ভালবাসায় বিশ্বাসী

ভালবাসায় বিশ্বাসী

— এই মায়মুনা এদিকে আসো।
— কি হয়েছে বলো।
— আরেকটু কাছে আসোনা।
— আচ্ছা বাবা আসলাম। এবার বলো কি হয়েছে?
— ভালবাসি তোমায় জীবনের থেকেও বেশি।
— তো কি হয়েছে?
— তুমি কি আমায় ভালবাসো না?
— দেখো আরমান তোমাকে আগেও বলেছি আর এখনো বলছি আমরা শুধুই বন্ধু। এর বেশি কিছু চিন্তা করার অধিকার তোমাকে দেইনি।
— আমাকে ভালবাসতে সমস্যা কোথায়?
— কোন সমস্যা নেই। তবে আমি ভালবাসায় বিশ্বাসী না। ভালবাসা মানে একটা মায়াজাল। এ জালে নিজেকে জড়াতে চাইনা।
— কিন্তু আমি তো নিজেকে তোমার ভালবাসার জালে আটকে ফেলেছি।
— আজ শেষবারের মত বলছি আরমান এরপর যদি আর কোনদিন ভালবাসি বলো তাহলে তোমার আমার বন্ধুত্ব এখানেই শেষ।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— আচ্ছা আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। তুমি কি আসবে আমার সাথে?
— নাহ আমি আরো কিছুক্ষন এখানে বসবো। তুমি যাও।
— ঠিক আছে।
..
মায়মুনা চলে যাচ্ছে। আমি ওর ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি। মায়মুনাকে আমি এই নিয়ে বিশবার প্রপোজ করলাম। কিন্তু প্রতিবার তার একই উত্তর, ভালবাসায় আমি বিশ্বাসী নই।
মায়মুনা চলে গেছে। চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু আমি তো একজন পুরুষ। আমি কিভাবে কাঁদবো?
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর কোনদিন আমি মায়মুনাকে বিরক্ত করবো না। ও থাকুক ওর মত। পৃথিবীর নিয়মটাই যেন এমন, যাকে সবচেয়ে আপন করে পেতে চাই সেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে।
..
বাসায় এসে আম্মুর কাছ থেকে বেশকিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য গ্রামের বাড়ি থেকে কিছুদিন ঘুরে আসবো। তাতে হয়তো মায়মুনাকে ভুলতে পারবো।
মোবাইল বন্ধ করে দিলাম, ফেবু ডিএক্টিভেট করলাম। যোগাযোগের বাইরে থাকতে চাই কিছুদিন।
..
আমাদের গ্রামের বাড়ি নাটোর জেলার নলডাঙ্গা থানার পাবনাপাড়া গ্রামে। খুবই সুন্দর জায়গা, চারদিকে সবুজ আর সবুজ। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই একটা খাল বয়ে চলেছে। খাল বললে ভূল হবে, কারন এই খাল নদীর মত বিশাল।
বাসে উঠে বসে আছি। বাস তার আপন গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। আমার চোখে হালকা হালকা ঘুম ধরেছে।
..
— ভাই নলডাঙ্গা আইসা পড়ছে নামেন।
বাসের হেলপারের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ঘুমিয়ে ছিলাম। মোটামুটি শরীরটা সতেজ লাগছে।
দুপুর দুইটায় বাসে উঠেছিলাম। এবার এক ঘন্টা আগেই পৌছে গেছি। বাসস্টপ থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা দাদার বাড়ি।
..
আমাকে দেখে দাদা বাড়ির সবার খুশি আর ধরে না। সবাই আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
— কিরে ভাই একা এলি কেন? তোর বাবা মা কি তোর সাথে আসতে পারলো না? (দাদা)
— দাদু তুমি তো জানোই বাবা কত ব্যস্ত মানুষ। সবসময় শুধু টাকার পিছনে ছুটছে। তার কাছে কি বেড়াতে যাওয়ার সময় আছে? (আমি)
— তোর মা তো আসতে পারতো।
— আসলে দাদু আমি কাউকে না জানিয়েই চলে এসেছি।
— কেন রে? বাসায় কি ঝগড়া করে এসেছিস নাকি?
— আরে নাহ, তোমাদের দেখতে ইচ্ছে হলো তাই চলে এলাম।
— এসেছিস ভাল হয়েছে। এখন হাত মুখ ধুয়ে আয় তারপর খেতে বস। কইরে রাজিয়া আরমানকে ভাত বেড়ে দে।
— আসছি দাদু। (রাজিয়া)
..
রাজিয়া আমার চাচাতো বোন। ছোটবেলায় ও আর আমি একসাথে খেলতাম।
— ডাকছো কেন দাদু? (রাজিয়া)
— আরমানকে খেতে দে। কতদিন পর এলো। (দাদু)
— ওমা আরমান তুই এসেছিস? আর আমি টেরই পেলাম না।
— কিভাবে পাবি? সারাদিন তো শুধু টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াস। কোন খবর রাখিস?
— চুপ করো দাদু। চল আরমান তোকে ভাত দিচ্ছি।
..
মেয়েটা কি সাবলিল ভঙ্গিমায় কথা বলে। ঠিক মায়মুনার মত।
আমি হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসলাম।
— কিরে খাচ্ছিস না কেন? (রাজিয়া)
— কই খাচ্ছি তো। (আমি)
— হুম বুঝতে পারলাম। মায়মুনা তোকে আবারো রিজেক্ট করেছে তাই না?
এক গ্রাস ভাত মুখে দেওয়ার জন্য তুলেছিলাম কিন্তু রাজিয়ার কথা শুনে মাঝপথেই হাতটা থেমে গেল।
— কি বললি?
— কই কি বললাম?
— কি যেন বললি মায়মুনার ব্যাপারে?
— বললাম আবারো কি তুই প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এখানে এসেছিস?
— তুই কি করে জানলি?
— আমি সব বুঝি। ইশ তুই যদি মায়মুনাকে ভাল না বেসে আমাকে বাসতি তাহলে কতই না ভাল হতো। তোর মত একটা কিউট ছেলে পেলে আজই বিয়ে করে ফেলতাম।
— পাগল নাকি? কি বলিস আবোল তাবোল? মাথা কি পুরো গেছে?
— মাথা ঠিকই আছে। তোর সাথে যেকোন মেয়েই প্রেম করতে রাজি আছে শুধু তোর ঔ মায়মুনাই তোকে দাম দেয় না।
— রাজিয়া আর কোন কথা বলিস না। এ প্রসঙ্গে কথা বলা বন্ধ।
..
আজ আঠার দিন হলো আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। খুব বোরিং লাগছে। কলেজের বন্ধুগুলোকে অনেক মিস করছি। সাথে আরো একজনকে মিস করছি। যাকে ভুলতেই আমার এখানে আসা। কিন্তু তাকে ভুলতে পারিনি, সারাক্ষন শুধু তার কথাই মনে হয়েছে। চাইলেই কি আমি তাকে ভুলতে পারবো?
..
অবশেষে বিশ দিনের মাথায় আমি ঢাকায় চলে আসলাম। আর ভাল লাগছিল না। বাসায় এসেই আগে গোসল করে একটা ঘুম দিলাম। বিশাল লম্বা এক ঘুম হলো।
..
আমার মোবাইলে কেউ একজন ফোন করেছে। কিন্তু আমার ফোন বন্ধ ছিল। তাহলে কল আসলো কি করে?
অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করেছে। তাই ফোন ধরলাম না। একবার, দুইবার, তিনবার। এভাবে বারবার ফোন দিচ্ছে। অনেকটা বিরক্ত হয়েই ফোন ধরলাম।
— হ্যালো আরমান?
— জী কে বলছেন?
— আমি মায়মুনার বড় বোন বলছি।
— জী আপু বলুন।
— তুমি তাড়াতাড়ি সিটি হাসপাতালে চলে আসো।
— কি হয়েছে আপু? হঠাৎ হাসপাতালে কেন?
— (কাঁদতে কাঁদতে) প্লীজ তুমি তাড়াতাড়ি আসো।
— আপু কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে?
— মায়মুনা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারাত্বক ভাবে জখম হয়েছে। মনে হয় আর বাঁচবে না। প্লীজ তুমি আসো। একয়েকদিন ও শুধু তোমাকেই খুঁজেছে। প্লীজ তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। ( কাঁদতে লাগলো)
..
মাথাটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। চারপাশ দুলতে শুরু করেছে। ভুমিকম্প হচ্ছে নাকি?
কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে সবই দুঃস্বপ্ন।
..
অতিদ্রুত হাসপাতালে পৌছে গেলাম। মায়মুনা তখন অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। আর আমি নিজের সাথে লড়াই করছি।
মায়মুনা কি আমাকে ভালবাসতো? যদি ভাল না বাসে তাহলে কেন আমি গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পর আমাকে পাগলের মত খুঁজেছে?
আজও সে আমাদের বাসায় যাচ্ছিল আমার খোঁজ নিতে। পথিমধ্যেই এক্সিডেন্ট হয়েছে।
..
অবশেষে অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। ডাক্তার বলেছে সে এখন বিপদমুক্ত। প্রায় পনের ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরলো।
প্রথমে ওর বাবা মা বোন ওর সাথে দেখা করলো। তারপর আমার পালা।
..
আমি বসে আছি ওর পাশে। ওর পুরো মাথা সাদা ব্যান্ডেজে জড়ানো। হয়তো খুবই কষ্ট হচ্ছে ওর। আমার চোখ ভিজে উঠেছে।
— কেন আমাকে এতদিন খুঁজেছো? তুমি তো ভালবাসায় বিশ্বাসী না। তারপরও কেন?
— (ঠোট কাঁপছে। হয়তো কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু বলতে পারছে না।)
— তোমাকে কিছুই বলতে হবেনা। আজ আমি বলবো তুমি শুধু শুনবে। তুমি আমাকে ভালবাসো আর নাইবা বাসো আমি তোমাকে চিরদিন ভালবেসে যাবো। তোমার আর আমার বন্ধুত্ব থাকুক আর নাইবা থাকুক আমি তোমাকে আজীবন ভালবেসে যাবো।
তুমি ভালবাসায় বিশ্বাস করো আর নাইবা করো আমি তোমাকে সবসময় ভালবাসি।
— (হাত বাড়িয়ে দিল আমাকে। হাত ধরার আহ্বান।)
— (হাত ধরে) মনে রেখো আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে দেব না। যেখানেই যাবে আমি তোমার সাথে থাকবো। যদি আমি মারা যাই তারপরও ভূত হয়ে তোমার পাশে থাকবো।
— (ঠোট নড়ছে)
— (মাথাটা এর মুখের কাছে নিয়ে) বলো কি বলবে। তবে ভালবাসায় বিশ্বাসী না এই কথাটা বলোনা প্লীজ।
— (খুব আস্তে) অন্য কারো ভালবাসায় বিশ্বাসী নই তবে…..!
— তবে কি?
— আমার পাগলটার ভালবাসায় বিশ্বাসী।
— আমিও আমার পাগলীটার ভালবাসায় বিশ্বাসী।
..
এখন শুধু একটা কথাই বলতে ইচ্ছে হয়,
“পাইলাম আমি ইহাকে পাইলাম”।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত