আমি মোটামোটি স্বচ্ছ-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমার টিউশনি না করলেও হয়। তবুও শখের বশত একটা টিউশনি করি। এই টিউশনির টাকা দিয়ে আমার বাড়তি কিছু চাহিদাও পূরণ হয় আর প্রতিমাসে ছোট বোনের ছোট ছোট আবদার গুলো ও পূরণ করতে পারি নিদিষ্ট সময়ের থেকেও আমি আমার স্টুডেন্টকে ২০ মিনিট বেশি পড়াবার চেষ্টা করি । কারণ বিকালের দিকে যেহেতু পড়াই সেহেতু পড়ার মাঝখানে আছরের আজান পড়ে যায়। আর আমি তখন আমার স্টুডেন্টকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে চলে যাই। সেই সময়টা পূরণ করার জন্যই আমি আমার স্টুডেন্টকে ২০ মিনিট বেশি পড়াই। সেদিন টিউশনি শেষ করে যখন বাসায় ফিরবো তখন ছাত্রের বাবা আমায় ডেকে সোফায় বসতে বললেন। আমি সোফায় বসতে বসতে বললাম,
— আংকেল, কিছু বলবেন কি? উনি আমাকে গত মাসের বেতনের টাকাটা হাতে দিয়ে বললো,
– রাফির তো কয়েকদিন পরেই এইচএসসি পরীক্ষা। এই কয়দিন ওরে নিয়ে মসজিদে গিয়ে সময় নষ্ট না করে এই বাড়তি সময়টা ওরে একটু পড়িও আমি না হয় মাস শেষে তোমাকে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিবো। আমি মাথা নিচু করে উনার কথা গুলো শুনলাম। উনার কথাবলা শেষ হলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে ছোট বোনকে ফোন দিয়ে বললাম,
— আজ থেকে যদি তোকে কিছু কিনে দিতে না পারি তাহলে কি তোর খারাপ লাগবে? ছোট বোন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,
– সমস্যা নেই, সব পাওনা আস্তে আস্তে জমা হোক। পরে না হয় একেবারেই সবগুলো পুষিয়ে দিস। সেদিনের পর থেকেই আমি টিউশনিটা ছেড়ে দেই। যে ব্যক্তি নামাজ পরাটাকে সময় নষ্ট মনে করে সেই ব্যক্তির মুখটা এই জীবনে আর নাই বা দেখলাম রাত ১০ টা বাজে। আমার বন্ধু রাকিব ফোন দিয়ে বললো,
– একটু হাতিরঝিল আসতে পারবি? আমি অবাক হয়ে বললাম,
— এখন হাতিরঝিল এসে কি করবো? রাকিব তখন বললো,
– আরে আয়, একটু বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিবো হাতিরঝিল এসে দেখি আমার সব বন্ধুরায় এসেছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম রিমিও এসেছে। আমি অবাক হয়ে রিমিকে বললাম,
— তুই মেয়ে হয়ে এত রাতে এইখানে এসেছিস কেন? রিমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
– মেয়ে হয়েছি দেখে কি হয়ছে? আমার কি ইচ্ছে হতে পারে না মাঝরাতে বন্ধুদের সাথে মিলে একটু আড্ডা দিতে?
আমি আর এই বিষয়ে কথা বাড়ালাম না। আড্ডা শেষ হতে হতে সাড়ে ১১টা বেজে যায়। আমি রিমিকে বললাম,
– চল তোকে বাসায় পৌঁছে দেই। রিমি মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
— কোনো দরকার নেই। আমি আমার বাসা চিনি। রিমি রাজি না হওয়া শর্তেও আমি ওকে বাসায় পৌঁছে দেই। ও যখন বাসার ভিতর ঢুকবে আমি তখন ওকে বলি,
— দেখ, এই মাঝরাতে যদি কেউ আমাকে আটকায় তাহলে সর্বোচ্চ আমার পকেটে রাখা ফোনটা আর মানিব্যাগটা কেড়ে নিতে পারবে। কিন্তু তোকে যদি আটকায় তাহলে হয়তো তোর সর্বস্বটাই কেড়ে নিবে। তাই একটু সাবধানে চলাচল করিস। মনে রাখিস তুই একটা মেয়ে। আমাদের দেশ এখনো এতটা উন্নত হয় নি যে, একটা মেয়ে মাঝরাতে চেলাফেরা করলে তার সিকিউরিটি দিতে পারবে। আমার কথা শুনে রিমি বিরক্ত হয়ে বললো,
— তোদের মত কিছু লো মেন্টালিটি পুরুষের জন্য মেয়েরা সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত। তুই যদি ছেলে হয়ে রাতে চলাফেরা করতে পারিস তাহলে আমি মেয়ে হয়ে কেন পারবো না? আমি আর কিছু বললাম না। রিমির কথাগুলো চুপচাপ শুনে মাথা নিচু করে এসে পরলাম আগামীকাল এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন। অথচ আমরা বন্ধুরা কেউ এসাইনমেন্ট তৈরি করি নি। তাই বাধ্য হয়ে মামুনের বাসায় সবাই মিলে এসাইনমেন্ট তৈরি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। হঠাৎ ছোট বোন দিলো। ল্যাপটপে টাইপ করছিলাম দেখে ফোনের স্পিকার অন করেই কথা বলতে লাগলা ছোট বোন বললো,
– তুই কি আজ রাতে বাসায় আসবি না? আমি বললাম,
— না, আমার কাজ আছে। ছোট বোন কতক্ষণ নীরব থাকলো। তারপর কুত্তা, বিলাই, বান্দর বলে সমানে গালাগালি দিতে লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি ফোনের স্পিকারটা অফ করে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম,
— কি রে, বকছিস কেন? ছোট বোন কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– বান্দর, আজ আমার জন্মদিন। তুই সেটাও ভুলে গেছিস। ভেবেছিলাম তুই সবার আগে আমায় উইশ করবি…
আমি হাজারবার সরি বলে ছোট বোনকে কোনো রকমে শান্ত করলাম। আমার কথা বলা শেষ হলে মামুন আমায় বলে,
– তোর বোন তোর থেকে কত দিনের ছোট?আমি বললাম,
— ৫ বছরের। কেন? মামুন তখন বললো,
– তোর বোন তোর থেকে ৫ বছরের ছোট হয়েও তোকে তুই তুকারি করে। মুখে যা আসে তাই বলে। কোনো সম্মান করে না। আমি মুচকি হেসে মামুনকে বললাম,
– ভাইকে তুই করে বললেই কি অসম্মান করা হয়? মামুন তখন বললো,
— তোর বোনের মত যদি আমার বোন আমার সাথে এমন ব্যবহার করতো তাহলে থাপ্পড় মেরে দাঁত ভেঙে দিতাম।
আমি আর মামুনকে কিছু বললাম না শুধু মাথা নিচু করে ওর সামনে থেকে চেলে এলাম সকাল সকাল তিথি( আমার গার্লফ্রেন্ড) ফোন দিয়ে আমায় বললো ওর সাথে যেন আমি ৩০ মিনিটের ভিতর দেখা করি। আমি তাড়াহুড়ো করে ওর কাছে গেলাম। ও আমায় দেখে বললো,
-সরি পিয়াস, আমি আর এই রিলেশনটা কন্টিনিউ করতে পারবো না। তুমি আর আমি এক টাইপের না। তোমাকে নিয়ে আমার বান্ধবীরা হাসাহাসি করে। তোমার আমার রিলেশনটা একটা ভুল ছিলো। এখন আমি বুঝতে পারছি আমার সাথে তোমাকে যায় না।
এই কথা বলে তিথি চলে গেলো আর আমি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম সময়ের সাথে সাথে, আস্তে আস্তে সব পাল্টে যেতে লাগলো। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমিও এম.এস.সি করার জন্য দেশের বাহিরে চলে গেলাম। আস্তে আস্তে সবার সাথে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেলো ৪ বছর পর এই মূহুর্তে আমি ছোট বোনের বিয়ের কার্ড নিয়ে রিমিদের ফ্ল্যাটের সামনে দাড়িয়ে। ফ্ল্যাটের দরজার সামনে বড় একটা তালা ঝুলছে। আমি দারোয়ানকে রিমির কথা জিজ্ঞেস করতেই দারোয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনি রিমি আপার কে হোন? আমি বললাম,
— বন্ধু। দারোয়ান তখন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
– আপনি বন্ধু হয়েও জানেন না রিমি আপার এত বড় সর্বনাশের কথা? আমি কিছুটা ভয় পেয়ে বললাম,
— মানে! কিসের সর্বনাশ? দারোয়ান তখন কাশতে কাশতে বললো,
– বছর খানিক হবে। রাত ১১টার দিকে রিমি বাসা থেকে বের হয়। যাবার সময় আমাকে বলে যায় আমি যেন না ঘুমাই। উনি একটু পরেই এসে পরবে। সারা রাত গেলো উনি আর আসলো না। আমি ভাবলাম হয়তো কোন বান্ধবীর বাসায় থেকে গেছে। কিন্তু সকালে জানতে পারি কে বা কারা আপার সর্বনাশ করে আপাকে রাস্তায় ফেলে গেছে। এরপর থেকে আপাকে আর কখনো বাসা থেকে বের হতে দেখি নি। কয়েকদিন হলো উনারা সবাই দেশের বাহিরে চলে গেছে। রিকশায় উঠে আমি রিমির কথা ভাবছি। আসলে একটা সময় আমরা সবাই সতর্ক হই কিন্তু সেটা সময় থাকতে না। ঘটনা ঘটে যাবার পর মামুনকে আমার বোনের বিয়ের কার্ডটা দিতেই ও কাঁদতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কাঁদছিস কেন? ও তখন বললো,
– আমার বোনটা বেঁচে নেই রে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
— তোর বোনের কি হয়েছিলো? মামুন কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– আমার বোন অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসতো। কিন্তু কখনো সেই কথা আমাকে বলে নি। আমরা যখন অন্য জায়গায় ওর বিয়ে ঠিক করি তখন ও সুইসাইড করে ফেলে। একটা বার যদি আমার বোন আমাকে মুখ ফুটে বলতো যে ও অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসে তাহলে কখনোই আমি অন্য জায়গায় আমি ওর বিয়ে ঠিক করতাম না। মামুনের কথা শুনে আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই জানিস তোর বোনের সুইসাইড করার পিছনে তোর ও অবদান আছে? মামুন আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বললো,
– মানে? আমি তখন বললাম,
— ভাই বোনের সম্পর্কটা হওয়া চাই বন্ধুত্বপূর্ণ। তাহলে যে কোন সমস্যার কথা বোন নির্ভয়ে ভাইকে বলতে পারে। তুই সব সময় তোর বোনকে শুধু শাসন করেছিস। সেই ভয়েই তোর বোন তোকে কিংবা পরিবারের অন্য কাউকে ওর ভালোবাসার কথা বলে নি। নিজের ভালোবাসাকে নিজের মনের ভিতর কবর দিতে পারে নি বলে নিজেই মরে গেছে। একটা বার চিন্তা করে দেখ আজ যদি তোর বোন তোর সাথে বন্ধুর মত মেশার সুযোগ পেতো তাহলে হয়তো ওর সমস্যার কথাটা সবার আগে তোকেই বলতো। যেমনটা আমার বোন। কিছু হলেও সবার আগে আমাকেই বলে আমার কথা শুনে মামুন মাথাটা নিচু করে আছে। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
— ভালোবাসার সাথে সাথে শাসনেরও দরকার আছে কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে শাসনের মাত্রাটা যেন ভালোবাসার মাত্রাটাকে ছাড়িয়ে না যায় বই মেলায় গিয়ে বিভিন্ন বই দেখছি। হঠাৎ খেয়াল করি তিথি। আমি তিথির সামনে গিয়ে বললাম,
— কেমন আছো? তিথি আমতা আমতা করে বললো,
— হ্যাঁ। ভালো আছি। তা হলুদ পাঞ্জাবি পরে তুমি তো দেখছি হিমু হয়ে গেছো। আমি তিথিকে বললাম,
— তুমি সেলেব্রেটি না কি? আজকাল বডিগার্ড নিয়ে ঘুরছো দেখছি। তিথি আবাক হয়ে বললো,
-বডিগার্ড কোথায় পেলে? আমি তখন বললাম,
— তোমার সাথে জলহস্তীর মত মোটা লোকটা কে? তিথি মাথা নিচু করে বললো,
– উনি আমার হাজবেন্ড। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— তা এখন বান্ধবীরা কিছু বলে না? জাম্বু টাইপের লোককে বিয়ে করেছো দেখে? তিথি রেগে গিয়ে বললো,
– দেখবো তো! তুমি কোন সুন্দরী রাজকন্যাকে বিয়ে করো। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— সব রাজকন্যা কিন্তু সুন্দর হয় না। কিন্তু সব হিমুদের রূপা ভয়ংকর সুন্দরী হয়। এই যে দেখছো নীল শাড়ি পরা খোলা চুলে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটা বই দেখছে সে কিন্তু আমার রূপা। তিথি হা করে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি তখন শ্রাবণীর কাছে গিয়ে বললাম,
— তুমি একাই কি মেলার সমস্ত কবিতার বই কিনে ফেলবে না কি? অন্যদের দুই একটা বই কেনার সুযোগ তো দাও আমি শ্রাবণীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি আর তিথি এখনো আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে আজ প্রথম আমার ছেলে স্কুলে যাবে। তাই আমি আর শ্রাবণী আমার ছেলেকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে এসেছি যেন সন্তানদের থেকে অবহেলিত মা বাবারা আমার ছেলের মাথায় হাত রেখে একটু দোয়া করে দিতে পারে। হঠাৎ একজনের চেহারাটা দেখে চমকে উঠলাম। আমি উনার কাছে গিয়ে উনাকে বললাম,
— আংকেল আমায় চিনতে পেরেছেন? আমি পিয়াস, আপনার ছেলে রাফিকে আমি একটা সময় পড়াতাম। চশমাটা পরে উনি আমার দিকে ভালো করে খেয়াল করে বললো,
– হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি! আমি তখন বললাম,
— আংকেল, আপনি এইখানে কেন? উনি চোখের কোণে জমে থাকা জলটা মুছতে মুছতে শুধু একটা কথায় বললো,
– আমার প্রয়োজন ছেলের কাছে ফুরিয়ে গেছে। আমি উনার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— আপনি সব সময় চেয়েছেন আপনার ছেলে ভালো স্কুলে পড়ুক; ভালো কলেজে পড়ুক; ভালো রেজাল্ট করুক। কিন্তু এটা কখনো চান নি আপনার ছেলে একজন ভালো মানুষ হোক। ছেলেকে যদি দুনিয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি একটু দ্বীনের শিক্ষা দিতেন তাহলে হয়তো আপনার আজ এই অবস্থা হতো না। আপনার এই অবস্থার জন্য আপনি নিজেই দায়ী আমাদের এই জগৎটা খুব অদ্ভুত। আর তার চেয়েও অদ্ভুত এই জগৎ সংসারের মানুষ গুলো। মানুষের জীবন কখনোই শূন্য থাকে না। জীবনের একটা সময়ে সকল শূন্যস্থান পূর্ণ হয়ে যায়…..