বাবা মায়ের পছন্দেই আমি শ্রাবণীকে বিয়ে করি। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। সমস্যা হলো শ্রাবণী চাকরি পেয়ে যাবার পর। শ্রাবণী চাকরি করুক সেটা আমার বাবা মা কখনোই চাই না। শুধু বাবা মা না আমার কোন আত্মীয় স্বজনও সেটা ভালো চোখে দেখে না অফিস শেষে বাসায় এসে কলিংবেল বাজাতেই মা দরজা খুললো। আমি মাকে দেখে বললাম,
— মা, শ্রাবণী কি আসে নি? মা আমার কথা শুনে কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
– তোর বউ তুই খবর রাখ গিয়ে। আমি তোর বউয়ের কোন খবর জানি না। আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে শুধু মাকে বললাম,
— মা, দুপুরে খাই নি। খুব ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খেতে দাও তো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি মা টেবিলে খাবার দিলো। আমি ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে বসলাম তখনি শ্রাবণী ফোন দিলো। আমি ফোন রিসিভ করতেই ও কিছুটা ভয়র্ত স্বরে বললো,
– পিয়াস, তুমি কি বাসায় চলে গিয়েছো? আমি বললাম,
— হ্যাঁ। শ্রাবণী বললো,
– আমি এখন বাসে করে বাসায় আসছি। তুমি একটু চৌরাস্তার মোড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে? আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,
— হ্যাঁ আমি অপেক্ষা করছি। কিন্তু তোমার কি হয়েছে, এত ভয় পেয়ে আছো কেন? শ্রাবণী একটু দম দিয়ে বললো,
– বাসে একটা ছেলে আমার সাথে অসভ্যতামি করেছিলো। আমি এত কিছু না ভেবে ছেলেটাকে থাপ্পড় মারি। আমি যখন বাসের সবাইকে বলি ও বারবার আমার গায়ে হাত দিচ্ছে তখন বাসে যারা ছিলো ওরা সবাই ওকে মারধর করে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। এখন আমার ভয় হচ্ছে। আমি যখন বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাসায় ফিরবো তখন যদি ঐ ছেলে যদি কিছু করে। আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— আরে কিছুই হবে না। আমি চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছি। তুমি সাবধানে আসো খাবার না খেয়েই টেবিল থেকে উঠে পরেছি দেখে মা আমায় বললো,
-তোর না ক্ষুধা পেয়েছে? খাবার না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমি মাকে বললাম,
— মা, শ্রাবণীর একটু সমস্যা হয়েছে। তাই ওকে আনতে যাচ্ছি। আমার কথা শুনে মা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
– নিজের বউকে বাজারে ছেড়ে দিয়েছিস এখন তো সমস্যা হবেই মার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম৷ তারপর মাথা নিচু করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম চৌরাস্তার মোড় থেকে রিকশা করে আমাদের বাসায় যেতে ২০-২৫ মিনিটের মত লাগে। আমি আর শ্রাবণী এখন রিকশায় করে বাসায় ফিরছি৷ ভয়ে দেখি শ্রাবণীর সমস্ত মুখ লাল হয়ে আছে। আমি শ্রাবণীর পায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
–আচ্ছা, তুমি এমন পাতলা সোল্ডের জুতা পরো কেন? শ্রাবণী হঠাৎ আমার এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে বললো,
– আমি কি খাটো না কি, যে মোটা সোন্ডের জুতা পরবো? আমি তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
— তোমায় একজোড়া ভারী মোটা সোল্ডের জুতা কিনে দেবো যাতে নেক্সট টাইম তোমার সাথে কেউ অসভ্যতামি করলে কষ্ট করে তোমার নরম হাত দিয়ে না মেরে শক্ত ভারী জুতা দিয়ে মারতে পারো। একটা দিতে পারলেই জনমের শিক্ষা পেয়ে যাবে আমার কথা শুনে শ্রাবণী আমার কাঁধে মাথা রেখে বললো,
– ছেলেটা বাস থেকে নামার পর ওর চাহনি দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি শ্রাবণীর হাতটা খুব শক্ত করে ধরে বললাম,
— দূর পাগলি, ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো আমি সরকারি জব করলেও শ্রাবণী একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করে। শনিবারে আমার ছুটি কিন্তু শ্রাবণীর অফিস আছে। আমি শ্রাবণীকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে যখন টিভি দেখছি তখন বাবা আমার কাছে এসে বললো,
~ তুই কি তোর বউকে বুঝাবি না? আমি বাবাকে বললাম,
— মানে? বাবা তখন বললো,
– এই মহল্লার মধ্যে দুইজন যদি নামীদামি ব্যবসায়ী থাকে তাহলে তার মধ্যে আমিও একজন।আর আমার ছেলের বউ কি না কয়েকটা টাকার লোভে সেই সকালে অফিসে যায় আর আসে সন্ধ্যার দিকে। সংসারের কোন দায়িত্ব নেই?তোর বউয়ের যদি এতই টাকার দরকার হয় তাহলে তোর বউ মাস শেষে যত টাকা বেতন পায় তত টাকা আমি তোর বউকে দেবো। তুই বলে দিস এইসব চাকরি বাকরি যেন না করে। সমাজে তো আমার একটা মান সম্মান আছে না কি? আমি বাবার কথার কোন উত্তর দিলাম না। শুধু চুপচাপ বাবার সামনে থেকে চলে গেলাম। আজ আমি আর অফিসের কয়েকজন কলিগরা মিলে বাইরে দুপুরের খাবার খেলাম। খাবার শেষে আমি সবাইকে বললাম,
— সবার খাওয়ার বিলটা আজ না হয় আমি দিলাম। আমার কথা শুনে আমার কলিগ মামুন সাহেব হাসতে হাসতে বললো,
— আজকাল তো পিয়াস সাহেবের কাছে অনেক টাকা। জামাই বউ দুইজনে মিলে দুইহাতে টাকা ইনকাম করছে। তবে ভাই একটু সাবধানে। কয়েকটা টাকার জন্য সুন্দরী বউকে ঘরে না রেখে বাহিরে কাজে দিলেন। দিন শেষে দেখবেন আপনার বউ বসের সাথে লাপাত্তা মামুন সাহেবের কথা শুনে সবাই জোরে জোরে হাসতে লাগলো। কেন জানি এই কথাটা শুনার পর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। মুচকি হেসে মামুন সাহেবকে বললাম,
— আমার বউয়ের চরিত্রটা আপনার বউয়ের চরিত্রের মত না। আপনার বউয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে দেখেই হয়তো আপনার এমন নিন্মমানের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আমার বউয়ের প্রতি আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আর সম্মান আছে। আমার বউয়ের ক্ষমতা আছে দেখেই চাকরি করতে পারে। আপানার বউয়ের চাকরি করার যোগ্যতা নেই সেজন্য অন্যজনের বউ চাকরি করলে খারাপ মন্তব্য করেন আমি যখন শুধু আমার খাবারের বিলটা দিলাম তখন হোটেলের ছেলেটা বললো,
– আপনি না বলেছিলেন আপনি সবার বিল দিবেন। আমি মুচকি হেসে ছেলেটাকে বললাম,
— এত কষ্ট করে উপার্জিত টাকা কোন অমানুষের পিছনে খরচ করতে চাই না যারা কি না মায়ের জাতকে সম্মান দিতে পারে না সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ শ্রাবণী এখনো বাসায় ফিরছে না। অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখি অফিসে নেই। তাছাড়া ওর নাম্বারটা বন্ধ। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে বাবা মা যা তা বলছে। জন্মদাতা পিতা মাতা দেখে এইসব কথার উত্তরও দিতে পারছিলাম না। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। দরজা খুলে দেখি দুহাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে শ্রাবণী দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,
— আজ প্রথম বেতন পেয়েছি। তাই সবার জন্য শপিং করে নিয়ে আসলাম। শ্রাবণী পাঞ্জাবির প্যাকেটটা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললো,
– বাবা, এটা আপনার জন্য এনেছি। বাবা পাঞ্জাবির প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে বললো,
~ এইসব বেহালাল নষ্টামির টাকা দিয়ে কেনা পাঞ্জাবি আমি পড়বো না। কথা শুনে শ্রাবণী সাথে সাথে কেঁদে দিয়ে বললো,
— বাবা, এটা কষ্ট করে উপার্জিত টাকা। বাবা আরো রেগে গিয়ে বললো,
~পুরুষদের সাথে মিলেমিশে কাজ করে টাকা ইনকাম করো। এই টাকা আবার হালাল হয় কিভাবে? এতদিন বাবা মার কথা এইগুলো চুপচাপ শুনেছি। কিন্তু আজ চুপ থাকতে পারলাম না। বাবার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— বাবা, আমার ছোটবোন যখন টিউশনি করিয়ে ৩০০ টাকা দিয়ে একটা শার্ট তোমায় কিনে দিয়েছিলো সেই শার্ট পরে তুমি মহল্লার সবাইকে দেখিয়ে বলেছিলে, “আমার মেয়ে রোজগার করে আমায় শার্ট কিনে দিয়েছে”। আর আজ শ্রাবণী তোমায় ওর রোজগারের প্রথম টাকা দিয়ে তোমায় একটা পাঞ্জাবি কিনে দিলো সেটা তুমি না নিয়ে এতবড় একটা কথা বলতে পারলে? বাবা আমার কথা শুনে চুপ করে রইলো। আমি তখন মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— তোমরা যেহেতু ছেলের বউকে বাইরে চাকরি করতে দেবে না তাহলে আমার সাথে শিক্ষিত মেয়ের বিয়ে করালে কেন। একটা মূর্খ মেয়ের সাথেই আমাকে বিয়ে করাতে। একটা ছেলে যেমন রাত জেগে কষ্ট করে পড়াশোনা করে। তেমনি একটা মেয়েও তেমনি রাত জেগে কষ্ট করে পড়াশোনা করে। ও মেয়ে বলে দুইটা নাম্বার বেশি দিয়ে ওকে কেউ পাশ করিয়ে দেয় নি।
আমি পড়াশোনা নিয়ে যতটা পরিশ্রম করেছি শ্রাবণীও কিন্তু ঠিক ততটাই পরিশ্রাম করেছে। যে মেয়েটা এত কষ্ট করে পরিশ্রম করে লেখাপড়া শেষ করলো তার কি ইচ্ছে হতে পারে না নিজে কিছু একটা করার? আমি মানছি মেয়েদের সংসার আগে। যখন দেখবো শ্রাবণী ঘর আর বাহির একসাথে সামলাতে পারছে না তখন আমি নিজ থেকেই শ্রাবণীকে বলবো চাকরিটা ছেড়ে দিতে। তোমরা আমায় জন্ম দিয়েছো তোমাদের প্রতি আমার যেমন কর্তব্য আছে তেমনি এই মেয়েটা নিজের জন্মদাতা মা বাবাকে রেখে আমার হাত ধরে এই সংসারে এসেছে ওর প্রতিও আমার দায়িত্ব আছে। ল্যাম্পপোষ্টের হলুদ সোডিয়ামের আলোর নিচ দিয়ে আমি আর শ্রাবণী পাশাপাশি হাটছি। হঠাৎ শ্রাবণী অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
– পিয়াস, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিবো আমি মুচকে হেসে বললাম,
— হেরে যেতে চাইছো? শ্রাবণী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
– কিন্তু রোজ রোজ এই অশান্তি আর ভালো লাগে না। আমি শ্রাবণীর হাত ধরে বললাম,
— বলো তো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী কে? শ্রাবণী বললো,
– কে? আমি তখন বললাম,
— যে কানে শুনে না।
কারণ এই পৃথিবীর সমস্ত খারাপ কথা, কটু কথা, নোংরা কথা কিছুই ও শুনতে পায় না যার ফলে ওর কোন কিছুতেই যায় আসে না। তেমনি আজ থেকে তুমিও কিছু শুনবে না। আমি চাই না আমার স্ত্রী এত সহজে হেরে যাক। দেখো, একদিন নতুন বিকেল আসবে যেদিন তুমি ক্লান্ত হয়ে অফিস শেষে বাসায় ফিরবে আর মা তোমায় কটু কথা না শুনিয়ে বলবে,” বাহিরের গরম থেকে এসেছিস এই নে একটু লেবুর শরবত খা ভালো লাগবে” মাঝ রাস্তায় পাগলিটা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমিও ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছি না। কাদুক না হয় আজকে একটু…