পতি পত্নী সমগ্র

পতি পত্নী সমগ্র

ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে বরমশাই আমার সম্মতি নিয়ে ঘরোয়া একটা আয়োজন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর এই আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথিদের ব্যাপারটা আমার জন্য সারপ্রাইজ রাখা হয়েছে। তবে আমি কতটুকু সারপ্রাইজড হতে পারবো, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ বরমশাই না বললেও আমি আন্দাজ করতে পারছি তিনি কাকে কাকে দাওয়াত দিতে পারেন।

সেদিন রাতে যখন আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, ভ্যালেন্টাইনস ডে ১৪ই এপ্রিল না, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, তারপর থেকে তিনি ভ্যালেন্টাইনস ডে তে অন্যরকম কিছু করে আমাকে খুশি করার জন্য এবং একইসাথে চমকে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাই যতটুকু আন্দাজ করতে পারছি, হয় আমার বাপের বাড়ি নয়তো শ্বশুরবাড়ির কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কারণ আমি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছি কয়েকবার। আর এর চেয়েও অন্যরকম কিছু করতে চাইলে আমার বন্ধুমহলের বিশেষ কয়েকজন বন্ধুকে তিনি আসতে বলতে পারেন। বরমশাইয়ের ধারণা, তাদের দেখে আমি চমকে গিয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাবো। অথচ আমি সত্যিকার অর্থেই কিসে খুশি হবো, তিনি এটা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। হয়তো বুঝতেই চাইছেন না!

বিয়ের পর এটা আমাদের প্রথম ভালবাসা দিবস। বরের সাথে একান্তে এই দিনটা কাটাতে চাওয়া কি অন্যায় কিছু? বেশি না, আমি শুধু চাইছি সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার সাথে স্পেশালি কাটাতে। যেন এই মুহূর্তগুলোকে আঁকড়ে ধরে বাকিটা জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো সহজে পাড়ি দিতে পারি।

মানলাম মানুষটা নিজে থেকে কিছু বুঝতে পারে না, সবকিছু রেডি করে শরবত বানিয়ে খাইয়ে দিতে হয়। তাই আমি সরাসরি কিছু না বললেও ইনিয়েবিনিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছি অনেকবার কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ৪৫ বছর বয়সী মেজো খালা এখনো প্রত্যেকটি ভালোবাসা দিবস খালুর সাথে নিজেদের মত করে উদযাপন করেন।এই দিনে তিনি তৃতীয় কারো উপস্থিতি মেনে নেন না একদমই, এমনকি তার ছেলেমেয়েদেরও না। আর এখানে আমি সদ্য বিবাহিত হয়েও বাপের বাড়ির লোকজনসহ বন্ধু-বান্ধবের সাথে চৌদ্দ দল গঠন করে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। এখন এ দিবস আমার কাছে ভালোবাসার না, মরণদশার মনে হচ্ছে।

যে মানুষটাকে ছুটির দিনে ১০টার আগে কিছুতেই ঘুম থেকে উঠানো যায় না, সেই মানুষ আজ সকাল ৭.৩০ এ নিজ তাগিদে ঘুম থেকে উঠে বাজার করতে চলে গেছেন! তাও আবার আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই। ঘুম থেকে উঠে বেড সাইড টেবিলের উপর একটা চিরকুট পাই আমি। যাতে লিখা ছিল: “তুমি ঘুমের মধ্যে আমার নাম ধরে খুব গালিগালাজ করছিলে। স্বপ্ন দেখছিলে বোধহয়। তাই তোমাকে ডাক দেয়ার সাহস পাইনি। দরজা বাইরে থেকে লক করে রেখে যাচ্ছি। তুমি সাহসী মেয়ে জানি, তবুও উল্টাপাল্টা কিছু হলে কল দিও, কেমন?

ইতি,
তোমার বরমশাই” পাক্কা দু’ঘণ্টা পর দু’হাত ভর্তি বাজার নিয়ে বরমশাই বাসায় ফিরলেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধ জয় করে এসেছেন তিনি। আমি রাগী রাগী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– ক’টা বাজে খেয়াল আছে?

তিনি বাজারের ব্যাগের ভেতর থেকে একডজন লাল গোলাপ বের করে বিধ্বস্ত চেহারায় এক চিলতে হাসির ঝলক ফুটিয়ে উত্তর দিলেন,

– এই গোলাপগুলো খুঁজতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। তাছাড়া আজ গোলাপের যা দাম, বাপরে! একটুখানি সস্তায় পাওয়ার জন্য কতটা রাস্তা যে হাঁটতে হলো…
– এগুলো কে আনতে বলেছে আপনাকে?
– বলতে হবে কেন? আজকের দিনে এগুলো না হলে চলে? আমি কি এতোই বোকা নাকি? মনে মনে বললাম,”আপনি যে কত চালাক, তার নমুনা বিয়ের পর থেকে প্রতি পদে পদে দেখতে পাচ্ছি আমি।” বরমশাই ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন,

– নাস্তা রেডি হয়েছে প্রিয়তি? খিদে পেয়েছে খুব। গলা উঁচিয়ে বললাম,
– ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে আসুন।

নাস্তার টেবিলে বরমশাই নিজের মত করে বেশ মনোযোগ দিয়ে নাস্তা করে যাচ্ছেন। পাশের চেয়ারটায় যে আমি অসহায়ের মত বসে আছি, সেদিকে খেয়াল নেই জনাবের। একবার জিজ্ঞেসও করছেন না, আমি নাস্তা করেছি কিনা। একসময় খিদে সহ্য করতে না পেরে জনাবের জিজ্ঞেস করার আশা বাদ দিয়ে নিজেই প্লেট নিয়ে বসে গেলাম। খেতে খেতে ভাবছিলাম, “এভাবে আর কতদিন পার করতে হবে কে জানে!”

বাজারের ব্যাগে এত বাজার দেখে হা হয়ে গেলাম আমি। এই বাজারগুলো একা গুছাতে গুছাতেই তো দুপুর পার হয়ে যাবে, আবার রান্না কখন করবো? এদিকে বুয়াটাও আজ ছুটি নিয়েছে। হয়তো বরের সাথে কোথাও ঘুরতে বের হবে। ওদেরই কপাল আসলে। বুয়ার কপালে যে সুখটুকু আছে, আমার পোড়াকপালে ততটুকুও নেই। বিষণ্ণ মন নিয়ে যখন বাজার গুছাচ্ছিলাম, ঠিক তখন বরমশাই রান্নাঘরে এসে হাজির হলেন। নিচু হয়ে বসে আমার সাথে হাতে হাতে কাজ করতে করতে বললেন,

– আজ আমরা দু’জন মিলে রান্না করবো। আমি তার দিকে না তাকিয়েই প্রতিউত্তর করলাম।
– লাগবে না। আমি একাই পারবো।
– তা হয়তো পারবে কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে আজকের রান্নাটা দু’জন মিলে একসাথে করতে।
আমি প্রসঙ্গ পালটে ফেললাম।

– সয়াবিন তেল আনেন নি? শেষ হয়ে গেছে বলেছিলাম, রাতে লিস্ট করার সময় লিখেও দিয়েছিলাম।
– ইশ্, একদম ভুলে গিয়েছি। ব্যাপার না, আমি এই যাবো আর আসবো। তুমি এর মধ্যে রান্নার প্রস্তুতি শুরু করে দাও।

ভেবেছিলাম, সয়াবিন তেল আনতে গিয়ে বরমশাই আরো একঘণ্টা বাইরে কাটিয়ে আসবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই তিনি ফিরে আসলেন। এসেই আর সময় নষ্ট না করে আমার সাথে রান্নার কাজে লেগে পড়লেন। আমি বারবার বারণ করছিলাম কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন। বললেন,

– বাজারগুলো তুমি একা গুছালে অনেকখানি সময় লাগতো। আমি সাহায্য করাতে দেখলে তো কতটা সময় বাঁচলো? রান্নার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হবে। তার উপর আজ আইটেম বেশি। স্পেশাল গেস্ট বলে কথা।

– কাদের আসতে বলেছেন আপনি, বলুন তো? চোখ নাচিয়ে বরমশাই উত্তর দিলেন,
– সারপ্রাইজ…
– কতজন আসবে সেটা অন্তত বলুন। নয়তো বুঝবো কি করে কয়জনের জন্য রান্না করবো?
– হুম। সেটা বলা যায়। বেশি না, ১০/১২ জন। তবে একটু বেশি করে রান্না করো, কাজে লাগবে।

বরমশাই বেশ ধৈর্য্য নিয়ে হাসিখুশিভাবে আমায় রান্নায় সাহায্য করেছেন। শুধু সাহায্য না, ইউটিউব দেখে দেখে দু’একটা পদ তিনি নিজেই রান্না করেছেন। ফলাফলস্বরূপ, দুপুর ১টার আগেই সব রান্না শেষ। তারপর তিনি গোসল সেরে চলে গেলেন মসজিদে আর আমি ঢুকে গেলাম গোসলে। গোসল সেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বরমশাইয়ের কথা রাখতে সবুজ রঙের নতুন সুতি শাড়িটা পরে হালকা পরিপাটি হয়ে নিলাম। ঘরেই যেহেতু থাকবো তাই আর সাজলাম না। নামাজ পড়ে এসে বরমশাই আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,

– এখন আমার উপর রেগে আছো তো? কিন্তু পরে ঠিকই আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে,”আজকের দিনে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারতো না। থ্যাংকস ফর এভরিথিং।” আমি শুধু ম্লান হেসে বললাম,

– রেগে আছি কে বললো!

খানিকবাদে আমন্ত্রিত অতিথিরা এক এক করে আসতে লাগলেন আর আমি চমকাতে থাকলাম। আমার বাসার কাজের বুয়াসহ এই বিল্ডিংয়ের প্রত্যেক ফ্ল্যাটের বুয়াদের তাদের বরসহ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বরমশাই। সবচেয়ে বেশি চমকে গেলাম, আমার বাবার বয়সী দারোয়ান চাচাকে চাচীকে নিয়ে আসতে দেখে। সবাই চলে আসলে আমরা আগে খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেরে নিলাম। খাবার টেবিলে দু’চোখ ভরে দেখছিলাম বরমশাই কতটা যত্ন নিয়ে নিজের হাতে সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছেন। তা দেখে আমার বাসার বুয়াটা একপর্যায়ে বলেই বসলো,

– ভাবী, আমার কিন্তু এহন লজ্জা লাগতাছে কইলাম। আমি থাকতে ভাইজান ক্যান এইডি করতাছেন? আপনি কিছু কন না। বরমশাই হাসতে হাসতে বুয়াকে বললেন,

– আজকে আপনারা আমাদের আমন্ত্রিত অতিথি। অতিথিদের দিয়ে কাজ করাতে শুনেছেন কখনো? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

– এই প্রিয়তি, ওই ভাইজানের প্লেটে মাংস নেই। মাংসের বাটিটা এদিকে দাও তো। পাশ থেকে উপরের ফ্ল্যাটের বুয়া বলে উঠলেন,

– আর বইলেন না আপা, দুলাভাই যেমনে আমাদের আসতে বলছেন, আমরা আর “না” করতে পারি নাই।
সাথে সাথে আরেকজনের বর তার সাথে তাল মিলাতে লাগলেন,

– জ্বী ভাবী, কুলসুম আইসা বলার পর আমি আজকে রিক্সা নিয়াই বাইর হই নাই। পরে যদি সময়মতো আইতে না পারি! তাছাড়া যে মানুষটা আমাদের কথা এমনে ভাবতে পারছে, তারে একবার চোখে দেখবারও স্বাদ আছিলো। ভাইজানরে দেহার লোভেই আরো তাড়াতাড়ি আইসা পড়ছি।

সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলেন, সাথে রান্নার প্রশংসাও করলেন। খাওয়াদাওয়ার পর বরমশাই সবাইকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফা আর চেয়ার মিলিয়ে গোল হয়ে বসলেন। বুয়ারা আর তাদের বরেরা সোফায় বসতে চাননি প্রথমে, বরমশাই ধমক দিয়ে বসিয়েছেন। আমি বরমশাইয়ের পাশে আসন করে বসলাম। বরমশাই সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন,

– আজকে কি দিবস জানেন আপনারা? কয়েকজন উত্তর দিলো আর বাকিরা মাথা নাড়ালো। যারা উত্তর দিলো তারা উত্তর দেয়ার সাথে সাথে এটাও বললো,
– এইগুলা আমাগো লাইগা না ভাইজান, বড়লোকের লাইগা। বরমশাই বললেন,
– ভালোবাসা দিবস আলাদা কোনো শ্রেণীর জন্যে না। সবার জন্যে। তাই এখন আমরা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। তার আগে মহিলারা প্রিয়তির সাথে একটু ভেতরের ঘরে যাবেন। বরমশাইয়ের কথামতো বুয়াদের আমি আমার ঘরে নিয়ে এসে তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাল গোলাপ দিয়ে বললাম,

– ফুলগুলো যে আমি দিয়েছি, এটা বরদের বলার দরকার নেই। উনারা ভাববে, আপনারাই সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক আছে? নিন, ফুলগুলো যার যার আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেলুন। একইভাবে ড্রয়িংরুমে বরমশাইও পুরুষদের হাতে গোলাপ দিয়ে বললেন, বউদের যেন একথা না জানায়। সবাই আবার একসাথে হলে বরমশাই প্রত্যেক বরদের দিয়ে তাদের বউকে প্রপোজ করতে বললেন। তাও আবার হাটু গেড়ে বসে সিনেমাটিক স্টাইলে। তবে কি বলতে হবে তা শিখিয়ে দিলেন না। বললেন, নিজেদের মত করে বলতে। একইভাবে মহিলাদেরও তাদের বরদের প্রপোজ করতে হবে। বাদ গেলেন না আমাদের বুড়ো দারোয়ান চাচাও! প্রথমবার কেউই রাজি হতে চাইছিলেন না, লজ্জা পাচ্ছিলেন। তারপর যখন বরমশাই বললেন,

– এমন সুযোগ বারেবার আসে না কিন্তু। এমনও হতে পারে, এর মধ্য দিয়ে এই স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরেই হয়তো আগের অনেক ভুল বুঝাবুঝি আর মনোমালিন্যের অবসান ঘটবে।

তখন আর কেউ অসম্মতি জানালেন না। ভরপুর আবেগ দিয়ে নিজেদের ভাষায় নিজেদের মত করে একে অপরকে ভালোবাসার কথা জানালেন। এ দৃশ্য দেখে কেন জানি নিজের অজান্তেই আমার দু’চোখ ঝাপ্সা হয়ে এলো। একরাশ ভালোবাসা নিয়ে বরমশাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। জমজমাট এক বিকেল আড্ডা শেষে সন্ধ্যার পর সবাই বের হয়ে গেলাম ফুচকা খেতে। যাওয়ার আগে বুয়াদের হাতে তাদের বাচ্চাদের জন্যে বক্সে করে খাবার দিয়ে দিলাম। ফুচকা খেয়ে এসে বরমশাই রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন সবকিছু পরিষ্কার করতে। আর আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– আরে কি হয়েছে? এভাবে ধরে আছো কেন? প্রতিউত্তরে আমি বললাম,
– সত্যিই আজকের দিনে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারতো না। থ্যাংকস ফর এভরিথিং। সবশেষে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে আমার ভালোবাসার কথা জানালাম,
– ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত