আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি।আজ ফেব্রুয়ারি মাসের ১১তারিখ। গতকাল স্যালারি পেয়েছি।স্যালারি পেয়েই বাড়িতে মাকে পাঠিয়ে দিয়েছি ৫০০০টাকা।রুম ভাড়া, দোকান বাকি সব দেয়া শেষ। বড় আপুকেউ ১০০০টাকা দিয়েছি। ভাগ্নেটা আমার কাছে আবদার করেছে।ছোট ভাইয়ের কোচিং ফি আজ পাঠিয়ে দেব স্যারের নাম্বারে।মাসের স্যালারি হওয়ার পরের কয়েকদিন একটু ভালো লাগে, কাজ করে পারিশ্রমিক পাওয়ার আনন্দে।তবু আজ কেন যেন মনটা বড্ড উদাসীন হয়ে আছে।
টেবিলে এত কাজ জমে আছে, তবু কাজে হাত দিতে ইচ্ছে করছেনা।এটা তো আর নিজের বাড়ি নয় ইচ্ছে হলে কাজ করলাম, না ইচ্ছে করলে করলামনা।এটা একটি অফিস আমাকে রাখাই হয়েছে তাদের কাজের জন্য। টাকা পাঠিয়েছি মাকে বলা হয়নি। তাই মাকে কল দিলাম হ্যালো হ্যালো মা আমি দৃষ্টি। হ্যা মা বল।কেমন আছিস তুই? আমি ভালো আছি।তোমরা সবাই কেমন আছো? আমরাও ভালো আছি। হ্যাঁ মা শোনো যা বলার জন্য কল করেছি।হ্যাঁ বল।
মামুন ভাইয়ের বিকাশ একাউন্টে টাকা দিয়েছি ৫০০০ খরচসহ দিয়েছি।তুমি গিয়ে বললেই দিয়ে দিবে।আচ্ছা ঠিক আছে যাবনি বিকেল করে। ৫০০০টাকায় হবে তো তোমাদের? হ্যাঁ হবে তুই চিন্তা করিসনা। আর নিরভকে বলিও ওর কোচিং এর টাকা আমি ওর স্যারের একাউন্টে পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা বলবনি।তোর মুখের কথা কেমন যেন লাগছে!তুই ভালো আছিস তো?? তাহলে তখন জিজ্ঞাসা করলে কেন কেমন আছি? জিজ্ঞাসাটা করতেই হয়।এবার বল কি হয়েছে তোর? নাহ মা কিছুই হয়নি।আমি ভালোই আছি। এক কাজ করে ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে যা।না মা এখন ছুটি হবেনা।ছুটি যখন হবে তখন নাহয় আসব।আচ্ছা মা রাখি। স্যার আসতেছে।(মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি কল কেটে দিলাম।)
এই-যে, মিস দৃষ্টি। আপনাকে যে ডেকে পাঠালাম আসলেননা কেন? কোথায় স্যার আমাকে তো কেউ ডাকেনি।কেন আপনাকে রাজু সাহেব ডাকতে আসেনি। কোথায় তিনি তো আমাকে ডাকেনি। যাই হোক, এবার বলুন কে কল দিয়েছিলো? আমিই কল করেছিলাম আম্মুকে কাল টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি সেটা বলার জন্য। আপনার এই গুনটা আমার ভালো লাগে। কোন গুন স্যার? এই যে,সত্য কথাটি বললেন।অন্য কেউ হলে বলত আম্মু কল করেছিল।সত্য বলতে ভয় পায় সবাই। আচ্ছা স্যার আমাকে ডেকেছিলেন কেন? শুধু আপনাকে নয় ডিপার্টমেন্টের সবাইকে ডাকা হয়েছিল। সরি স্যার আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।
আচ্ছা বাদ দিন। এখন যেই কথা হলো সেইটা শুনেন…আগামী ১৪ফেব্রুয়ারি তো শুক্রবার।ওই দিন তো অফিস এমনিতেই বন্ধ।এখন আমরা চাচ্ছি সাথে আরো দুইদিন করে ছুটি নিয়ে সকলে কুয়াকাটা ভ্রমণে যাব।সবাই রাজি। আপনি যাবেন তো? স্যার আমি যদি না যাই কিছু হব? কেন মিস দৃষ্টি কোনো সমস্যা?? না স্যার সমস্যা নয়। তাহলে যাবেন না কেন? স্যার বাড়ির জন্য মন চাচ্ছে খুব। কিন্তু সবাই আগে বলে রেখেছে ছুটির কথা তাই আমি আর বলিনি। আমি ওইসব কিছু জানতে চাইনা।আপনিও আমাদের সাথে যাচ্ছেন এটাই শেষ কথা। আর শুনুন ছুটির পরে ভ্রমণের ফি টা দিয়ে যাবেন। কিন্তু স্যার আমি তো টাকা সাথে নিয়ে আসিনি। সেটা আমার জানার বিষয় নয়। আপনি ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবেন।
স্যার চলে গেলেন।মন এমনিতেই খারাপ ছিল স্যার এসে আরো খারাপ করে দিল।টাকা চাইলে যে কোনো কলিগের কাছেই পাব। কিন্তু চাইলামনা।অফিস শেষে স্যারের কক্ষে গেলাম। স্যার আসব? হ্যাঁ আসুন।একটি কাগজ নিন সেটাতে আপনার নাম লিখে সাথে টাকাটা পিনআপ করুন। স্যার আমি ফি নিয়ে আসিনি। কেন??আপনাকে আমি কি বলে এসেছিলাম তখন?? আপনি বলেছিলেন যাওয়ার সময় ফি জমা দিয়ে যেতে। তাহলে আনেননি কেন?..এই অফিসে কাজ করছেন কতদিন হলো?? স্যার ৬মাস হয়ে গেছে। ছুটি কাটিয়েছেন কয়দিন? ছুটি কাটানো হয়নি। তাহলে তো আম্মু আর ভাই বোনদের সাথে দেখাও হয়নি।জ্বি স্যার। আপনি এক কাজ করবেন কাল অফিস চলাকালীন সময়ে ছুটির ফরম এনে সাইন নিয়ে যাবেন আমার। স্যার তাহলে পিকনিকের কি হবে? আমি সবার মতামত নিয়েই আপনাকে বলছি। আচ্ছা ঠিক আছে স্যার।তাহলে আমি আসি এখন। আচ্ছা যান।
যাক অবশেষে বাড়ি যাচ্ছি।বাড়ি যাওয়ার পেছনে আরো একটি কারণ আছে।আব্বু মারা গেলেন ২০১৮সালে।বড় ভাইয়া সংসারের হাল ধরলেন।খুব সুন্দরভাবে চলছিল আমাদের জীবন। বড় আপুকেউ বিয়ে দিলেন ভাইয়া।কিন্তু সব সুখ সবার কপালে সহ্য হয়না। সেদিন ছিল২০১৯ এর ২৭শে রমযান।আপুর বাড়িতে ঈদের কেনাকাটা করে দিয়ে সন্ধায় মাগরিবের আযানের সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে ভাইয়া এক্সিডেন্ট করে আমাদের সবাইকে একা রেখে চলে গেলেন।আম্মুর শুধু তখন বলছিল আমার সংসারের হাল ধরার আর কেউ রইলনা। আমি তখন অনার্স শেষ বর্ষে পড়ি।পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা চলে আসলাম।
আমাদের এলাকার এক বড় ভাইয়া জব করত এখানে।তার সাথে যোগাযোগ করে এই অফিসে জব হলো আমার।অফিসের সবাই অনেক ভাল।সবাই অনেক সাপোর্ট করে আমায়।অফেসে আসলে ভুলে যাই আমার আলাদা একটি পরিবার আছে।মনে হয় এটাই আমাদের একটি হাসিখুশি সুখি পরিবার। ছুটি পাস হওয়ার পর স্যার বললেন… অফিস সময়ের ১ঘন্টা আগে বেরিয়ে যেতে। যেহেতু এই ঢাকা থেকে আমাকে যেতে হবে সেই উত্তরবঙ্গে। বাস কাউন্টারে বসে আছি।আম্মুকে একটা কল দিলাম হ্যালো হ্যালো মা আমি দৃষ্টি। হ্যাঁ বল।আমি বাড়ি আসতেছি। কবে?
আজ রওনা দিচ্ছি কাল সকাল ১০টা নাগাদ পৌছে যাব।আচ্ছা দেখেশুনে আসিস।(ফোন রেখে দিলাম) বাসে যেতে যেতে অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পরছিলো। কিভাবে ঢাকা এলাম।কিভাবে এতদিন একা একা এই শহরে থাকলাম।পরে মাঝরাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করার জন্য একটি হোটেলের সামনে থামালো।ব্রেকফাস্ট করে আবার বাসে উঠলাম।পৌনে ১০টায় আমাদেএ স্টান্ডে বাস থামলো।বাস থেকে নেমে দেখি নিরভ দাড়িয়ে আছে।কিরে নিরভ তুই এখানে? হুম তুমি আসবে তাই আম্মু পাঠিয়ে দিলো। মা না পাঠালে বুঝি আসতিনা। অবশ্যই আসতাম। চল বাড়ি চল।
বাড়ি এসে দেখি আপুও এসেছে। আপু আমাকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল।আপু আমাকে জড়িয়ে কান্না করে দিয়েছে। আম্মুর চোখেও দেখি পানি টলমল করছে।দুইদিন সবার সাথে খুব আনন্দে কাটিয়ে আবার ব্যস্ত শহরে ফিরার জন্য রেডি হচ্ছি। মা পাশে দাড়িয়ে আছে। মা তোমাকে একটা কথা বলব? হ্যাঁ বল। আম্মু তুমি কি এখনো ভাবো তোমার সংসারের হাল ধরার কেউ নেই? না’রে মা এখন আর এসব চিন্তা করিনা।চিন্তা হয় তোকে নিয়ে। কি খাচ্ছিস। কিভাবে থাকিস। অসুস্থ হলে কিভাবে কি করিস। মা তোমরা আমাকে ভালবাসো তাইনা। ভালবাসবোনা কেন এভাবেই আমাকে ভালোবেস। আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম।এরপর আবার রওনা হলাম ভালবাসার মানুষগুলোর মুখে হাসি রাখতে।