পতি পত্নী সমগ্র

পতি পত্নী সমগ্র

বরমশাইয়ের প্রাক্তনের কথা জেনে আমি যতটা অভিভূত হয়েছি, আমার প্রাক্তনের কথা জেনে বরমশাই তার চেয়েও বেশি রাগান্বিত হয়েছেন। যখন বুঝতে পারলেন- “তার একসময়কার কাছের এক ছোটভাই-ই আমার প্রাক্তন”, তখনি তার মাথা গরম হয়ে গেছে। আমি বললাম,

– আপনি প্লিজ মাথা ঠাণ্ডা করুন।কিন্তু বরমশাই আরো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।

– মাথা ঠাণ্ডা করবো মানে! এই বাটপারটার সাথে আমি চারটা বছর একই মেসে থেকেছি। ওকে আমি শিরায় শিরায় চিনি। তার কাজই হচ্ছে মানুষ ঠকানো। এছাড়া আর কোনো যোগ্যতাই নেই ওর মধ্যে। সুন্দর চেহারা কখনোই কোনো মানুষের যোগ্যতা হিসেবে গণ্য হতে পারে না, বিশেষ করে পুরুষ মানুষদের ক্ষেত্রে। ওর মতো ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক ছিল, এটা ভাবতেই তো আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। দুনিয়ায় আর কোনো ছেলে পেলে না তুমি প্রিয়তি? ওই মেসে তো জামিল ভাইও থাকতেন। হ্যাঁ বয়সটা একটু বেশি হয়ে যেতো, কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি চমৎকার। তার সাথে প্রেম করতে পারতে। শাহীনও খুব ভাল ছেলে। গরীব ঘরের সন্তান হলেও ন্যায়নীতি ঠিক ছিল। এরা থাকতে তুমি কিনা বেছে বেছে ওই চোরের সাথে প্রেম করতে গেলে!

একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে তিনি বারান্দায় চলে গেলেন সিগারেট ধরাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগও দিলেন না। কোন কুক্ষণে যে আমি উনাকে অয়নের কথা বলতে গিয়েছিলাম! গতকাল বরমশাইয়ের সাথে অয়নকে দেখে বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম আমি। তারপর যখন জানতে পারলাম তারা পূর্ব-পরিচিত এবং এখনো তাদের মধ্যে টুকটাক যোগাযোগ আছে, তখনি আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম বরমশাইকে সব জানিয়ে দিবো।

তৃতীয়পক্ষের কাছ থেকে জানার চেয়ে আমার কাছ থেকে জানলে ব্যাপারটা বেশি ঘোলাটে হবে না ভেবেছিলাম। তাছাড়া অতীত সবার জীবনেই থাকে। তার জীবনেও ছিল। তাই নির্দ্বিধায় বরমশাইকে আজ সময়-সুযোগমতো জানিয়েও দিলাম সব। প্রথমদিকে বিষয়টা তিনি স্বাভাবিকভাবে নিলেও, পরে আর ঠিক থাকতে পারলেন না অয়নের নাম শুনে। তবে অয়নের সম্পর্কে তিনি যা যা বলছেন সেসবই সত্যি। সেজন্য তার এমন প্রতিক্রিয়া আমার মনের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলছে না। খানিকবাদে বরমশাই বারান্দা থেকে ফিরে এসে আবারো বলতে লাগলেন,

– জানো ওর স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল? দু’একটা ঘটনা বললে বুঝতে পারবে। সবসময় নিজেরটা বুঝতো। প্রতিদিন সকালে সবার আগে গিয়ে টয়লেট দখল করে রাখতো। আর টয়লেটে একবার ঢুকলে, সহজে বের হওয়ার নাম করতো না। তাও মানতাম যদি অনিচ্ছাকৃত এমন করতো। ওর এইসব বদমাইশির কারণে জামিল ভাইয়ের যে কতদিন কাপড় নষ্ট হয়েছে, তার হিসেব নেই। এখানেই শেষ নয়। যখন যার কাছ থেকে পারতো টাকা ধার নিতো ওর গার্লফ্রেন্ডগুলোর খরচ চালানোর জন্য। অবশ্য আমার কাছ থেকে কখনো ধার নিলে আমি আর এই টাকা ফেরত নিতাম না। কারণ আমিও সেই সময় একই অবস্থায় ছিলাম কিনা, তাই সহানুভূতি কাজ করতো খুব। তবে ওর মত আমার আনলিমিটেড প্রেমিকা ছিল না। একটাই ছিল। ওইদিন যার কথা বললাম তোমাকে। আমি এবার বরমশাইয়ের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম।

– আপনার সমস্যাটা আসলে কোথায় হচ্ছে বলুন তো? আমার প্রাক্তন ছিল বলে নাকি আমার প্রাক্তন অয়ন ছিল বলে? অন্যদিকে তাকিয়ে তিনি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন,
– দ্বিতীয়টা। কোমড়ে হাত রেখে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
– তা অয়নকে যেহেতু আপনার এতোই অপছন্দ, তাহলে ওর সাথে এখনো যোগাযোগ রেখেছেন কেন? আবার শুনলাম, ওর জন্য চাকরীর সুপারিশও করছেন।

– আরে চাকরীর সুপারিশ তো করছি ওর বাপ-মায়ের খাতিরে। খালা-খালু অনেক ভাল মনের মানুষ। বেকার ছেলের জন্য খুব কষ্টে দিন পার করছেন। নয়তো ওর জন্য এতকিছু করার মানুষ আমি না, বুঝলে? আড়চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম আমি,

– খেতে আসুন।

খাবার টেবিলে খেয়াল করে দেখলাম, বরমশাইয়ের খাওয়ায় মনোযোগ নেই। বেশ অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। একটু পরপর কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আমি তার অস্থিরতার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন,

– আচ্ছা প্রিয়তি, ওই জোচ্চোরটা কি তোমাকে কোনো ঈদে শপিং করে দিয়েছিলো?
– মানে?
– আহ্, যা প্রশ্ন করছি তার উত্তর দাও।
– না। কিন্তু কেন?
– একটু মনে করার চেষ্টা করো না।
– বললাম তো দেয়নি। বরমশাই আবারো উত্তেজিত হয়ে গেলেন। গলা উঁচিয়ে বলতে লাগলেন,

– দেখেছো? এখানেও সে বাটপারি করেছে। আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছিলো তোমাকে শপিং করিয়ে দিবে বলে। অথচ দেখো অবস্থা!

– আপনি কিভাবে শিওর হচ্ছেন যে,ওর তখনকার গার্লফ্রেন্ড আমিই ছিলাম? আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন ওর স্বভাব চরিত্রের কথা।

– কিচ্ছু ভুলিনি আমি। ওর সব গার্লফ্রেন্ডদের আমি আর জামিল ভাই দেখেছি। মেসে নিয়ে আসতো তো প্রায়ই। একমাত্র তোমাকেই দেখিনি কখনো। তাছাড়া ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড তোমার মত এত সুন্দর ছিল না।এই প্রথম বরমশাইয়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম। সেই লজ্জার রেশ কাটতে না কাটতেই বরমশাই আরেকদফা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলেন।

– তারপর মনে করে দেখো তো, অয়ন কি তোমাকে কখনো চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলো?আমি বিরক্তির সুরে উত্তর দিলাম,
– না।
– আচ্ছা! তলে তলে এই শালা বহুত ট্যাম্পু চালিয়েছে। এখন হরতাল ডাকবো আমি।
– বিড়বিড় করে কি বলছেন?
– হুঁ? না, কিছু না।

পরদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় বরমশাই তার সাথে করে অয়নকে নিয়ে আসলেন। খানিকটা অবাক হলেও মুখে তা প্রকাশ করলাম না আমি। তবে বরমশাইয়ের উদ্দেশ্যটা এখনো ঠিক ধরতে পারছি না। ড্রয়িংরুমে অয়নকে বসতে বলে বরমশাই নিজেও তার পাশে বসে পড়লেন। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– দাঁড়িয়ে আছো যে? চা নাস্তা কিছু খাওয়াবে না ছেলেটাকে? অয়ন ভদ্রতা দেখিয়ে “না” করলেও বরমশাই তা শুনলেন না। চা-নাস্তা খাওয়ার পর বরমশাই অয়নকে চেপে ধরলেন।

– শোন্ অয়ন, তোর আর প্রিয়তির একসময়কার সম্পর্কের কথা আমি জেনে গেছি। তাই এখন আর এ নিয়েঅস্বস্তিতে থাকার কিছু নেই। তবে আফসোসটা কি জানিস? আল্লাহ্‌র দুনিয়ায় এতগুলা মেয়ে থাকতে তুই কিনা নজর দিলি আমার বউয়ের উপর! যাক গিয়ে সেসব কথা। আসল কথায় আসি, এক্ষুণি ৭ হাজার টাকা বের কর্ দেখি।অয়ন প্রথমদিকে ইতস্ততবোধ করছিলো ঠিকই কিন্তু পরে টাকার কথা শুনে ভীষণভাবে চমকে গেল।

– ফয়সাল ভাই, ৭ হাজার টাকা মানে? একটু খুলে বলবেন প্লিজ? অয়নের পিঠ চাপড়ে বরমশাই বুঝাতে শুরু করলেন,

– গার্লফ্রেন্ডকে ঈদের শপিং করিয়ে দিবি বলে আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছিলি একবার। আর চাইনিজ খাওয়ানোর কথা বলে নিয়েছিলি ২ হাজার টাকা। কিন্তু প্রিয়তি বলেছে, তুই ওকে কখনো শপিংও করে দিস্ নি, চাইনিজও খাওয়াস নি। সুতরাং ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?অয়ন অসহায় মুখ করে একবার আমার দিকে তাকালো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। অয়ন তাকানোর পর হুঁশ ফিরলো।

– ফয়সাল ভাই, আমার কাছে তো এখন এত টাকা নেই। পরের সপ্তাহে দেই?
– যা আছে তাই দে এখন। বাকিটা পরের সপ্তাহে দিস্। যদিও আমি জানি, এখান থেকে যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন তুই নিখোঁজ থাকবি। অয়ন আরো দু’তিনবার অনুরোধ করেও যখন আমার বরমশাইয়ের মন গলাতে পারলো না, তখন হাল ছেড়ে দিয়ে পকেট হাতড়াতে শুরু করলো।

– এইযে, এই ক’টা টাকা আছে মাত্র।

বরমশাই অয়নের হাত থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নেয়ার সাথে মানিব্যাগটাও ছিনিয়ে নিলেন। তারপর মানিব্যাগের চিপায় চাপায় পড়ে থাকা খুচরো নোটসহ ৫ টাকার কয়েনগুলোও নিজে রেখে দিলেন। একেবারে ফকির করে অয়নকে বিদায় দেয়ার সময় ওর কাছ থেকে কৌশলে ওর বাবার বিকাশ নাম্বারটা নিয়ে রাখলেন বরমশাই। অয়ন চলে যাওয়ার পর ওর বাবার বিকাশ নাম্বার রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে বরমশাই বললেন,

– এই টাকাগুলো ওর বাবার নাম্বারে বিকাশ করে দিবো। কে জানে, এই টাকাগুলো হয়তো বাড়িতে পাঠানোর জন্য রেখেছিলো বদমাইশটা!

– তাহলে এই নাটকটার কি দরকার ছিল?
– অবশ্যই দরকার ছিল। আমার বউয়ের সাথে প্রেম করেছে ঠিক আছে কিন্তু ঠকালো কেন? এর শাস্তি হচ্ছে এটা। এখন ফকির হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকুক শালা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত