কপালে হাত দিয়ে দেখো আমার জ্বর।”
আমি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আয়েশাকে বললাম,
“প্যারাসিটামল খাও! জ্বর বেশী থাকলে নাপা এক্সট্রা।”
“বাসায় ঔষধ নেই।”
“অফিস থেকে ফেরার পথে বলোনি কেনো? সিলিং ফ্যানটা ছেড়ে দাও তো, গরম লাগছে।”
আয়েশা ফ্যানের সুইচ অন করলো। বারান্দা থেকে লুঙ্গি এনে এগিয়ে দিয়ে বিষন্ন গলায় বললো,
“আজকাল কি তোমার অফিসে কাজের চাপ বেশী থাকে? এতো রাত করে ফেরো! তোমার আম্মু খুব টেনশন করে।”
“শখ করে তো আর কেউ অফিসে বসে থাকে না। বলো থাকে?”
“এভাবে কথা কেনো বলছো? আম্মু বারবার তোমাকে কল দিতে বলে। তুমি ফোন না ধরলে সেই রাগ বিভিন্নভাবে আমার উপর ঝাড়ে।”
“সারাদিন ব্যস্ততা শেষে তোমাদের রাগারাগির টপিকস শুনতে ভালো লাগে না। ভাত দাও, খেয়ে ঘুমোবো। প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে আজ। আম্মু খেয়ে ঘুমিয়েছে?”
“তোমার কি মনে হয় তোমার মাকে আমি না খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি?”
“যেটুকু জিজ্ঞাসা করেছি সেটুকুর উত্তর দেওয়া যায় না?”
“না যায় না। এমন মেয়েকে বিয়ে করা উচিত ছিলো যাকে তুমি যেটুকু জিজ্ঞাসা করবে শুধু সেটুকুর উত্তর দিবে। খাবার টেবিলে ঢেকে রাখা আছে। খেয়ে নিও, আমি ঘুমোতে গেলাম।”
“আমি কি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি নাকি?”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়েশা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। অন্যদিন হলে সে আর কিছুক্ষন তর্ক করতো। আজ তার শরীর বেশ খারাপ বোঝা যাচ্ছে।
আমি খাবার খাচ্ছি। আম্মু বললেন,
“কে? খাবার টেবিলে ঠনঠন কে শব্দ করছে?”
“আমি আম্মু।”
“ওমা! সাদবিন তুই আজ ভরদুপুরে অফিস থেকে ফিরলি যে! সব ঠিক আছে তো?”
“এখন ভরদুপুর না আম্মু। রাত ১২টা ৩৩মিনিট।”
“তাহলে কালো বোরকা পড়া ভিখারি যে বললো, ‘ভর দুপুরে আইছি আম্মা খালি হাতে ফিরায়েন না।'”
“কোন ভিখারি?”
আম্মু কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
“কি সব আজগুবি স্বপ্ন দেখলাম। বউ মা কোথায়? বউ মা, আমাকে এক গ্লাস অর্ধেক ঠান্ডা-অর্ধেক গরম পানি দাও তো।”
আমি পানি নিয়ে যেয়ে বললাম,
“আয়েশা ঘুমোচ্ছে আম্মু। তার শরীরটা ভালো না।”
“কি হয়েছে বউমার? সন্ধ্যায় তো তাকে দেখলাম টিভিতে ফুল সাউন্ড দিয়ে কি সব দেখছে। আর অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়ছে।”
“দেখুক না। সমস্যা কি?”
“সমস্যার কথা তো বলিনি আমি। আমি চশমা দিয়ে এই রুমে কোরান-হাদিসের বই পড়ি। আর সে অন্য রুমে টিভিতে সাউন্ড দিয়ে এতো জোড়ে হাসবে এটাকে কোনো সুস্থ মানুষের ঘর বলে?”
“বাদ দাও।”
“সবই তো বাদ দিয়ে রাখলাম। তুই বিয়ে করলি আর আমিও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লাম। তারপর থেকে সবকিছু বদলে গেলো।” আম্মু আরো কিছুক্ষন একা-একা কথা বললো। আমার খাবার শেষ করার পর কিছুতেই ঘুম আসছে না। টিভি আস্তে সাউন্ড দিয়ে সোফায় বসে বসে চ্যানেল ঘোরাচ্ছি। আম্মু বলে উঠলো, “বউ মা, আবার টিভিটা অন করেছো। এতোক্ষন আমাকে ঘুমোতে দাওনি, এখন আমার ছেলেকেও ঘুমোতে দেবে না।”
আমি টিভি অফ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। চোখ জুড়ে কখন ঘুম নেমে আসলো কে জানে! রাত ৩টার দিকে আয়েশার কি জানি হলো। চাপা স্বরে ডাকলো, “সাদবিন শুনছো?” প্রথমে ভাবলাম ঘুমের ঘোরে আয়েশার ডাক শুনছি।কিন্তু তার পরপরই সে বক-বক শব্দে বমি করতে লাগলো। সবকিছু এলোমেলো হতে শুরু করলো। হঠাৎ যখন ঘুম ভাঙে আমি সাথে সাথে উঠে বসতে পারিনা। কিছুক্ষন সময় নেই। কিন্তু আজ সাথে সাথে উঠে বসলাম। লাইট অন করে দেখলাম আয়েশা ওয়াশরুমের দরজা খুলেই বমি করছে।
কাছে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করলাম। আয়েশা বললো,
“অস্থির হয়ো না।”
“তোমার শরীর সত্যি অনেক খারাপ দেখছি।”
“শরীর আবার মিথ্যা মিথ্যা খারাপ হয় নাকি? রান্নাঘরে লাল রঙের কৌটায় তেঁতুল রাখা আছে। নিয়ে আসো তো।”
“তেঁতুল দিয়ে কি হবে? আমি ডাক্তারের কাছে ফোন দিচ্ছি।”
“এখুনি ডাক্তার-ফাক্তার লাগবে না। যা বলছি তাই করো।” আমি রান্নাঘর থেকে তেঁতুল আনতে যেয়ে হলুদের কৌটা ফেলে দিলাম। আম্মু চেঁচিয়ে বললো,
“বউ মা, তুমি আবার টিভি অন করেছো?”
“আমি আম্মু। কেউ টিভি অন করেনি, তুমি ঘুমাও।”
“তুই কখন অফিস থেকে ফিরলি? বউ মাকে কতবার ফোন দিতে বললাম, দিলো না। একটা কথা যদি আমার শুনতো আফসোস থাকতো না। নিজের যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন বুঝবে।”
আয়েশা হাত-মুখ ধুয়ে তেঁতুল মুখে দিয়ে বসলো। আমি বললাম, “তুমি ঠিক আছো তো?” “তোমার আম্মুকে বলো আমারও এখন টেনশন করার সময় এসেছে। আমি মা হতে চলেছি।” আমি যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক সেভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। আয়েশা তেঁতুল খেতে খেতে বললো, “সোফায় কেনো ঘুমিয়েছিলে? তুমি জানো না আমি সোফায় শোয়া একদম পছন্দ করিনা? কুসনের কাভার নোংরা হয়।” আমি তার পাশে বসলাম। আস্তে করে আমার ডান হাত তার বাম হাতের উপর রাখলাম। কাঁপা গলায় বললাম, “সত্যি আমি বাবা হবো?”
আয়েশা তেঁতুল মুখে ‘টাহ’ শব্দ করে বললো, “আমি মা হলে তুমি তো আর খালু হবে না, তাই না?” আমি মুচকি হেসে অন্যদিকে তাকালাম। আয়েশা বললো, “আশ্চর্য তো ! মা আমি হচ্ছি আর লজ্জা তুমি পাচ্ছো।” “তুমি কি শিওর?” “কেনো? তুমি শিওর ছিলা না নাকি?” আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। সেই হাসি গভীর রাতে চারদিকে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। আম্মু চেঁচিয়ে বললেন, “বউ মা, টিভির সাউন্ডটা একটু কমানো যায় না? এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। মানুষজন ঘুমোচ্ছে।” আম্মুর কথা শুনে আয়েশাও হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখলো।
আমি মনে মনে বললাম, “আমি জানি কতো অভিযোগ তোমার আমার প্রতি! কতো অভিমানের ভালোবাসা! সারাজীবন এভাবেই হাতে হাত রাখো কিংবা মাঝেমধ্যে কাঁধে মাথা রেখে মনে করিয়ে দাও তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার তো শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে প্রয়োজন। বড্ড প্রয়োজন!”