-তো?
-তো মানে?
-মানে হচ্ছে কি করতে হবে বলুন?হেঁটে দেখাব?নাকি গান গেয়ে শোনাবো নাকি কি কি রান্না পারি সেসব বলবো,নাকি…
-ওয়েট ওয়েট,আপনি এসব কেন করবেন?
-কারণ আপনি মেয়ে দেখতে এসছেন আর মেয়ে দেখতে আসলে মানুষ এসবই জানতে চায়।
-হাহাহা! আপনি খুব রেগে আছেন মনে হচ্ছে।
-নাহ আমি মোটেই রেগে নেই,এটা তো আমার ভাগ্য যে এত ভালো একজন পাত্র আমাকে দেখতে এসেছে!
– একবার দেখে বুঝে ফেললেন ভালো পাত্র!!
– ও হ্যালো,আমি আপনাকে এখনো দেখিনি,আপনি খুব ভালো পাত্র এটা একটা শোনা কথা! আমি কখনোই বলবো না…..
– হুম বুঝেছি। আচ্ছা রাগ করার মত কিছু হয়নি,আপনি রাগ করবেন না। ২০১৯সালে এসে পাত্রী দেখা মানে পাত্রীকে হেঁটে দেখাও বলা না আসলে…
– তাহলে ঘটা করে পাত্রী দেখতে আসার মানে কি!
– ঘটা করে দেখতে আসিনি আর আসলেও দেখতে আর পারলাম কই?
– মানে….?
– মানে হচ্ছে আপনি যেমন আমাকে দেখেন নি,তেমনি আমিও এখনও আপনাকে দেখিনি। কিন্তু…
– কিন্তু কি?
– আপনার পা দেখতে সুন্দর।
– দেখেন নি আমাকে এদিকে আবার এতকিছু লক্ষ্য করেছেন কিভাবে?
– এতকিছু কই!আপনি যখন ড্রয়িং রুমে ঢুকছিলেন তখন দেখলাম,আমি চোখ তুলিনি উপরে আর এখানে আসার আগে আপনার ছবিও দেখিনি…আর…
– আর?
– এখনো আমরা দুজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছি যে আড়চোখে তাকালে শুধু আপনার ডান চোখের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে!চোখের কোনে কাজল ছড়িয়ে আছে….
– আড়চোখে দেখছেন আপনি আমাকে? বেশ ভালই তো! নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে আপনার।ফিরে গিয়ে বন্ধুদের গল্প শোনাবেন যে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম আড়চোখে!
– আপনি কথাগুলো হেসে বলছেন নাকি রেগে তা বুঝতে পারছি না!তবে…
– তবে…?
– ভালো লাগছে শুনতে।
– সূদুর রাজশাহী থেকে এখানে এলেন মেয়ে দেখতে! রাজশাহী মেয়ের অভাব ছিল? শুধু রাজশাহী কেন,সারাদেশে আপনার যোগ্য মেয়ের তো অভাব নেই।ইন ফ্যাক্ট,আমার চেয়ে হাজারগুণ ভালো মেয়ে…
– আপনি যেমন শুনেছেন আমি ভালো পাত্র তেমনি আমিও শুনেছি আপনি ভালো মেয়ে।আর রাজশাহী থেকে আসিনি,ঢাকা থেকে এসেছি,আমার জন্ম বড় হওয়া সব ঢাকাতেই।
– ওহ!
-আমার বাবা আপনার আঙ্কেলের (ফুফা) ভালো বন্ধু,খুব ভালো বন্ধু।বাবা,আঙ্কেল,মা কয়েকবছর আগেই নাকি আপনার ব্যাপারে কথাবার্তা বলে রেখেছেন।আমি এসব গাড়িতে আসতে আসতে জানলাম…
-ওহ আচ্ছা!বাবা মায়ের খুব বাধ্য ছেলে মনে হচ্ছে! বাবা মায়ের কথায় মেয়ের ছবি না দেখেই চলে আসলেন মেয়ে দেখতে! আল্লু আর্জুনের মতো হতে চাইছিলেন নাকি!
-আল্লু আর্জুন কে?
-চেনেন না?
-না তো!
-নিজের পছন্দের কথা বাসায় বলার সাহস নেই নাকি আপনার?
-নিজের পছন্দ থাকলে অবশ্যই বলতাম।
-আপনি বলতে চাইছেন আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই বা ছিল না আর এটা আমি বিশ্বাস করব?
-ছিল না তা তো বলিনি…
-ওহ আচ্ছা!
-শুধু আপনার বাবা মা আর ফুপি এসছেন দেখলাম,আপনার আর কোনো ভাই বোন নেই?
-আপনি দেখছি আমার ব্যাপারে কিচ্ছুটিই জানেন না!
-আপনিও তো জানেন না আমার ব্যাপারে!
-হ্যা জানিনা তবে আমি এটুকু জানি আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে।যাই হোক,আমার একটা ছোট ভাই ছিল,ওর বয়স যখন আট বছর তখন আমরা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম ছুটিতে,ও পানিতে ডুবে…এরপর থেকে আমি কখনো আর গ্রামের বাড়িতে যাইনি।
এরকম মুহূর্তে ঠিক কি বলে অকওয়ার্ড সাইলেন্স ব্যাপারটা এভোয়েড করা যায় তা আমি কখনোই জানতাম না,জানিও না।তাই চুপ থাকলাম আমি,চুপ থাকাটা ঠিক হচ্ছে কিনা জানিনা।তবে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আর।তবে যতখানি রাগ পুষে নিয়ে এসেছিলাম তা বোধ হয় আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে!এই বাসার ছাদে আজ এই প্রথম এলাম আমি,তাও আবার সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন ছেলের সাথে…ছেলে বলবো নাকি ভদ্রলোক বলবো বুঝতে পারছি না!অবাক করার মত বিষয় হলেও সত্যি যে আমি এখনো মানুষটার চেহারা দেখিনি।দুজন খানিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি ছাদের এক কোনের দিকে।বিকেল দূরের মাঠে ছেলেরা খেলছে-সেখানকার আওয়াজ আসছে কানে,খানিকদূরের রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া রিক্সা,সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ,মানুষজনের হেঁটে যাওয়া সবকিছুই খুব চোখে বিঁধছে এমন মনে হচ্ছে যেন প্রত্যেকটা বিষয় লক্ষ্য করে দেখাটা এখন খুব জরুরি!
কিন্তু এরথেকেও জরুরি কাজ করার জন্যই আমার ছাদে আসা এই ভদ্রলোকের সাথে-কাজটা হচ্ছে তার সাথে কথা বলা! কোনোদিন পরিচিত কোনো ছেলের সাথেও তো একান্তে কথা বলিনি আর আজ ফ্যামিলির সদস্যরা ঠেলে ঠেলে পাঠিয়ে দিল ‘কথা বলতে!” কি কথা বলব এই অপরিচিত মানুষটার সাথে?সবসময় বাবা মা আত্মীয়স্বজন যেই বলুক বিয়ের কথা তাকেই বলতাম,ডাক্তার ছেলে পেলে জানিও তার আগে না কারণ আমি শিওর ছিলাম ডাক্তার কোনো ছেলে নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ করতে আসবে না! কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না আমার,মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে…
-আপনার হাতে একটা মশা বসে আছে।
ভদ্রলোকের কথাটা কানে এমনভাবে বাজলো কেন কে জানে,মনে হচ্ছে কাসার থালাটা যেন মেঝেতে পড়েছে!খুব বিরক্তি হচ্ছে, ভীষণ বিরক্তি।
-এর আগে কত জায়গায় মেয়ে দেখেছেন?
-আমি যাইনি,মা বাবা গিয়েছিলেন আমার এক বান্ধবীকে দেখতে…ব্যাপারটা অকওয়ার্ড ছিল কারণ বাবা মায়ের ধারণা ছিল আমার ওই বান্ধবীটা হয়তো আমার গার্লফ্রেন্ড।তাই গিয়েছিলেন মেয়ের বাবা মায়ের সাথে পরিচিত হতে…! আমরা যদিও পরে এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিলাম।
-ওহ আচ্ছা! তা আপনার গার্লফ্রেন্ড অন্য কেউ?
-নেই বললাম তো।ছিল।
-তারপর?
– আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল যখন আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখনকার কথা।
দেড় বছরের মাথায় ব্রেকাপ হয় কারণ মেয়েটা সময় চাইতো আর আমি নিজেকে নিয়ে নিজের পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতাম যে… আর তাছাড়া তখন একটা রিলেশন কনটিনিউ করার মত ম্যাচিউর ছিলাম না হয়তো এজন্য….
–আমার আসলেই মানতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনার মত একজন আমাকে দেখতে এসছে ঘটা করে!
-আমার মত কেউ একজন মানে?
-কিছুনা।
-বলুন সমস্যা নেই। আপনি আমার ব্যাপারে যা ভাবছেন তা আমাকে বলতে পারেন,আমি মাইন্ড করব না।
-আপনার ব্যাপারে বলুন শুনি মিস্টার…?
-আপনি আমার নামটাও জানেন না মিস?
-উম…না।নাম না জেনে কথা বলা অপরাধ নাকি?
-না,ইন্টারেস্টিং!
-হু বলুন এবার।
-কি বলব!কোত্থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
-ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল যে ডাক্তার হবেন?
-নাহ।
আমার কখনোই স্বপ্ন বা ইচ্ছে ছিল না যে ডাক্তার হবো।ইন ফ্যাক্ট,বাংলাদেশের ডাক্তার ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে হয়তো ৫০%ই এমন থাকে যারা ডাক্তার হতে চায়না শুধু ফ্যামিলির প্রেসারে…যাই হোক,আমি ডাক্তার হতে চাইনি, চাইলে হয়তো সেভাবেই পড়াশোনা করতাম আর প্রাইভেট মেডিকেলে পড়তে হতো না।খুলনা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলাম কিন্তু বাবার ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তার হই আর এজন্যই!
-আগে জানতেন না যে আপনার বাবা আপনাকে ডাক্তার করতে চান?
-জানতাম কিন্তু ভেবেছিলাম হয়তো কোথাও চান্স পেলে আর না করবেন না,কিন্তু যাই হোক,এইতো! এখন চলছে আলহামদুলিল্লাহ সব ভালো।
-ওহ!
-আপনার ব্যাপারে কিছু বলুন মিস…
-আমার ব্যাপারে বলার কিচ্ছু নেই!যতটুকু জানার তা জানেন আপনি। আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পারেন,সব ঠিক ঠিক উত্তর দেব।
-ওকে,তাহলে নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু বলুন শুনি…
-হাহাহা! ভেরি ফানি!
-মে বি!আপনি কি এখনো রেগে আছেন?
-না,রেগে নেই বলেছিলাম তো।
-আসলে রেগে থাকা উচিতও না।আপনার ধারণা আমি মেয়ে দেখতে এসেছি,আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তেমন না।
-তাই নাকি?
-জ্বি।আপনাকে যদি ঘটা করে দেখতে আসতাম আমরা তাহলে আপনাকে জোর করে হলেও শাড়ি পরানো হতো,সাজগোজ করানো হতো,আপনাকে দিয়ে দু’একটা আইটেম রান্না করানো হতো।
-ওহ তাই না?
-হ্যা তাই তো! দেখুন আপনি নিজেই চিন্তা করুন।অথচ আপনি একটা লাল রঙের থ্রিপিচ পরে আছেন,লাল জামার মধ্যে নীল নীল ফুল দেখতে ভালোই লাগছে আসলে…
-আপনার প্রিয় রঙ নাকি লাল?
-সত্যি বলবো?
-মিথ্যেও বলতে পারেন,সত্যি বলবেন না মিথ্যে তা তো আপনার ব্যাপার।
-আসলে লাল রঙটা আমার আজীবনই বিশ্রী লাগত। লাল কেমন ক্যাটক্যাটে একটা রঙ মনে হয়!
-আমারও।
-তাহলে এই রঙের ড্রেস?
-জীবনে প্রথম এই ক্যাটক্যাটে রঙের একটা ড্রেস কিনেছি এবং টু বি অনেস্ট,আমার কাছে ড্রেসটা খারাপ লাগেনি,বরং ভালোই লাগছে তাইতো পরেছি!
-নিজের কাছে ভালো লাগলেই হলো।
– আপনি নাক ডাকেন রাতে ঘুমানোর সময়?
– আমি রাতে একা ঘুমাই,আমি নাক ডাকি কিনা এটা আমি কিভাবে বলি বলুন?আমার পাশে যে ঘুমাবে মানে যদি কেউ ঘুমাতো সে বলতে পারতো যে নাক ডাকি কিনা!
– “আপনি রাতে ব্রাশ করে ঘুমান?” প্রশ্নটা করতেই আমি ভাবলাম যে কেমন উদ্ভট প্রশ্ন করলাম আমি! করব না-ই বা কেন?উদ্ভট অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন হলেও এসব প্রশ্ন করব আমি,যা ভাবে ভাবুক এই লোক।
– হ্যা,ছোটবেলার অভ্যাস আমার।
– আপনি দাঁত দিয়ে নখ কাটেন?
– না তবে আপনি ছোটবেলায় দাঁত দিয়ে নখ কাটতেন।
-বাহ! এত সুন্দর করে খুঁটিয়েখুঁটিয়ে দেখা হয়েছে আমাকে?
-জ্বি না,যেভাবে খোঁচা মেরে কথাটা বললেন সেভাবে দেখিনি! ডান হাতটা দেয়ালের উপর রেখেছেন তাই দেখেছি।
-“আপনার হাইট কত?”
-পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চি। আপনি পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি?
-“জ্বি না,সাড়ে পাঁচ।আপনার চোখের আন্দাজ বেশ ভালো দেখছি” ভদ্রলোকের কন্ঠটা যে বেশ শ্রুতিমধুর তা আগে খেয়ালই করিনি! নিশ্চয়ই গান করে!
-খোঁচা মারলেন আবারও?
-নাহ। এমনিই বললাম। সিগারেট খান?
-একদমই খাইনা তেমন না,আবার যে সিগারেট না হলে চলবে না তেমনও না।বন্ধুদের আড্ডায় বসলে আর কি…
– গিটার বাজাতে পারেন?
– অল্পস্বল্প পারি।
– তার মানে গানও জানেন,শিখেছেন গান?
– না গান শিখিনি,তবে গান গাইতে কিন্তু সবাই পারে
– হয়তো!
– আপনি বই পড়তে ভালবাসেন তাইনা?
– আপনাকে কে বলেছে?
– গেস করলাম।আম্মু আসার আগে আমাকে বলেছিল যেন আপনার জন্য কিছু বই গিফট নিয়ে যাই,যেহেতু আপনার কোন ধরনের বই পছন্দ জানিনা তাই আমার পছন্দের কিছু বই নিয়ে এসছি।
– ধন্যবাদ আপনাকে।একমাত্র বই পড়েই আমি টায়ার্ড হইনা।আর সবেতেই বিরক্তি আমার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি,পা ব্যথা করছে।আপনার আপত্তি না থাকলে আমি এখানেই বসে পড়ব।
– “না না আপত্তি থাকবে কেন!বসুন এখানেই,আমারও বসতে ইচ্ছে করছিলো আসলে…”- ভদ্রলোক কথাগুলো বলতে বলতেই আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। মনে হলো কোত্থেকে যেন একমুঠো বরফ কেউ আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে,শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা বাতাসের স্রোত বয়ে গেল! আমি বাম হাতে থাকা চশমাটা পরে নিলাম চোখে আর দেখতে থাকলাম ছেলেটাকে! ছেলেটা খুব ফর্সা না,শ্যামলা বর্ণের।চুলগুলো ঠিক তেমন,যেমনটা চুল আমি কল্পনা করেছিলাম-কেমন যেন দেখলেই চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে! চশমার আড়ালের চোখ দুটোই যেন সব বলে দিচ্ছে, আমি মনে মনে ভাবছিলাম এমন কথা বলা চোখ তো আগে দেখিনি!কি লজ্জার ব্যাপার! ছেলেটার দিক থেকে আমি চোখ সরিয়ে নিতে চাইছি কিন্তু পারছি না,চোখের পাতাগুলো আমার চোখের পাতার থেকেও বড় মনে হচ্ছে!অদ্ভুত! আমি ধুপ করে বসে পড়লাম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
– আপনিও বসুন না।
ভদ্রলোক বসলেন,ভদ্রলোক শব্দটা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে থাকলো- ভদ্রলোক ভদ্রলোক ভদ্রলোক।কিন্তু এখন আবার নাম জানতে চাইতেও কেমন যেন লাগছে!আমি ভাবছিলাম, কিন্তু কি ভাবছিলাম নিজেও জানিনা।ভদ্রলোক বসলেন আমার মুখোমুখি। আশ্চর্যজনকভাবে আমি লক্ষ্য করলাম আমার অস্বস্তি হচ্ছে না,উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন আবার আমার পায়ের দিকে তাকাচ্ছেন।
-পাঞ্জাবি পরে এসছেন মেয়ে দেখতে! বাহ বেশ! ভদ্রলোক হাসলেন,হাসিতে শব্দ হলো না কিন্তু বোঝা গেল হাসির আয়তন কতটুকু হতে পারে।
-মেয়ে দেখতে আসিনি এটা মেনে নিন,লজিক দিয়েছি একটু আগে আর তাছাড়া আমরা খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছি,এবারে আপনি ‘মেয়ে দেখা’ ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেই হয়।ধরে নিন আপনি আপনার কোনো ফেসবুক ফ্রেন্ডের সাথে প্রথমবার দেখা করছেন বা এরকম কিছুই!
-আপনার কথা বলা হুট করে কমে গেছে মনে হচ্ছে মিস্টার…
-একসাথে দুটো কাজ করছি তাই হয়তো…
-মানে?
-মানে এতক্ষণ শুধু কথা বলছিলাম এখন আপনাকে দেখছি আর কথা বলছি আমি দাঁতে দাঁত চেপে হাসলাম।
-আপনি রান্না করতে পারেন?প্রশ্নটা সাধারণত ছেলেরা মেয়েদেরকে করে,কিন্তু আপনি বললেন আপনার কোনো প্রশ্ন করার নেই তাই আমিই করলাম।
-রান্না করতে পারিনা তেমন তবে মা রান্না করলে মাঝেমাঝে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াই,রান্না করা দেখি কোন তরকারিতে কি মসলা দিচ্ছে কতটুকু লবন দিচ্ছে এসব জানা হয়ে গেছে।
-বেশ।চা কফি বানাতে পারেন?
-কফি আমি অসাধারণ বানাই।
-তাই?নিজের প্রশংসা নিজেই?
-হ্যা। আজকের চা আপনি বানিয়েছিলেন?
-হ্যা।
বাসায় যেকোনো মেহমান এলেই চা আমি বানাই,আমার ভালো লাগে।
ভদ্রলোক মিটমিট করে হাসছে নিচের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছে না ভদ্রলোক আমার অপরিচিত কেউ!মনে হচ্ছে একে আমি চিনি, হ্যা চিনি।
– আপনার নাম না জেনেই কথা বলছি আবার শুধু মিস্টার বলে ডাকছি এতে মাইন্ড করছেন না তো?
– না তো,বরং শুনতে ভালোই লাগছে। ভদ্রলোক আবারও মিটমিট করে হাসছে,তার হাসি দেখে আমার কেন জানি না হাসি পাচ্ছে…অদ্ভুত!
-এত অল্পবয়সে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন? ভদ্রলোক যেন আমার কথায় বেশ মজা পেয়ে গেল।
-আই’ম হ্যাপিলি টুয়েন্টি সিক্স,মার্চ মাসে আসছে জন্মদিন,হাহাহা।
যদিও আমি ৩০পেরুলে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার মা আমার বাবা মা ছাড়া আমার তেমন কোনো ক্লোজ ফ্রেন্ড নেই, বাবা মা আমাকে কনভিন্স করেছে যে ইটস কাইন্ড অফ পারফেক্ট টাইম টু গেট ম্যারেড!আর তাছাড়া এখুনি বিয়ে করছি তা তো না,বিয়ে হতেও তো আরো সময় লাগবে কমপক্ষে আরো এক দেড়বছর!
-কেন? ভদ্রলোক কিছু বললো না,শুধু হাসলো।আমি বললাম,
-ওহ আচ্ছা!আরো মেয়ে দেখে বেড়াবেন তাই?
-নাহ,আমি আর কোনো মেয়ে দেখতে যাব না।
আমি বুঝতে পারছিলাম না ভদ্রলোক কি বোঝালেন! উনি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর আমি উনার দিকে…
-এইযে মিস্টার।
-জ্বি?
-একটা গান শোনান।
-এখন?
-হ্যা এখন…
-এভাবে হুট করে কেউ বললে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই,মনে পড়েনা কিছু…
-তাই না?
-জ্বি,গান থাকুক।কবিতা শোনাই?
-হু। উনি চুপ করে রইলেন যেন কবিতার লাইনগুলো মনে করে নিচ্ছেন…
-“আমি বলছিনা ভালোবাসতেই হবে,আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক, শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য। বাইরে থেকে খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।
আমি বলছিনা ভালোবাসতেই হবে,আমি চাই কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাত পাখা নিয়ে কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছিনা, আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ নারী মুক্তি দিয়েছে স্বামী সেবার দায় থেকে। আমি চাই কেউ একজন জিগ্গেস করুক: আমার জল লাগবে কিনা,নুন লাগবে কিনা। এটো বাসন,গেন্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।” খানিক থামলেন ভদ্রলোক।চোখ বন্ধ করে টেনে একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার শুরু করলেন, “আমি বলছিনা ভালোবাসতেই হবে,,আমি চাই কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরজা খুলে দিক।কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক। কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক,কেউ অন্তত আমাকে জিগ্গেস করুক: ‘তোমার চোখ এত লাল কেন?” আমি নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম,
-ইউ মীন ইট?
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন সেই মিটমিট করে হাসি হাসি মুখখানা নিয়ে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।চশমাটা খুলে আবার হাতে করে রাখলাম।ভদ্রলোক একবার তাকালেন আমার দিকে,আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
-সন্ধ্যে হয়ে আসছে,চলুন নিচে যাই।
-আরেকটু থাকি এখানে আমার বুকের মধ্যে কেমন হুহু করে উঠলো। উনি ওভাবে কথাটা বলে ফেলবেন আমি চিন্তা করিনি আমি বসে রইলাম।উনি বললেন,
-একটা গান শোনান।
-আমি পারিনা গাইতে।
-একটু আগেই বলেছি সবাই পারে গাইতে,আপনিও পারেন।শোনান।
ভদ্রলোকের কন্ঠে কি যেন একটা ছিল,উনি কি জোর করছিলেন গান গাইতে আমাকে?নাহ তো,জোর করেন নি আবার শুধু কথার কথাও বলেন নি তবুও আমি চোখ বন্ধ করে গাইলাম “একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে,বণ পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে বৃষ্টি জলে একলা ভিজে,সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে আমি আর এক মুহূর্তও বসে থাকতে পারছিলাম না,উঠে দাঁড়িয়ে বললাম ‘চলুন”শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমার দিবস কাটে,বিবস হয়ে- তোমার চোখে চেয়ে!” আমি ফিরে তাকালাম পেছনে,ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।
-আরশিনগর বইটা এনেছেন আমার জন্য?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সায় দিলো,সে এখনো হাসছে মিটমিট করে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছি দুজন ভদ্রলোক যাবার সময় আমার হাতে বইয়ের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন “বইগুলো পড়ে কি আমাকে জানাবেন কেমন লাগলো?” আমি হাসি চেপে বললাম,”আপনি কি কোনো একটা বইয়ের শেষ পাতায় নিজের নাম্বারটা লিখে দিয়েছেন?” ভদ্রলোক হাসলো,বললো “আপনার ফেসবুক আইডিতে ছবি না দেয়াতে সুবিধাই হয়েছে!” আমি অবাক হলাম,বেশ অবাক হললাম।ভদ্রলোক আবার বললেন “লাল রঙটা আসলে খারাপ না,সেটা আজ মনে হলো!” আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার এখনো সবকিছু মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছিলো। আঙ্কেল আন্টি আমার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলার সুযোগ পাননি বলে আফসোস করছিলেন,যদিও আসলেও আফসোস হচ্ছিলো কিনা উনাদের বোঝা যায়নি! উনারা চলে যাচ্ছিলেন।আমি ভদ্রলোককে ডাকলাম,
-সাবিদ আহমেদ কুশল?
উনি অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে,আমি হেসে দিয়ে বললাম,”ভালো থাকবেন।” উনি মিটমিট করে হাসলেন,বললেন “বেশি রাগ করবেন না তাহলে ভালো থাকবেন,মিস আমি মাথা নাড়লাম,উনিও মাথা নাড়লেন।দু’পা এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে এসে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলেন “আবার দেখা হবে?” আমি এবার মিটমিট করে হাসলাম,উনাকেও একই সুরে প্রশ্ন করলাম “আবার দেখা হবে?” কুশল চলে যাবার পরে আমার খেয়াল হলো যে উনি কি রঙের পাঞ্জাবি পরেছিলেন আমি সেটাই খেয়াল করিনি,আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না!একটা মেসেজ পাঠাবো কি?