ভ্যালেন্টাইন ডে

ভ্যালেন্টাইন ডে

-আম্মু,আমাকে ২০০০ টাকা দাও তো।আমি একটু পরে বের হবো,বলল রাফি।

সিনথিয়া রহমান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাফির রুমে প্রবেশ করলেন।রাফির দিকে তাকিয়ে বললেন,২০০০ টাকা দিয়ে কি করবি,বাবা?

-আহ,মা,ভুলে গেলে আজকে কত তারিখ?তোমাকে তো এক সপ্তাহ আগেই বলে রেখেছিলাম,১৪ ফেব্রুয়ারি বন্ধুরাসহ একটু ঘুরতে বের হবো,একটু বিরক্ত হয়ে বলল রাফি।

-তা অবশ্য বলেছিলি।কিন্তু বাবা,আমি যে একটু অন্য চিন্তা করে রেখেছিলাম,একটু মন খারাপ হয়ে বলল সিনথিয়া রহমান।

-তুমি আবার কি চিন্তা করে রাখছো,আম্মু,আলমারি থেকে শার্ট হাতে নিয়ে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল রাফি।

-তোর পছন্দের সব রান্না করবো আজকে।ভেবেছিলাম,দুপুরে দুইজনে একসাথে খাবো।তোমার বাবা তো ব্যবসায়ের কাজে বাইরে থাকে,তাকে তো সবসময় পাওয়া যায় না,বলল সিনথিয়া রহমান।

-আচ্ছা আম্মু,আমি রাতে এসে তোমার সাথে একসঙ্গে বসে খাবো।এখন বন্ধুদের কথা দিয়ে আর বারন করতে পারবো না।আমি বের হবো,তুমি প্লিজ না করো না,বলল রাফি।

-আচ্ছা ঠিক আছে,রাতেই তবে একসাথে খাবো,সিনথিয়া রহমান একটু হাসার চেষ্টা করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

গলির মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাফি।কি যেন চিন্তা করছে মাটির দিকে তাকিয়ে।হঠাৎ চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে মাটিতে পড়ল।চোখের পানিতে মাটি ভিজে গেল।হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সকাল ১০ টা বাজে।মাটির চুলায় চায়ের কেটলিতে ধোঁয়া উঠছে।রাস্তায় আর দাঁড়িয়ে না থেকে এলাকার বিখ্যাত চায়ের দোকান “টিটু টি স্টল” এর ভেতরে ঢুকে পড়ল রাফি।সকালের দিকটায় মানুষ চা খেতে একটু বেশি ভিড় করে।ভেতরে ফাঁকা জায়গা থাকে না বললে চলে।একটু আড়াল করে বেশ ভেতরে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল রাফি।দোকানের ক্যাশিয়ারে বসা লোকটার সামনের দেয়ালে স্টিলের পাঁতে ভর দিয়ে টিভি ঝুঁলছে।সকাল ১০ টার খবর সম্প্রচার হচ্ছে।দোকানে বসা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সবাই চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার সাথে টিভির দিকে চোখ রাখছে গভীর মনোযোগে।রাফি দোকানে থাকা ছেলেটিকে ইশারায় একটা মালাই চা দিতে বলল।এই দোকানের মালাই চা খুব বিখ্যাত।দূর-দূরান্তের অনেকে এসে এই চা এর স্বাদ নিতে ভিড় করে।টিভিতে একটা টিউন বেজে উঠল।টিউনটি রাফির কাছে বেশ ভালো লাগল।

কৌতূহল হয়ে মাথা তুলে টিভির দিকে তাকালো রাফি।সংবাদ উপস্থাপিকা মিষ্টি গলায় বলছে,”আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি।বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।এই দিনে সবাই প্রিয় মানুষটার সাথে হাঁটতে বের হয়,উপভোগ করে ভালো কিছু সময়।তবে আমরা এই দিনটি কাটাবো তাদের সাথে যারা শেষ বয়সে বোঝা হয়ে নির্জনে কাটায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।বলছি,বৃদ্ধাশ্রমের কথা।এখানে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার গল্প করার মতো তাদের সমবয়সী অনেকে আছে।কিন্তু সারাজীবন পাশে থাকা অর্ধাঙ্গিনী মানুষটুকু আজ নেই,চলে গেছে পরপারে। রাফির কানে কথাগুলো যেন বেশ জোরে আঘাত করল।চা এর কাপে দেয়া চুমুকে আর স্বাদ আসছে না প্রতিদিনের মতো।চায়ের কাপটুকু একপাশে রেখে পকেট থেকে ফোন বের করল রাফি।ও’পাশ থেকে মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসল।

-হ্যালো,রাফি,তুমি কোথায়?আমি তো বাসা থেকে বের হয়েছি মাত্র,বলল মেয়েটি।

-আনিশা,আমি আমাদের গলির মোড়ে চায়ের দোকানে বসে আছি,বলল রাফি।

-কি,তুমি এখনও বের হও নাই!আমার আসতে মাত্র ৫ মিনিট লাগবে।তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠে পড়ো।আজকে দেরি হলে কিন্তু খবর আছে তোমার,বলল আনিশা।

-শুনো না,আনিশা,তুমি রিকশাওয়ালা মামাকে আমাদের এলাকায় আসতে বলো।আজকের দিনটা একটু স্পেশালভাবে সেলিব্রেট করতে চাই আমি,বলল রাফি।

-তোমার কথাটা তো সুবিধার মনে হচ্ছে না।তুমি কি আমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে নাকি?দেখো,আমি এসব এখন করবো না,রাফি,বেশ রেগে বলল আনিশা।

-দূর,কি বাজে চিন্তা করছো তুমি!তুমি আসলে সব খুলে বলবো তোমাকে।গলির মোড়ে এসে আমাকে কল দিও,এই বলে ফোন কেটে দিল রাফি।চা মোটামুটি ঠান্ডা হয়ে গেছে।কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে না।ফোন পকেটে রেখে চা খেতে শুরু করল রাফি।

রান্না শেষ করে টেবিলে এসে বসে পড়ল সিনথিয়া রহমান।শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছলেন।ভাবতে লাগলেন,ছেলেটা তার সত্যিই বড্ড বড় হয়ে গেছে।এইতো কিছুদিন আগে রাফিকে স্কুলে গিয়ে দিয়ে আসতেন তিনি।আবার স্কুল ছুটির পর গাড়িতে করে নিয়ে আসতেন।সেই রাফি এখন কত বড় হয়ে গেছে!বন্ধুদের নিয়ে একা একা ঘুরতে পারে।সিনথিয়া রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,সত্যিই অনেকদিন হলো রাফির আব্বু দেশের বাইরে।

ছেলেটাকে নিয়ে একসাথে ভাত খাবে সেটাও সুযোগ হয়ে উঠে না।সারাক্ষন বাইরে বাইরে থাকে।আজ শুক্রবার ভেবেছিল,দুপুরে একসঙ্গে ভাত খাবে।কিন্তু তা আর হলো কই!ছাদের উপরে কিছু পড়ার শব্দে সিনথিয়া রহমানের ভাবনার ছেদ পড়ল।সকাল থেকে ছাদে একটু বেশি শব্দ কানে আসছে।আজ তো ছাদ পরিষ্কার করার সময় আসেনি।তাহলে ছাদে কে হাঁটাহাঁটি করছে?চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠল।পেছন ফিরে দরজার সামনে এসে ডোর লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলেন সিনথিয়া রহমান।দেখতে পেলেন,রাফি দাঁড়িয়ে আছে।দরজা খুলে বললেন,কি ব্যাপার রাফি,ঘুরতে যাস নি?এত তাড়াতাড়ি চলে আসলি যে?

-আম্মু,আমার সাথে একটু ছাদে চলো।তোমার সাথে কথা আছে জরুরি,বলল রাফি।

-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,রাফি?ছাদ থেকে বারবার আওয়াজ আসছে।আবার তুইও বলছিস,ছাদে যেতে!ছাদে হচ্ছে কি?জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

-আহা বললাম তো,জরুরি কথা আছে,এই বলে রাফি এক প্রকার জোর করে দরজার বাইরে নিয়ে আসলেন তাকে।তারপর দু’হাত দিয়ে চোখ বন্ধু করে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল রাফি।বাড়িটা দু’তলা বিশিষ্ট।কয়েকটা সিড়ি উপরে উঠতেই ছাদের সিড়ির দরজায় এসে পড়ল দুইজনে।সিনথিয়া রহমান তখনও রাফিকে জিজ্ঞেস করে চলছে,চোখ বন্ধ করে কোথায় যাচ্ছি আমরা? রাফি দু’হাত সরিয়ে বলল,এবার চোখ খুলে সামনে দেখো আম্মু। সিনথিয়া রহমান চোখ খুলতেই,সবাই উপরে স্প্রে করে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে আম্মু!আনিশা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরল সিনথিয়া রহমানকে।তার সঙ্গে আছে অর্ণব,রাহি,রাতুল আর আরাফ।রাফি তখনও হাতে তালি দিয়ে হাসতে হাসতে বলছে,হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে আম্মু।

-এই পাগল ছেলে,এসব কখন করলি?আর তোমরা সবাই কখন আসলে বাসায়?এত কম সময়ে এত কিছুর আয়োজন?বিস্ময়ে বলল সিনথিয়া রহমান।

-প্রতিটা দিনই তো আমরা বন্ধুদের সাথে সময় নষ্ট করি।আজকের ভ্যালেন্টাইন ডে না হয়,তোমার সাথে পালন করি,আম্মু।পৃথিবীর সকল ভালোবাসার কাছে যে মায়ের ভালোবাসা শ্রেষ্ঠ,দৌঁড়ে এসে সিনথিয়া রহমানকে জড়িয়ে ধরে বলল রাফি।

সিনথিয়া রহমানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।ভাবছেন,সত্যিই ছেলেটা তার বড় হয়েছে ভীষণ।সবাইকে বললেন,আজ সবাই একসাথে খাবার খাবো।চলো সবাই,নাহলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। সবাই বেশ হুল্লোড় করে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল।দুপুরের কড়া রোদের উজ্জ্বল আলোতে প্লেকার্ড কাগজে লিখা লেখাটা জ্বলজ্বল করছে-“ভালোবাসি তোমায় আম্মু”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত