সংসার

সংসার

আমার স্বামী এবং শাশুড়ি এখন সম্পূর্ণ আমার বশে। কি? অবাক লাগছে? একদম সত্যি কথা। উনারা একদম আমার ইচ্ছেমতই চলে। এক চুলও এদিক ওদিক হয়না। আমি যা চাই তা’ই করে, যেভাবে বলি সেভাবেই করে। এমনকি শাশুড়িমা আমার আড়ালে আত্বিয়দেরও আমার মত হতে উপদেশ দেয়!!

আমি কিছুই করিনা, শুধু আমার যা ভালো লাগে তা ই করি। মানে আমার যেই কাজে ব্যপক আনন্দ লাগে সেই কাজই করি। ধীরে ধীরে দেখলাম যেই কাজে আমি আনন্দ পাচ্ছি সবাইও সেটা উপভোগ করছে! যেমন, একদিন আমার স্বামীকে বল্লাম “ইলিশ পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে অফিস থেকে আসার সময় এক জোড়া ইলিশ নিয়ে এসো”। সে ধমক দিয়ে আমাকে বলে, ‘এতো খাই খাই কর কেন ‘ !! কি ভাবছেন? আমি রাগ করে সেদিন রান্না করি নাই ভাবছেন?

আমি সেদিন ফ্রিজ থেকে টেংরা মাছ বের করে আদা রসুন পেঁয়াজবাটা কষিয়ে টেংরা পোলাও রান্না করে রাখলাম।
রাতে খেতে বসে টেবিলে টেংরা পোলাও দেখে পানসে মুখে মা ছেলে আমাকে বলে, ‘এসব কি’ ? আমি হাত দিয়ে পোলাও এর লোকমা মুখে দিতে দিতে বল্লাম, “কি আর করব! ইলিশ নাই তাই টেংরা পোলাও করলাম! মনের সাধ পূরণ ভীষণ দরকার। কোনসময় কথাবার্তা ছাড়া মরে যাই”!  পরদিন স্বামী অফিস থেকে ফেরার সময় তিন জোড়া ইলিশ নিয়ে আসল। শাশুড়ি আম্মাও দেখি ইলিশ পোলাও, সর্ষে ইলিশ, ইলিশ দোপেয়াজা মজা করেই খাচ্ছে আমার সাথে! হা হা… এটা তো সেদিনের কথা। বিয়ের পরপর শ্বশুর বাড়িতে একদিন আমার শাশুড়ি আমাকে বলে, “বৌমা, পনের বিশ জনের জন্য দেখি বিরিয়ানি বসাও” । বিরিয়ানি!! তিনজন মানুষের জন্য পারফেক্ট সাদা ভাত রান্না করতে গেলে এখনো আমার বুক ধুঁক ধুঁক করে! ভাত নরম হইলনি , শক্ত হইলনি! আমি রাঁধবো বিরিয়ানি! তাও আবার বিশজনের জন্য!!

আমি শাশুড়ি আম্মাকে বল্লাম, “আমিতো পারিনা মা, আপনি দেখিয়ে দিন আমি পরের বার ঠিকই পারবো”। শাশুড়ি আম্মা যেন কারেন্টের শক পেল এই ভঙ্গিতে নিজে নিজে বিড় বিড় করে বলে, “হায়রে! আমার ছেলের কপাল! হাভাত্তে ঘরের মেয়ে নিয়ে আসল! বিরিয়ানি জীবনে খাইছে কিনা কে জানে”! কেমন লাগে বলেন এই কথা শুনলে! আমিও ঢোক গিলে শাশুড়িকে বল্লাম, “এত কস্ট করে লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলেকে ভাল মানুষ করতে পারলেন না মা! হইছে তো একটা লম্পট!! হাভাত্তে ঘরের মেয়ে বিয়ে করে আনল”! ব্যস। ঘরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল সেদিন। শাশুড়ি উনার ছেলে আসলে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে, বুক চাপড়ে বিলাপ করে, “আমার ছেলে লম্পট? আমার ছেলে লম্পট” ?

আমি সান্ত্বনা দিতে দিতে বলি, ” মা আপনি কাঁদবেন না। আপনার ছেলেও লম্পট না আমিও হাভাত্তে ঘরের মেয়ে না”। এবারতো ছেলে রেগে মেগে আরেক অবস্থা! ছেলে তেড়ে আমাকে বকতে আসে, “কি বল্লা তুমি? আমি লম্পট”?
আমি হাসিমুখে বল্লাম, “শরিফ সাহেব, মা বাপে কি বুঝে তোমার নাম শরিফ রাখছে? এমন করে কেউ বউএর সাথে কথা বলে”!! সাথে সাথে শরিফ সাহেব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পরদিন থেকে একসপ্তাহ ধরে খবরের কাগজের নারী নির্যাতনের খবর পড়ে পড়ে শুনাবার সময়ে অত্যাচারী স্বামীটার নামের জায়গায় শরিফ বসায় দিতাম। অতিস্ট হয়ে একদিন সে অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “সব অত্যাচারগুলো কি শরিফ হারামজাদারাই করে” ! আমি হাই তুলতে তুলতে বলি, “কি করবা বল শরিফ সাহেব? নামের একটা ভাব আছে না” !

সে বুঝতে পারল তার বউ জিনিসটা সুবিধার না! সেদিনের পর থেকে আজ অব্দি আমার শাশুড়ি আম্মা কোনদিন আমাকে বাপের বাড়ির খোঁটা দিয়ে কথা বলেনি আর শরিফ সাহেবও ত্যাড়াম্যারা রাগ দেখাতে আসেনি। শরিফ সাহেব ভীষণ ব্যস্ত। বউ নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় তার নাই। একদিন বল্লাম, “চল, সমুদ্র দেখতে যাই”। সে আমাকে বলে, “এই বালি আর পানি দেখার জন্য এত টাকা আর সময় অপচয়ের কোন মানে আছে”! পরদিন আমাকে গুনগুণ করতে করতে কাপড় গুছাতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কই যাও ?” আমি উদাস ভাব নিয়ে বলি, ‘সমুদ্র দেখতে যাই। আমার মনের একটা সাধ আহ্লাদ আছে না! সবকিছুর জন্য মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হয়না বুঝছো? নিজের সাধ নিজেকেই পুরন করতে হয়’। পরদিন শরিফ সাহেব ও উনার মাসহ তিনজন একসাথে রওনা দিলাম সমুদ্র দেখতে।

সারাদিন সংসারের সব ঝামেলা আমাকেই সামলাতে হয়। শরিফসাহেব শুধু টাকা দিয়েই খালাস! কোন আলোচনা করতে গেলে ভীষণ বিরক্ত হয়! সে টিভি দেখতে বসলেও কিছু বলা যাবে না মনোযোগ নষ্ট হবে, ঘুমাতে আসলেও ক্লান্ত থাকে, খেতে বসে বল্লেও স্বাদ নষ্ট হয়!! তারপরের তিন চারদিন ধরে শাশুড়ি আম্মা খেয়াল করে আমি পাশের গেস্ট রুমে গিয়ে একা একা কথা বলি। অবাক হয়ে একদিন মা ছেলে গিয়ে দেখে আমি শরিফ সাহেবের ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গজগজ করছি! শাশুড়ি আম্মা ভয় পেয়ে আমাকে বলে, “ছবির সাথে ঝগড়া কেন করছ বৌমা”? আমি হাসি মুখে বল্লাম, “মা ছবিটা অন্তত বিরক্ত হচ্ছেনা, কিছু বলুক না বলুক শুনছে তো!! আপনার ছেলের চেয়ে অনেক ভাল”।

সেদিন থেকে উনার পুত্রধন দিনে অন্তত একবার হলেও সংসারের খবর নেয়া শুরু করলেন!! এই রকম একটা একটা করে খুঁটিনাটি ঝামেলার স্থায়ী সমাধান করতে আমি ভীষণ উপভোগ করি। বরং কোন ঝামেলা না থাকলেই কেমন যেন বেকার বেকার লাগে নিজেকে!! তবে একটা জিনিস হচ্ছে, সংসারের যেকোন ধরনের অন্যায়কে মাথা পেতে মেনে না নিয়ে শান্ত এবং কঠোর ভাবে সমাধান করাটা সবচেয়ে আগে দরকার। প্রথমদিকেই যদি নিজেকে ভাল এবং ভদ্র সাজাতে গিয়ে অন্যায় ব্যবহারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তার ফল নিজেকেই ভুগতে হয় সারাজীবন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত