সুখী মানুষ

সুখী মানুষ

স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়ে দুটো প্রেম করার অনুকূল একটা জায়গা খুঁজে নিয়েছে। পার্কের মতো এখানে লোকজনের ভীড় নেই। প্রেমিকা বঞ্চিত কিশোর-যুবকের দল এখানে তাদের বিরক্ত করে না। রেস্তোরাঁ বা কফি শপের বেয়ারা আর ম্যানেজারের মতো কেউ মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকায় না।

টেবিলের দু’পাশের দুটো চেয়ারে বসে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ছেলেটা মেয়েটার হাতের ওপর হাত রাখে, মেয়েটা দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। সকালের এই সময়টা পাঠাগার ফাঁকাই থাকে। মেয়েটা একবার হানিফের দিকে তাকায়। হানিফ সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে বইয়ের পাতা উল্টায়। হানিফ তাদের দেখছে না এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে মেয়েটা ছেলেটার হাতে হাত রাখে। মাঝে মাঝে হানিফ তাদের একা রেখে বাইরে এসে সিগারেট জ্বালায়। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কিছু একটা ভাবছিলো হানিফ। টেবিলে কিছু একটা রাখার শব্দে চোখ মেলে তাকালো। একটা সিগারেটের প্যাকেট। হানিফ ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা হাসি মুখে বলল, মামা আপনার জন্য।

ছেলেটার মুখে মামা ডাক শুনে হানিফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে পাড়ার টং দোকানদার, বাদামওয়ালা, রিকশার হুড তুলে চুমু খাওয়ার সুযোগ করে দেয়া রিকশাওয়ালাদের দলের কেউ নয় যে তাকে মামা বলে ডাকবে। মামা ডাকটা হানিফের কাছে গালির মতো মনে হলো। তার ওপর সদ্য নাকের নিচে লোম গজানো পুচকে একটা ছেলে তাকে সিগারেটের প্যাকেট দিচ্ছে দেখে হানিফ ধমকের স্বরে বলল, কে কার মামা? আর আমাকে এটা দেয়ার মানে কী? হানিফের এমন আচরনে ছেলেটার মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। ছেলেটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে হানিফের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে হানিফের দিকে একবার তাকালো, সে দৃষ্টিতে রাগ ঘৃণা স্পষ্ট। তারপর ছেলেটার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বের হয়ে গেলো।

আকস্মিক এই ঘটনার রেশ কাটতেই হানিফের মনে হলো এমন ব্যবহার সে না করলেও পারতো। শুধু শুধু রেগে যাওয়া তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। রাগ কমানোর জন্য তার এখন এক শলাকা গাঁজা প্রয়োজন। কিন্তু তার কাছে গাঁজা নেই। যেটুকু সে কিনে বালিশের নিচে রেখেছিলো মা ফেলে দিয়েছেন আবর্জনার স্তুপে। সকাল সকাল হানিফ যখন বালিশের নিচে গাঁজার খোঁজ করছিলো তখন এলাকার বাতাসে তার কেনা গাঁজা সুবাস ছড়াচ্ছিলো। হানিফ তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে দেখে পাড়ার ছেলেরা আবর্জনার স্তুপে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। আর সেখান থেকেই ভুড় ভুড় করে গাঁজার সুবাস চারিদিক ছড়িয়ে পড়ছে। বিকাল চারটায় পাঠাগার বন্ধ করে রিকশা নিলো হানিফ। প্রেসে যাওয়ার আগে বড় আপার বাসা হয়ে যাবে।

কয়েকদিন ধরে বড় আপা তার বাসায় যাওয়ার জন্য বেশ তাড়া দিচ্ছেন। বড় আপা তাকে বসতে বলে কোথায় গায়েব হলেন কে জানে। সদ্য স্কুলের খাতায় নাম লেখানো ভাগ্নে পাশে বসে টিভি দেখছিলো। অন্তর্বাস পরা অসম্ভব রূপবতী কয়েকটি মেয়ে হিন্দি গানের তালে নাঁচছে। এটুকুন একটা বাচ্চা ছেলে কি দেখছে এসব। হানিফ ভাগ্নের হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি অফ করে দিলো। ভাগ্নে মামার মুখের দিকে তাকিয়ে সোফা থেকে নেমে কাঁদতে কাঁদতে দৌড় দিলো। হানিফ সিগারেট ধরাতে ধরাতে ভাবলো বড় আপাকে বুঝানো উচিত তার বাচ্চা ছেলে কি দেখছে আর এসব দেখে কি শিখবে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হানিফের মনে হলো টিভিতে দেখা মেয়েটার সাথে কার যেন খুব মিল। ফাতেমার সাথে? নাহ্ ফাতেমার শরীর ছিলো অপুষ্ট। গায়ের রঙ শ্যামলা। নাকটা একটু বোচা ছিলো। তাহলে কার সাথে মিল?

হানিফ তুই ঘরের মেঝেতে ছাঁই ফেলছিস? বড় আপার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো হানিফের। বড় আপা দরজায় দাঁড়িয়ে। তার পাশে অপরিচিত একটি মেয়ে। হানিফ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে সিগারেটটা নিভিয়ে দিলো। বড় আপা হানিফের পাশে এসে বসলেন। মেয়েটা বসলো বড় আপার পাশে। তাকে কেন এত জরুরি তলব করা হচ্ছিলো বুঝতে বাকি রইলো না হানিফের। এক পলকে মেয়েটাকে দেখে নিলো হানিফ। মেয়েটাকে রূপদানের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা বেশ কৃপণতা করেছেন। গোলগাল মুখটায় সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নেই। নেই কোন মায়া। বড় আপা হানিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে কতদিন থেকে বলছিলাম আমার বাসায় আসতে। তোর কোন পাত্তাই নেই।

কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বিরস মুখে জবাব দিলো হানিফ। আচ্ছা তোরা কথা বল আমি চা করে নিয়ে আসি। যাবো আর আসবো। বড় আপা কথাটা শেষ করেই উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। চেনা-জানা তো দূরের কথা যেই মেয়ের নাম পর্যন্ত জানে না তার সাথে কি কথা বলবে সে। বড় আপা ঘরে নেই এই সুযোগে হানিফ সোফা ছেড়ে দাঁড়ালো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, আসি আমি। মেয়েটা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, চলে যাচ্ছেন?

জ্বি। আপা ফিরে আসার আগেই কেটে পড়তে হবে। নাহলে এখান থেকে সহজে ছাড়া পাওয়া যাবে না। কথা শেষ করে হানিফ এক মুহূর্ত দেরি করলো না। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিলো। রিকশা নিতেই মনে হলো মেয়েটাকে সে অপমান করলো না তো? মেয়েটা যদি রূপবতি হতো তাহলেও কি সে এভাবে পালিয়ে চলে আসতো? হয়তো আসতো না। পরক্ষণে ভাবলো যা করে ফেলেছে সেটা ভেবে কোন লাভ নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা সিগারেট জ্বালালো। এখন সে যাবে প্রেসে। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে সে কম্পোজিটরের কাজ করে। পাঠাগার আর প্রেসের টাকা মিলিয়ে যা পায় তাতে তার দিন বেশ চলে যায়।

রিকশা থেকে নামতেই জান্নাতুল ফেরদৌস প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মকলেছুর রহমান বললেন, আজকে দেরি করে ফেললে যে? কথার জবাব না দিয়ে হানিফ মকলেছুর রহমানকে পাশ কাটিয়ে প্রেসে ঢুকতেই দেখলো তার চেয়ারে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার হাতে একটা বই। পায়ের ওপর পা তুলে বই পড়ছে মেয়েটা। হানিফ হালকা কাশলো। মেয়েটা মুখ তুলে তাকালো। কাজল দেয়া বড় বড় দুটি চোখ। খাড়া নাক। গোলাপি লিপিস্টিক দেয়া পাতলা দুটি ঠোট। চেয়ার ছেড়ে পাশের টুলে বসলো মেয়েটা। ঠোটের কোণে হাসির রেখা এনে বলল, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

আমার জন্য? কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো হানিফ। জ্বি মেয়েটা একটা বই ছাপাবে। কাজটা একটু মনযোগ দিয়ে কোরো তো। প্রেস মালিক মকলেছুর রহমানের কণ্ঠ। তিনি কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করেনি হানিফ। হানিফ চেয়ারে বসে কম্পিউটার অন করতে করতে বলল, আমার কাজ কাগজ দেখে টাইপ করা। যেভাবে লিখে দিবে সেভাবে করে দিবো। কয় ফর্মার বই? শেষ কথাটা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল হানিফ।

মেয়েটা ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে হানিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কয় ফর্মা এখনো বলতে পারছি না। আপনি আগে কম্পোজ করুন তারপর না জানা যাবে। হানিফ মেয়েটার হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে বলল, আচ্ছা। মেয়েটা চলে যাওয়ার আগে থমকে দাঁড়ালো। হানিফের দিকে তাকিয়ে বলল, বইটা কি আমি নিয়ে যেতে পারি? হানিফ এতক্ষণে লক্ষ্য করলো মেয়েটার হাতের বইটা তার। বছর কয়েক আগে লিখেছিলো সে। যার কয়েকটা মাত্র কপি বিক্রি হয়েছিলো। বাকি সব বই এখনো তার বিছানার নিচে পড়ে আছে। ইঁদুর তেলাপোকাও সে বইগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। অথচ এই বইটার জন্য সে কি না করেছে। বইয়ের এক চরিত্র গাঁজা খায়। চরিত্রটাকে ফুঁটিয়ে তোলার জন্য সে গাঁজাখোরদের সাথে মিশেছে।

শেষ মেষ নিজেও গাঁজা খাওয়া শুরু করেছে। তারপর সেই পতিতা চরিত্রটা হানিফকে আনমনে কিছু ভাবতে দেখে মেয়েটা আবার বলল, বইটা কি নিতে পারি? পরেরদিন আসলে ফেরত দিয়ে দিবো। আচ্ছা নিয়ে যান। হাতের কাজগুলো শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘন্টার কাটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। কাজের চাপে বইটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো হানিফ। স্মরণ করিয়ে দিলেন মকলেছুর রহমান। সাদা দাড়ির মাঝে আঙুলের চিরুনি চালাতে চালাতে বললেন, বইয়ের কাজটা কতদূর করলে? দেখি কাল কাজে হাত দিবো। আচ্ছা ঠিক আছে। পান্ডুলিপিটা সাথে নিয়ে যাও। পড়ে দেখবা কোন ভুল-টুল আছে কি না। আমি সাধারন কম্পোজিটর। লেখকের ভুল ধরবো কিভাবে? কেন তুমিও নাকি একটা বই লিখছিলা? হানিফ আর কোন কথা বাড়ালো না, ড্রয়ার থেকে ফাইলটা নিয়ে প্রেস থেকে বের হলো।

প্রেস থেকে নিয়ে আসা বইটা মাত্র শেষ করেছে সুমি। বইটা শেষ করার পর থেকে তার মনটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে। এটা নতুন কিছু নয়। এমনও হয়েছে কিছু কিছু বই পড়ে সে কেঁদেছে। তবে এই বইটা পড়ার সময় সুমি মনে মনে চাচ্ছিলো একটা হ্যাপি এন্ডিং হোক। আপু তোর বই পড়া কি শেষ? সিফার কণ্ঠ শুনে সুমি দরজার দিকে তাকালো। সিফা এর আগে তিনবার সুমির ঘরে উঁকি দিয়ে গেছে। তখন সুমি বই পড়ছিলো তাই বিরক্ত করেনি। সিফাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুমি বলল, পড়া শেষ। আয় ভেতরে আয়। বড় বোনের অনুমতি পেয়ে সিফা ঘরে ঢুকে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। সুমি বলল, কি-রে কিছু বলবি? সিফা পা দুলাতে দুলাতে বলল, আপু তোর বইটা কবে বের হবে?

‘কেন?’
‘এমনি। আচ্ছা আমাকে কয়টা বই দিবি?’
‘তোর কয়টা লাগবে?’
‘আট দশটা তো লাগবে।’
‘এতগুলো বই কী করবি?’
‘আমার বান্ধবীদের গিফ্ট করবো। বইয়ে তোর অটোগ্রাফ সহ দিবি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ সিফা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোর কি মন খারাপ? একটু।’
‘বই পড়ে মন খারাপ করার কী আছে বুঝি না। বইয়ে যা লেখা ওসব তো সত্যি না।’
‘তা তো জানি। তবুও মন খারাপ হলে কী করবো।’

‘তোর যত ঢং। আচ্ছা এক কাজ করতে পারিস। বইয়ের শেষে তোর পছন্দ মতো একটা এন্ডিং লিখতে পারিস। তুই তো এখন একজন লেখিকা। পারবি না লিখতে?’ সিফার কথা শুনে সুমি ভাবছিলো সে সত্যি সত্যি একটা হ্যাপি এন্ডিং লিখে ফেলবে কি-না। বড় বোনের কাছ থেকে প্রশ্নের জবাব না পেয়ে সিফা আবারো জানতে চাইলো, কি-রে আপু পারবি না লিখতে?

‘চেষ্টা করে দেখি।’ ‘আচ্ছা তুই তাহলে লিখ আমি গেলাম। প্রাকটিক্যাল খাতা লিখতে লিখতে জীবন যাচ্ছে। ভাবলাম তোর কাছে লিখে নেই। কিন্তু তুই তো বই পড়ে সেন্টি খেয়ে বসে আছিস।’ সিফা চলে যেতেই সুমি কাগজ কলম নিয়ে বসলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পছন্দ মতো একটা হ্যাপি এন্ডিং লিখে ফেলল। এন্ডিংটা তার নিজের কাছে এতো বেশি পছন্দ হলো যে সে সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল প্রেসে গিয়ে লেখাটা কম্পোজ করে নিবে। তারপর সেটা বইয়ের সাথে রেখে দিবে।

মধ্যাকর্ষণ বল কাজ করছে না। হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা বেলুনের মতো হানিফ উড়ে যাচ্ছে। হানিফ ফাতেমার হাত শক্ত করে ধরে নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। হাত ফসকে যেতেই হানিফ বাতাসে ভাসতে শুরু করলো। শ্বাসরুদ্ধকর উৎকন্ঠায় ঘুম ভাঙ্গে হানিফের। ঘরের লাইট অন করে দু’গ্লাস পানি খেলো হানিফ। কিছুটা শান্ত হয়ে সিগারেট জ্বালালো। মাঝে মাঝেই এমন স্বপ্ন দেখে হানিফ। প্রেস মালিক মকলেছুর রহমানের মতে এ ধরণের স্বপ্ন দেখা ভালো। এ ধরণের স্বপ্ন দেখলে ইহকাল ও পরকালে সুখ ও ধন সঞ্চয় হয়।

পরকালের হিসেব পরকালে দেখা যাবে, ইহকালে সুখ আর ধন-সম্পদের প্রয়োজন বোধ করছে না হানিফ। জীবন যেভাবে চলছে সেভাবে চললেই হলো। সিগারেটটা শেষ করে বিছানা থেকে নামলো হানিফ। ঘুম পরোপুরি কেটে গেছে তার। ড্রয়ার থেকে ডায়েরি বের করে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো হানিফ। জানালার একটা পাল্লা খুলে দিলো। বাইরে এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলোর চারপাশে জমাট বাধা কুয়াশা।

হানিফ বেশ কিছু লাইন লিখেছে আবার কেটেছে। তিনটা সিগারেট শেষ করেছে। অনেক চেষ্টা করেও লিখতে পারছে না সে। শেষমেষ ডায়েরির পাতাটা ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় মুচড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেললো। দু’হাতের জোড়ে কলমটা ভাঙ্গতে গিয়ে হাতের তালুতে কলমের নিব গেঁথে গেল। তীব্র ব্যাথায় হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে কাপড়ের আলনায় সজোরে লাথি মারলো। পুরোনো কাঠ লাথির ধাক্কা সামলাতে না পেরে ভেঙ্গে গেল।
হাত চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে হানিফের রাগ খানিকটা কমলো। টেবিলের ওপর রাখা প্রেস থেকে নিয়ে আসা ফাইলটার দিকে চোখ গেলো তার। হাতের লেখা বেশ সুন্দর, গোছানো। এক বসায় পান্ডুলিপিটা পড়ে শেষ করলো হানিফ। ততক্ষণে বাইরে আলো ফুটেছে। জানালা দিয়ে আলো ঘরে ঢুকছে। মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড়গুলো তুলে বিছানার এক পাশে স্তূপ করে রেখে গামছাটা কাঁধে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। বিকালে প্রেসে গিয়ে দেখলো সুমি বসে আছে। হানিফ মেয়েটার নাম জেনেছে পান্ডুলিপি পড়ে। পুরো নাম সুমাইয়া সুমি। হানিফ বলল, তিন চার দিন সময় লাগবে আরো। প্রেসের অনেক কাজ থাকে।

সুমি হেসে বলল, আমি অন্য একটা কাজে এসেছি। ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে দিয়ে বলল, আজ এগুলো কম্পোজ করে দিন। কাগজগুলো হাতে নিয়ে হানিফ জানতে চাইলো, এগুলো কী? ‘কাল যেই বইটা নিয়ে গিয়েছিলাম সেটার এন্ডিং।’ ‘মানে?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো হানিফ। ‘মানে আমি বইটার শেষটা আমার তেমন পছন্দ হয়নি তাই একটা হ্যাপি এন্ডিং লিখেছি।’ ‘আপনাকে কে লিখতে বলেছে?’ সুমি কিছুটা অবাক হয়ে বলল, মানে? ‘মানে বইটার শেষ লেখার অনুমতি আপনাকে কে দিলো?’ ‘আপনি রাগ করছেন কেন?’ ‘আপনি অযথা আমার লেখা রাবারের মতো টেনে লম্বা করবেন আমি কিছু বলবো না। নিজেকে খুব বড় লেখিকা ভাবতে শুরু করেছেন বুঝি? নিজে কি লিখেছেন সেটা একবার দেখেছেন?’

‘আপনার লেখা মানে?’
‘বইটা আমার লেখা।’

সুমি অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালো। এই লোকটাই তাহলে এই বইয়ের লেখক হানিফ রহমান। হানিফকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব বেশি রেগে গেছেন। সুমি পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলল, স্যরি আসলে বইটা পড়ার পরে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ছোট বোন বললো মন খারাপ না করে একটা এন্ডিং লিখে ফেলতে। আমার উচিত হয়নি লেখা। স্যরি।

সুমির কথা শুনে হানিফের রাগ কিছুটা কমলো। হানিফ গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল, দুঃখীত আমি হয়তো বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলেছি। এই অখাদ্য আপনি শেষ অবদি পড়েছেন সেটাই অনেক। হানিফের কথা শেষ হতে না হতেই সুমি বলল, আরে কি বলছেন। অখাদ্য হতে যাবে কেন? ভালোই লিখেছেন। সুমির কথা শুনে হানিফ হেসে বলল, জানি ভদ্রতার খাতিরে ভালো বলছেন। ‘আরে না কি বলেন। সত্যই ভালো ছিলো।’ সুমির কথার জবাবে হানিফ কি বলবে ভেবে পেলো না। কিছুটা সময় নীরবতায় কেটে গেলো। নীরবতা ভেঙ্গে সুমি বলল, আপনার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে? হানিফ বলল, জ্বি বলুন।

‘এখানে না। চলুন কোথাও গিয়ে বসি। চা খেতে খেতে কথা বলি। মেশিনের শব্দে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।’
‘আচ্ছা চলুন।’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুমি বলল, আচ্ছা আপনি তখন বলছিলেন আমি নিজে কি লিখেছি সেটা পড়েছি কি-না। আমার পান্ডুলিপিটা আপনার ভালো লাগেনি?

‘আরে না সেরকম কিছু না। আসলে তখন একটু রেগে গিয়েছিলাম তাই কি বলতে কি বলেছি।’
‘আপনি সত্যিটা বললে আমি কিন্তু কিছু মনে করবো না। বরং চেষ্টা করবো নিজের ভুল শুধরে নেয়ার।’
‘আপনি যেমনটা ভাবছেন সেরকম কিছু না। আপনি ভালো লিখেছেন। তবে…’
‘তবে কি?’

‘এক জায়গায় লিখেছেন গল্পের মূল চরিত্র এক অসম্ভব রূপবতী পতিতার সাথে এক ঘরে রাত কাটিয়েছে। সে রাতে তাদের মাঝে কিছুই হয়নি। সারারাত তারা গল্প করে কাটিয়েছে। এও কি সম্ভব?’ সুমি অবাক হয়ে বলল, কেন সম্ভব নয়? ‘রূপবতী নারীর প্রতি প্রত্যেক পুরুষের এমনিতেই একটা দুর্বলতা কাজ করে। সেক্ষেত্রে একজন রূপবতী নারী সাথে আছে যাকে ইচ্ছে করলে বিনা বাধায় ছুঁয়ে দেখা যায়। সেখানে একজন পুরুষের কিছুই করবে না তাও কি হয়? আমি হলে তো নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না।’

হানিফের কথা শুনে সুমি হাসলো। হানিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আপনি নিশ্চই গল্পের ক্যারেক্টারটাকে মহান বানানোর জন্য এমনটা লিখেছেন। আসলে আমরা শারীরিক চাহিদা বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি না। সে রাতে যদি গল্পের চরিত্রটা মেয়েটার সাথে গল্প না করে অন্যকিছু করতো তাহলে সবার চোখে চরিত্রটা খারাপ হয়ে যেতো। তাইনা?’ সুমি কথার জবাবে শুধু মাথা ঝাঁকালো। সুমি হয়তো এ বিষয়ে কথা বলতে স্বস্তি বোধ করছে না। বিষয়টা বুঝতে পেরে হানিফ বলল, লেখকদের লজ্জাটা একটু কম থাকা উচিত কি বলেন। আপনি যেভাবে লজ্জা পাচ্ছেন তাতে অনেক কিছুই লিখতে পারবেন না। যাই হোক আপনি ভালো লিখেন।

‘ধন্যবাদ, চলুন যাওয়া যাক। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’ কথাটা শেষ করে সুমি উঠে দাঁড়ালো। বিদায় নেয়ার আগে সুমি বলল, আপনার বইটা রেখে দেই। দামটা নাহয় দিয়ে দিবো। সুমির কথা শুনে হানিফ শব্দ করে হেসে বলল, দাম দিতে হবে না। নিয়ে যান। আপনার বইটা বের হলে নাহয় আমাকে একটা ফ্রিতে দিয়েন। সুমি মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলো হানিফ। অদূরেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, কেমন আছেন? অন্ধকার থেকে আলোতে আসতেই তাসনিমকে চিনতে পারলো হানিফ। বহুদিন পরে দেখছে তাকে। হানিফকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাসনিম বলল, চিনতে পারছেন? হানিফ বলল, হ্যাঁ। কেমন আছো?

‘জ্বি ভাল। বাসায় যাবেন নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকেও নিয়া যান।’
‘না।’

হানিফ তাকিয়ে দেখলো। তাসনিমের স্বাস্থ্যটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে। শেষ যেদিন দেখেছিলো তখন তাসনিমের গায়ের রঙ ছিলো কাঁচা হলুদের মতো। গায়ের রঙটা কেমন যেন ময়লা হয়ে গেছে। কোমরে গুঁজে রাখা পানটা মুখে দিয়ে তাসনিম বলল, একশ টাকা ধার দিবেন? পরে ফেরত দিমু।

হানিফ ম্যানিব্যাগ থেকে একশত টাকার একটা নোট বের করে তাসনিমকে দেয়ার আগে দেখে নিলো আশেপাশে কেউ আছে কি-না। হানিফ জানে টাকাটা সে ফেরত পাবে না তবুও নোটটা তাসনিমের দিকে এগিয়ে দিলো। তাসনিম টাকাটা নিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে গেলো। তাসনিম চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে হানিফের মনে হলো সেদিন বড় আপার বাসায় যে মেয়েটাকে টিভিতে দেখেছিলো তার সাথে তাসনিমের অনেক মিল। এই মেয়েটার কারণেই তার জীবনটা বদলে গেছে। আজ হয়তো তার জীবনটা অন্যরকম হতো। আজ হয়তো তার বাড়ি ফেরার তাড়া থাকতো। বাড়ি ফেরার পরে ফাতেমা হাসি মুখে দরজা খুলতো। কিন্তু হানিফ আর ভাবতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে খামাখা সে তাসনিমকে দোষ দিচ্ছে। দোষটা তার নিজের।

হানিফ সকালে পাঠাগারে এসে দেখলো সুমি পাঠাগারের সিঁড়িতে বসে আছে। এই মেয়েটার সাথে হুট করে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। মেয়েটা অনেক বেশি মিশুক তাই হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে। নাহলে হানিফ যে ধরণের মানুষ তাতে কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া বয়সের ব্যবধানটা আট দশ বছরের কম হবে না।
সুমি রোজ প্রেসে আসে। তারপর চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসে। যা গল্প হয় তার অধিকাংশই বই নিয়ে। হানিফের মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা হয়তো তার থেকেও বেশি বই পড়ে ফেলেছে। হানিফ তালা খুলতে খুলতে বলল, কখন এসেছেন?

সুমি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বারো মিনিট আগে। সুমিকে বসার জন্য একটা চেয়ার দিয়ে হানিফ দু’জনের জন্য টং দোকান থেকে চা আনতে গেল। হানিফ চা নিয়ে ফিরে আসতেই সুমি বলল, আজ আসবে তো? হানিফ চায়ের কাপ টেবিলের ওপর রেখে চেয়ার টেনে বসে বলল, আসবে হয়তো। নিন চা খান। গতকাল কথায় কথায় সুমি জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপনার মতে সবচেয়ে সুখী মানুষ কে? হানিফ এক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিয়েছিলো, পাঠাগারে দুটো ছেলে মেয়ে আসে তারা। সুমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো, কেন? হানিফ বলেছিলো, একটা মানুষ যখন প্রেমে পড়ে আর অপরদিক থেকেও সমান ভাবে সাড়া পায় তখন তার থেকে সুখী মানুষ আর কেউ হতে পারে না।

হানিফের কথা শুনে সুমি বলেছিলো সেও ওদের দেখতে চায়। তাই আজ সকাল সকাল এখানে সুমির আগমন।
সুমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, আপনি তো দেখি স্বর্গে আছেন। চারপাশে এত বই। হানিফ কিছু বলতে যাচ্ছিলো ঠিক সে সময় ছেলেটা আর মেয়েটা পাঠাগারে ঢুকলো। দু’জই একবার সুমির দিকে তাকালো। তারপর কোণের টেবিলে গিয়ে বসলো। সুমিকে তাদের দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হানিফ বলল, আপনি যেভাবে তাকিয়ে আছেন তাতে তাদের সন্দেহ হতে পারে। ছেলেটা এমনিতে ভীতু। দেখবেন দু’মিনিটে উঠে চলে যাবে। হানিফের কথা শুনে সুমি হেসে ফেলল। সুমিকে হাসতে দেখে ছেলেটা আর মেয়েটা একবার এদিকে তাকালো। হানিফ বলল, মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখবেন। সুমি বলল, আপনিও বুঝি আড়চোখে দেখেন।

‘হ্যাঁ মাঝে মাঝে। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মানুষদের দেখার মাঝেও আনন্দ আছে।’
‘আচ্ছা আপনি কখনো প্রেম করেছেন?’
‘প্রেম আমি? নাহ্ প্রেম করা হয়ে ওঠেনি।’
‘আমি তো শুনেছি প্রেম করেছিলেন। বিয়েও নাকি প্রায় ঠিকঠাক হয়েছিলো। তারপর নাকি বিয়ে ভেঙ্গে গেছে?’
‘আপনাকে এসব কে বলল?’
‘আপনি হয়তো জানেন না আপনাদের প্রেস মালিক আমার খালু হন।’
‘তিনি আমার সম্পর্কে আর কিছু বলেন নি?’
‘আপনাকে নাকি বাসা থেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলো। দু’মাসের মাথায় ফিরে এসেছিলেন প্রেমের টানে।’
‘ঠিক শুনেছেন।’

‘কিন্তু তাহলে বিয়েটা ভাঙ্গলো কেন?’
‘জানেন না কেন ভেঙ্গেছে?’
‘না সেটা শুনিনি। শুধু শুনেছি মেয়ে পক্ষ বিয়ে ভেঙ্গেছে। আপনি কোন প্রতিবাদ করেন নি। কারণটা কী ছিলো?’
‘পরে কোন একসময় বলবো।’
‘আচ্ছা। একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো করবো করে করা হয়নি। আপনার কি আর কোন বই নেই?’
‘না।’
‘কেন?’
‘লিখিনি তাই। লেখালেখির পাঠশালায় আমি আদু ভাই।’
‘আর লিখবেন না?’

‘চেষ্টা তো প্রতিদিন করি কিন্তু পারি না। লিখতে গেলে অনুভূতি থাকা লাগে। আমার সব অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছরের লেখক প্রেমের গল্প এতো সুন্দর করে লিখে কিভাবে জানেন? তার মাঝে প্রেম জিনিসটা রয়ে গেছে। আমার মাঝে নেই।’ ‘আদু ভাইও কিন্তু একসময় পাশ করেছিলেন।’ হানিফ কথার জবাব কি দিবে ভেবে পেলো না। হানিফকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমি বলল, সামনের শুক্রবারে ফ্রি আছেন?

‘কেন?’
‘আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।’
‘কোথায়?’
‘গেলেই বুঝতে পারবেন। যাবেন?’
‘এখনি বলতে পারছি না।’
‘চিন্তা ভাবনার কিছু নেই। আমি অপেক্ষা করবো চলে আসবেন।’
‘আচ্ছা।’

সুমি দুপুর অবদি পাঠাগারে থাকলো। পুরো সময়টা বই পড়ে কাটালো। দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করলো তারা। সুমি চলে যাওয়ার পরে হানিফ সুমিকে নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলল। গল্পটা লিখার পর থেকে ইচ্ছে করছিলো সুমিকে গল্পটা দিতে। অনেকদিন পরে সে কিছু লিখেছে।

সুমির ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে কোন ঝড় বয়ে গেছে এই ঘরে। চারিদিকে বই কাগজের ছড়াছড়ি। সুমি বসে বসে চিঠি লিখছে। চিঠিগুলো রঙিন খামে ভরে বইয়ের ভেতরে রাখছে। তার প্রত্যেকটা পাঠককে বইয়ের সাথে চিঠি দিবে কথা দিয়েছিলো। চিঠি লিখতে গিয়ে হাত ব্যাথা হয়ে গেলেও এক ধরণের আনন্দ উত্তেজনা বোধ করছে সে। সিফা এসে জানালো, আপু তোকে একটা লোক খুঁজছে। ‘আমাকে খুঁজছে? কে?’ ‘আমি কি জানি। তুই গিয়ে দেখ।’ বসার ঘরের সোফায় হানিফ বসে আছে। সুমি দেখে হানিফ দাঁড়ালো। হানিফকে দেখে সুমি অবাক হয়ে বলল, আপনি?

‘জ্বি। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই। আচ্ছা চলি।’ ‘সে-কি বসুন। চা নাস্তা করে যান।’ ‘না, প্রেসে যেতে হবে। অনেক কাজ বাকি আছে।’ হানিফের পেছন পেছন সুমি বাইরের গেইট পর্যন্ত আসলো। হানিফের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ধারণা আপনি আমাকে কিছু বলতে এসেছেন। কেননা আপনি আমার ঠিকানা জানেন না। এখানে আসার আগে নিশ্চই কারো কাছে আমার ঠিকানা জেনেছেন। হয়তো খালুর কাছে। হানিফ কিছু না বলে পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করে বলল, আজ একটা গল্প লিখেছি। ‘তাই!’ সুমি হাত বাড়িয়ে খামটা নিলো। ‘আসি তাহলে।’ কথাটা বলে হানিফ আর দাঁড়ালো না।

সুমি বাসায় ঢুকতেই মায়ের সামনে পড়লো। মনি বেগম ভ্রু কুচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘লোকটা কে?’
‘তুমি চিনবে না।’ ‘চিনলে তো প্রশ্ন করতাম না। কে লোকটা? আর মিটমিট করে হাসছিস কেন? খুশির কী এমন ঘটনা ঘটেছে?’ ‘কই হাসছি আজব।’ মনি বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় রান্নাঘর থেকে কিছু পরার শব্দে শুনে সিফাকে বললেন, কিরে কি ফেললি। মাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে সেই সুযোগে সুমি নিজের ঘরে চলে আসলো। মায়ের সামনে থাকলে তিনি অযথা নানান প্রশ্ন করতেন। যেমন বলছিলেন সে নাকি মিটমিট করে হাসছিলো। আশ্চর্য সে মিটমিট করে হাসতে যাবে কেন? তার তো প্রেম পত্র আসেনি যে সে হাসবে।

হানিফকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে সুমি ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো। ব্যানার দেখে হানিফ এটুকু বুঝতে পারলো যে এখানে লেখক পাঠকদের সরাসরি কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঠকরা তাদের প্রিয় লেখকদের সাথে কথা বলবে, প্রশ্ন করবে, আড্ডা দিবে। কিন্তু তার এখানে কাজ কী? সে লেখক নয়। লেখালেখি তাকে গ্রহণ করেনি। সে পাঠক হলেও যেই লেখকদের নাম ব্যানারে লিখা তাদের কারো বই এখনো পড়া হয়নি তার। সুমি তাকে কোথায় নিয়ে আসছে আগে বললে সে এখানে আসতো না।

একজন প্রবীণ লেখককে প্রশ্ন করা হলো, নতুন যারা লিখছে। অল্প সময়ে বই বের করছে তাদের আপনি কী বলবেন?
প্রবীণ লেখক হেসে জবাব দিয়েছেন, আপনি অল্প সময়ে বই লেখার চেষ্টা করুন হয়তো পারবেন না। কিন্তু তাঁরা পারছেন। কেন পারছেন? কারণ তারা পরিশ্রমী। কথাটা সুমির বেশ পছন্দ হয়েছে। অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। সুমি লক্ষ্য করলো হানিফ নেই। হানিফের খোঁজে সুমি বের হলো। রাস্তার পাশের টং দোকানে বসে হানিফ সিগারেট জ্বালিয়েছে। সুমি গিয়ে হানিফের পাশে বসলো। হানিফ সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, অনুষ্ঠান শেষ? ‘না।’ ‘তাহলে বাইরে কী করছেন?’ ‘এমনি। ওই লোকটাকে দেখছি। তার আর আমার মাঝে অনেক মিল।’ হানিফ চোখের ইশারায় একজনকে দেখিয়ে দিলো।

সুমি তাকিয়ে দেখলো একজন ড্রাইভার গাড়ি মুছছে। সুমি কিছু বুঝতে না পেরে বলল, আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?
‘লোকটাকে দেখুন কি যত্ন করে গাড়িটা মুছছে। গাড়িটা চকচক করছে তবুও মুছছে। সে নিজের ততটা যত্ন নেয় না যতটা না গাড়িটার যত্ন নেয়। তবুও দিন শেষে গাড়িটা মালিকের তার নয়। ঠিক তেমনি আমি যেভাবে সাহিত্যের সাধনা করি কিন্তু সাহিত্য আমার নয়।’

হানিফের কথার মাঝের অভিমাণ সুমির দৃষ্টি এড়ালো না। সুমি বলল, যদি আমি পাশে থাকি। তাহলে পারবেন না লিখতে যেভাবে কাল আমাকে নিয়ে লিখেছেন। রোজ নাহয় আমার জন্য লিখবেন। সুমির কথা শুনে হানিফ সুমির দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তুমি আমার অতিত জানো না তাই এভাবে বলছো। ‘নিশ্চই সেটা সুখকর কিছু নয়, তাই আমি জানতেও চাই না।’ কথাটা বলে সুমি হানিফের হাতের ওপর হাত রাখলো। ‘তবুও আমি বলতে চাই।’ সুমি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, আচ্ছা বলুন।

হানিফ সিগারেটটা পায়ের নিচে মাড়িয়ে বলল, ‘আমি সেদিন নিষিদ্ধ সেই জায়গায় গিয়েছিলাম তাদের সম্পর্কে জানতে। ভেবেছিলাম তাদের সম্পর্কে জেনে তাদের নিয়ে কিছু লিখবো। কিন্তু তোমার লেখা চরিত্রের মতো আমি ভালো নই তাই সেদিন তাসনিমের রূপ দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। এই সত্যিটা আমি ফাতেমার কাছ থেকে লুকাতে চাইনি। সব শোনার পরে ফাতেমা বিয়ে ভেঙ্গে দেয়।’ ‘আপনার বলা শেষ?’ ‘হুম ‘আর কিছু বলতে চান?’ ‘না।’ ‘তাহলে চলুন একটু হাঁটি।’ হানিফ অবাক দৃষ্টিতে সুমির দিকে তাকিয়ে আছে। হানিফকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুমি বলল, কি হলো চলুন। আর হ্যাঁ বাসায় ফিরে আমাকে নিয়ে লিখবেন। তবে শেষটুকু আমার জন্য বাকি রাখবেন। শেষটা আমি লিখবো। সন্ধ্যা নেমে আসলেও ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো এখনো জ্বালানো হয়নি। এই অন্ধকারে দু’জন হেঁটে যাচ্ছে। যারা এই মুহূর্তে পৃথীবির সবচেয়ে সুখী মানুষ।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত