অ্যানিভারসারি

অ্যানিভারসারি

-“এই শোনো, আজ ফেরার সময় দুটো রজনীগন্ধার মালা আর কিছু গোলাপ…ফুলের তোড়াও নিও…আর আর..মানে ওই আর কী…টুকটাক ফুল যা পাবে আনবে। তবে মালা আর গোলাপটা কিন্তু মাষ্ট!”
-“কেন?”- আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে বললো আকাশ।

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। ঝড় আসার আগের নৈঃশব্দ! সিনেমার ব্যাকগ্রাউণ্ডের মতো আকাশ যেন সত্যি সত্যি শুনতে পেল-টিক টিক টিক টিক!!!
তারপরেই…

-“কেন! কেন মানেটা কী! তোমার কি কোনোদিনই আক্কেল হবে না? বয়সটা তো কম হলো না! লজ্জা করলো না কেন জিজ্ঞেস করতে! হে ভগবান, দেখো দেখো, কার সাথে সংসার করি আমি! তোমাকে ফোন করাই আমার ভুল হয়েছে! তোমাকে কিচ্ছু আনতে হবে না! নিজের টিফিনটা গিলে ঘরে এসো তাহলেই আমি উদ্ধার হয়ে যাব! যত্তসব!”- ফোনটা কেটে দিল অনন্যা।

ইসস! আজ কী! আকাশের কক্ষণো মনে থাকে না এসব। কার কবে জন্মদিন, কার কবে বিয়ে! ইসস! আজ আবার কী! ফোনে ডেট টা দেখলো আকাশ! ৩০ শে নভেম্বর! কী হয়েছিলো আজ!
ছেলের জন্মদিন? না! এই তো দুমাস আগেই পার্টি করলো ওরা সব মিলে। তবে! বিবাহবার্ষিকী! ওদের বিয়েটা কবে হয়েছিলো! এরকম সময়েই তো! নভেম্বরে না ডিসেম্বরে?

অফিস ফেরত পথে টুকটুক করে ফুলের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো আকাশ। যতই বলুক কিনতে হবে না, কিনে নিয়ে না গেলে আর এক দফা অশান্তি! হয়তো বা রাতের বেলাতেই আবার আনতে আসতে হবে!

কয়েকটা ভালো দেখে মালা, কিছু গোলাপ নিল আকাশ! এই রজনীগন্ধার গন্ধটা পেলেই বিয়ে বিয়ে মনে হয়। সেই বিয়ের দিনটার কথা মনে পড়ে। যাক! ফুল তো কেনা হলো! মিষ্টিও নিয়ে যাওয়া উচিত নিশ্চয় আজ! কিন্তু আজ আসলে কী! মোটামুটি গেস করা যাচ্ছে বিয়েসংক্রান্ত ব্যাপার! নয়তো মালা কেন নিয়ে যেতে বলবে! তবে কার! ভাইদের নাকি ওদের! কেজানে!

বাঃ! সুন্দর করে সাজিয়েছে তো বাড়িটা! কালীপুজোয় কেনা টুনিগুলো সব ঝুলিয়েছে সারা বাড়ি জুড়ে। গেটে আবার বেলুনও লাগিয়েছে। বেশ বেশ! আকাশকে ঢুকতে দেখতেই ভাইঝি পরী ছুটতে ছুটতে এসে ব্যস্তভাবে বললো-“জ্যেঠু তোমার এতক্ষণে আসার সময় হলো! সবাই তো চলে এসেছে!”
বাব্বাঃ! এত বড় ব্যাপার! সবাই চলে এসেছে! কে কাকে নেমন্তন্ন করলো! আকাশ তো কিছু জানে না!

-“এই যে আসা হলো আপনার! ফুল এনেছেন নাকি সেটা ভুলে মেরে দিয়েছেন?”- অনন্যা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। কিন্তু এ কী অভ্যর্থনা! চুপচাপ ফুলের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল আকাশ।
একদিকে আকাশের ক্লাস ইলেভেনে পড়া ছেলে ফাইভে পড়া বাবলিকে শেখাচ্ছে কেমন করে এভারউইং খেলতে হয়। বাবলি এখানে! তার মানে বোনও এসেছে! তখনই দেখতে পেল আকাশ। তাই তো, বোনরা কখন এল!

-“সুমন্ত! কখন এলে তোমরা?”- হাসিমুখে গিয়ে ভগ্নীপতি সুমন্তর সঙ্গে কথা বললো আকাশ।
-“আমাদের আসা তো ঘণ্টাদুয়েক হয়ে গেল! আপনারই তো দেখা নেই! বৌদি যা এমার্জেন্সি কল করলো না এসে পারি! বাবলিকে স্কুল থেকে তুলে সোজা এখানে!”

-“তুমি কি অফিসের পোষাকেই রাতটা কাটাবে?”- আবার অনন্যা!
-“না, হ্যাঁ মানে যাচ্ছি! আচ্ছা…”- বলতে গিয়ে থমকালো আকাশ! আজ কী? কার? জিজ্ঞেস করলেই ঝাড় খেতে হবে! কী দরকার!

ভেতরে গিয়ে মোটামুটি সুন্দর একটা পাঞ্জাবী পড়ে এল আকাশ। অকেশন যাই হোক, এত লোক যখন ঘরে, একটু ভালো তো লাগতেই হবে! পাড়াপ্রতিবেশীরাও চলে এসেছে কিছুজন। বাছাই করা পরিচিত মানুষদের নেমন্তন্ন করা হয়েছে। ভাই আর সুমন্ত মিলে রেষ্টুরেণ্ট থেকে আনা খাবার ভরছে ঘরের মধ্যে!

একদিকে সোফায় বাবা বসে আছে দেখে কাছে গিয়ে বসলো আকাশ। বললো-“বাবা! আজ শ্বাসকষ্ট নেই তো?”
-“না! আজ অনেকটা ভালো আছি!”- হাসলো প্রিয়রঞ্জন।
আশেপাশে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষজন বসে আছে। তাদের মধ্যেই একজন বললো-“এত ভালো দিনে কি আর ওসব অসুখবিসুখ থাকে!”

হেসে উঠলো সবাই। দিনটা কেন ভালো না বুঝলেও ওদের সঙ্গে হাসলো আকাশ।
রাত বাড়ছে। অনন্যা আর বোন মিলে বিরাট একটা কেক এনে রাখলো ডাইনিং এর মাঝখানে! বোনটা বরাবরের বেশী বকবক করা মেয়ে। গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলো-“প্রথমেই এখানে আসার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ! আর এই হঠাৎ প্ল্যানের পুরো ক্রেডিটটা আমার বড়বৌদি অনন্যার! এটুকু সময়ের মধ্যে সবকিছু আয়োজন করার জন্য ছোড়দাকেও অনেক ধন্যবাদ! আর আমার বড়দাটা একটু ভোলাভালা হলেও আজকের সবচেয়ে ইম্পর্টাণ্ট জিনিসটা ও-ই এনেছে! তাই ওকেও ধন্যবাদ!”
-“পিসিমনি! আমি কিন্তু টুনি লাগিয়েছি! আমাকেও ধন্যবাদ!”- কথার মাঝে বলে উঠলো টোডো!
ঘর জুড়ে হাসির রোল উঠলো একটা! হাসি থামলে বোন আবার শুরু করলো-“অনেকেই জানেন না আজ আসলে কী! এবার আমি সেটাই বলবো! তার আগে…”- গলা উঁচু করে ডাকলো মৌ,-“ছোটবৌদি! এসো!”
ডাকার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল ছোটবৌ অন্তরাকে। সুন্দর করে সেজেছে আজ। সঙ্গে করে নিয়ে আসছে আকাশের মাকে। মায়ের বয়স হয়েছে। হাঁটতে চলতে অসুবিধে হয় একটু। হাতে ধরে ধরে নিয়ে আসছে অন্তরা। লাল পাড় গরদের শাড়ি পড়েছে মা। সুন্দর করে গয়না পড়িয়ে সাজিয়েছে দুই বৌমা মিলে। মাকে দেখতেই সব মনে পড়ে গেল আকাশের! তাই তো! তাই তো!

মা আসতেই মৌ আবার বলতে শুরু করলো-” ছোটবেলা থেকে কখনো দেখিনি বাবা মা নিজেদের কিছু সেলিব্রেট করেছে। সবসময় আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। আমাদের পড়া, আমাদের স্কুল, আমাদের শরীর, আমাদের কষ্ট, আমাদের জন্মদিন…সব বাবা মায়েরাই বোধহয় নিজেদের বলতে ছেলেমেয়ে ছাড়া বাকি কিছু রাখে না! আর আমরা, কতবার মনে মনে ভাবলেও মুখ ফুটে থ্যাঙ্কস বা লাভ ইউ বলতে পারিনা। আজ বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী! সত্যি বলতে কী, আমাদের কারোরই মনে ছিলো না।”
-“হ্যাঁ! হঠাৎ বাবা মায়ের বিয়েতে গিফট পাওয়া একটা বই পেলাম আজ সকালে। কাকতালীয়ই বলা চলে ঘটনাটা। বইটার প্রথম পাতায় ডেট টা লেখা ছিলো। মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সব প্ল্যান করে ফেললাম।

বাবা, আসুন!”-ডাকলো অনন্যা!

উপস্থিত অনেকের চোখেই জল। মায়ের কোঁচকানো গাল বেয়ে জল নামছে। উঠে গিয়ে হাত দিয়ে মুছে দিল আকাশ। বললো-“হ্যাপি অ্যানিভার্সারি মা! হ্যাপি অ্যানিভার্সারি বাবা!”
ভাইও এগিয়ে এসেছে। মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো-“খুব ভালো থেকো তোমরা! ”
অনন্যা মালাদু’টো এগিয়ে দিল বাবা মায়ের দিকে। মাথার ওপরে দোতলার বারান্দা থেকে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিল কেউ। প্রিয়রঞ্জন আর পারমিতা এগিয়ে এল মালা নিয়ে। দুজনেরই মুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট! নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়তো আগে কখনো হয়নি। অনন্যা আর অন্তরা তাড়া দিল-“মালাবদলটা করে ফেলো! তারপর কেক কাটা!”
হাততালি দিয়ে উঠলো সবাই।
কিছুটা দূরে সদ্য কেনা ক্যামেরাটা চোখে লাগিয়ে টোডো বলে উঠলো-“এভরিবডি, স্মাইল প্লিজ!”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত