বন্ধুত্ব

বন্ধুত্ব

একটা মেয়ে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার হয়ে ও সেটাতে অসন্তুষ্টি কিভাবে হয় সেটা শুধু তারিনকে দেখলে বুঝি। ইন্ডিয়ার কোন নায়েকার সমান হতে গেলে নাকি ওরে আরো ২ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে। ওর এসব কথা শুনে বিরক্ত হয়ে শুধু একদিন বলেছিলাম তুই তো বামুন,তর কমপ্লেইন খাওয়া দরকার। এরপর থেকে আমার পেছনে লাগছে…সত্যি ই এটা খেলে লম্বা হবে ?

তারিন থেকে আমি পুরো ৪ ইঞ্চি খাটো,মানে আমি শুধু ৫ ফুট ৩। এরপর ও একটা দিন ওর মতো আফসোস করলাম না৷ আগে স্কুলে গেলে বোরকা তো পরতে পারতাম না, তাই যাওয়া আসার জন্য ছাতা ব্যবহার করতাম, যেন মুখ দেখা না যায় । আমি তারিন যেহেতু একসাথে যেতাম তাই এক ছাতা দিয়ে বেশি যেতাম। কিন্তু হেতি এতো লম্বা আমাকে বাহির থেকে পুরা ই দেখা যেতো। এরপর ও সে আমাকে উঁচু দিকে যেতে দিতো না,তাহলে নাকি আমি ওর সমান হয়ে যাবো। তাই রাগ করে ওর সাথে যাওয়া ই ছেড়ে দিয়েছিলাম। মানে আলাদা আলাদা ছাতা ব্যবহার শুরু করছি। কিন্তু সে সেটাও মানবে না,আমার সাথে কথা না বলে রাস্তা পার হতে তার ভালো লাগে না। এই নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া করতাম।

তারিনের নাম নাফিসা তারিন। কিন্তু আমি ওরে সবসময় তারিন বেগম ডাকি,এটা নিয়ে যে কত শতবার রাগ করছে তার অন্ত নেই। এরপর ও এটা ডাকতেই আমার ভালো লাগে। জুতার দোকানে গেলে আমি কিনি নিচু হিলের জুতা আর সে কিনে শুধু উঁচু হিলের জুতা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওরে এমন ঔষধ খাওয়ানো দরকার যেন হঠাৎ করে ৮ ফুট হয়ে যায় । এরপর যখন আর মাটি দেখতে পাবে না তখন বুঝবে অতিরিক্ত চাওয়ার ফল। তবে এটা ঠিক ওর দূর্বলতা আমি। আমাকে ছাড়া সে চলতে পারে না৷

ক্লাসে আমাদের কম্পিটিশন ছিলো নজরকাড়া। ১০ টা পরিক্ষার মধ্যে ৯ টাতেই দুজন সমান নাম্বার পেতাম। ক্লাসে রোল দিতে গেলে স্যাররা টস দিতো৷কারণ দুজনের নাম্বার সমান হতো সেটা ও প্রথম তিনজনের ভেতর। দুজনেই ক্লাসে খুব ভালো ছিলাম। তবে এই বিষয় টা আশ্চর্যজনক আমরা পরিক্ষার সময় কখনোই একসাথে বসি নি। তারিন বলতো আমরা কেউ কারো থেকে কখনো দেখি না,কিন্তু যেভাবে সমান নাম্বার পাই এতে সবাই ভাব্বে দেখাদেখি করি। তাই তুই একদম আলাদা বেঞ্চে পরিক্ষা দিবি। আগে আমাদের স্কুলে বেঞ্চে বেঞ্চে সিট বসাতো না,শুধু জোড়,বেজোড় আলাদা করে যার যেভাবে বসার বসতো। বেশিরভাগ দুইজন দুই রুমে পড়তাম। এরপর ও আমরা বসার সুযোগ পেলেও কখনো একসাথে বসে পরিক্ষা দেয় নি।

আর যায় হোক ক্লাসে যদি কেউ আমার দিকে তাকাতো তারিন একদম সেই লেভেলে রেগে যেতো। যদিও ক্লাসের অনেকে আমাকে পছন্দ করতো কিন্তু তারিনের ভয়ে তাকানোর সাহস পেতো না,কারণ তারিন আমার জন্য কঠোর পাহারাদার। এই জন্য ছেলেরা তারিনকে বকতো। সে বেশি লম্বা বলে অনেক এভাবে বকতো,,,এই হাতির জন্য তাজরীন কে জীবনে ও প্রপোজ করার সুযোগ পাবো না৷ সত্যি ই কেউ পায় নি।তারিনকে সবাই ভয় পেতো। সে আমাকে এতো টা আগলে রাখতো মাঝে মাঝে ভাবতাম এই মানুষ টা আমার জীবনে না আসলে আমি কেমন থাকতাম? দুনিয়ার যতো কষ্ট ই আমার থাকতো তারিনের দিকে তাকালে হেসে ফেলতাম।সে প্রচুর রসিকতা জানতো,মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বিরক্ত হয়ে যেতাম।

স্কুল জীবন পার করে এখন এক শহরেই দুজন,কিন্তু দুজন দুই কলেজে,তাতে কি? কথা বলা, দেখা হওয়া থেমে নেই। আমার বাড়ি থেকে দিনে ১ বার ফোন আসুক না আসুক,তারিনের কাছ থেকে দিন কম হলে ও ৫ বার ফোন আসবে৷ খুব অভিমান করে আমি নাকি নতুন বান্ধবী পেয়ে ওরে ভুলে গেছি। আসলেই আমি কখনো নিজে থেকে ওরে তেমন ফোন দেই না ৷ কিন্তু সে তো জানে না আমার পরিবার ব্যাতিত পৃথিবীর সবাইকে ছাড়তে পারবো কিন্তু এই মানুষ টা ছাড়া একদিন ও চলতে পারবো না৷ স্কুলে থাকতে অনেকেই আমাকে বলতো তাদের নিয়ে কবিতা লিখে দিতে,আর আমি দিয়েছিও তাদের । কিন্তু তারিনকে নিয়ে কখনোই কিছু লিখি নি৷ কিছুদিন আগে ও সে বলেছে,আমি তর কেউ না। আজ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে একটা লাইন ও লিখতে পারলি না৷ তখন হেসে বলেছিলাম…

— তুই আমার জীবন যতটা জুড়ে আছিস সেটা নিয়ে লেখার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। এটা শুনে মুচকি দিয়ে বলে,,
— আমাকে নিয়ে থাকবে কিভাবে তোমার তো এখন কত মানুষ আছে!

আমি ওর সাথে তর্ক করি না, আর তর্ক করতে ও পারি না৷ তাই কখনো ওর সাথে কথা বাড়ায় না৷ কারণ আমি জানি সে আমাকে বুঝে। এতটাই বুঝে যেটা আজ পর্যন্ত আর কেউ বুঝেনি। আজকে প্রমিজ ডে।প্রতি বছর এইদিনে আমি তাকে কথা দেই যা কিছুই হোক আমি তর পাশে আছি,তুই থাকবি তো।? সে ও বলে তাজরীন তুই ছাড়া আমার কে আছে বল্ !? ১০ বছর ধরে সেই বন্ধুত্ব অটুট আছে।আল্লাহ যেন সারাজীবন রাখে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত