বারটা দেয়া৷ চাকরির বাজারে মন্দা৷ ড্রাইভারের পদটা খালি আছে৷” চাকরি পেলে ছেড়ে দিও৷ তোমার জন্য ডিসকাউন্ট৷” আমি মিতুর কাছে ফিরে আসি৷ মিতু যত্ন করে আমার হাতে ঘড়িয়ে পরিয়ে দেয়৷ নাক টানছে৷ আমি গোলাপ দু’টো তার হাতে দিলাম৷ মিতু পরম যত্নে হাত ছোয়ায় ফুলে৷ আমি মিতুর হাত ধরে বললাম,
-চল! মিতু অবাক হয়ে বলে,
-কই?
-উড়াল দিবো৷
-সত্যি?
-হু৷”
মিতুর নির্লিপ্ত মুখটা প্রাণবন্ত হয়৷ একবার জড়িয়ে ধরে শক্ত করে৷ আমিও ধরি৷ পকেট থেকে ফোনটা বের করে “সুইচ অফ” করার আগ মূহূর্তে ফোন বেজে উঠে৷ ছোটবোনের ফোন৷ ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে ছোটবোনের উত্তেজনায় ভরপুর গলার আওয়াজ শুনি৷” এলোমেলো গলায় বলল, ভাইয়া টিউশন পেয়েছি৷ তোর আর চিন্তা নেই৷ চাকরি পেয়ে নে৷ রাজমহল বানাবো৷ ভাবীকেও নিয়ে আসিস সাথে৷” আমি অবাক মুখে মিতুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ও জানলো কিভাবে?” মিতু মুখ মুচড়ে বলল, সব তোর মতো অকর্মা না বুঝলি৷ তুই না চাইলেও তোরে নিয়ে উড়াল দিতাম আমি৷” আমি সুখী মানুষটার দিকে তাকালাম৷ আমিও মানুষটার সমান৷ আমি সুখী মানুষ৷”