যদি হারিয়ে যাই

যদি হারিয়ে যাই

“আমার বউ বাঁচবে আর মাস তিনেক। ভালবেসে যাকে বিয়ে করলাম। যার সাথে আমার এতো দারুণ বন্ধুত্ব। তাকেই আমি হারিয়ে ফেলবো কিছুদিন পরে। ভাবতে গেলেই আমার সারা দুনিয়া এলোমেলো হয়ে যায়। বউ নিজেও জানে ও বেশিদিন আর নেই আমার কাছে। সারাক্ষণ আমার বুকের কাছে থাকতে চায়। আমার শরীরে মিশে থাকতে চায় বেড়াল ছানার মতো। ওর এই জ্বর আসে। আবার চলে যায়। খাবার রুচি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। খেলেও পেটে রাখতে পারে না কিছুই। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, বাসায় নিয়ে গিয়ে যা খেতে চায় খাওয়ান। বাকিটা আল্লাহ্‌ তা’আলার ইচ্ছা।

মাত্র পাঁচ মাসের সংসার আমাদের। আমরা বিবাহ বার্ষিকীও পালন করতে পারবো না। তার আগেই আমার বুকের কলিজাটা আমায় ছেড়ে চলে যাবে। এই এতো বড় দুনিয়ায় আমাকে একা করে চলে যাবে। ওর হাতটা মুঠোয় করে ধরে রাখি। ওর গায়ের উত্তাপটুকু আমি আমার বুকে ধরে রাখার চেষ্টা করি। দিন দিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ও। আগে কত চঞ্চল ছিল। কত প্রাণবন্ত ছিল। অথচ এই মানুষটা আস্তে আস্তে মিইয়ে যাচ্ছে। এটা যে কত যন্ত্রণার। কতটা তীব্র কষ্টের কাউকে বোঝাবার সাধ্য আমার নাই।

একটা করে দিন যায়। আর আমার বুকের মধ্যে আর্তনাদ বাড়তে থাকে। প্রতিটা দিন একটু একটু করে আমার বউ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। একবারের জন্য মেনে নিতে পারছি না ও আর আমার থাকবে না। এই অসুস্থ শরীরেও তবু ও আমার জন্য রান্না করে। আমি মানা করি না। ওর অনেক কষ্ট হয়। তাও মানা করি না। শুধু ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ও আমার জন্য কিছু করতে চায়। আমাকে একটু রান্না করে খাওয়াতে চায়। ওকে এই কাজটা থেকে আমি বঞ্চিত করতে চাই না। ও অন্তত শান্তি পায় এতো কষ্ট করে রান্না করেও।

যখন আমরা খেতে বসি। ও এক পলকে তাকিয়ে আমার খাওয়া দেখে। ওর চোখ তারার মতো জ্বলে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে। আমার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া দেখে ও যে কতটা খুশি হয় সে শুধু আমিই জানি। আর আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। এই রান্না আমি আর আগামী বছর খেতে পারবো না। এই মানুষটা থাকবে না আমার কাছে। আমি একা একাই খাবো।

আমাদের বিয়েটাও হয়েছে খুব হুট করে। মাত্র তিন মাসের পরিচয়ে। পরিচয়ের এক মাসের মাথায় আমার মনে হলো- এই মানু্ষটা হয়তো আমার জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছে। যতটা সময় আমি ওর সাথে থাকতাম। আমার খুব শান্তি লাগতো। শান্তিটা আমি সারাজীবনের জন্য চাই। ওকে জানাবো কি করে যে ওকে আমি চাই; ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। অনেক ভেবে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠিটা আমার বউ ফ্রেমে বাধাই করে আমাদের খাটের পাশে রেখে দিয়েছে। ও দিনে অজস্রবার পড়ে এই চিঠি।

‘এই মেয়ে, আমি চিঠি লিখতে পারি না। কিন্তু এছাড়া আমার আর উপায়ও নাই। এতো ভণিতাও আমি করতে পারবো না। তোমার সাথে একেকটা দিন কাটাচ্ছি আর আমার মনে হচ্ছে আমি যেন স্বর্গের শান্তি পাচ্ছি। খুব ইচ্ছে করে একবার তোমার হাতটা ধরতে। কানের পাশে চুল গুঁজে দিতে। টিপটা গতকাল সরে গিয়েছিলো। ইচ্ছে করছিলো ঠিক করে দেই। কিন্তু কি উপায়ে করি। যদি তুমি বলো- কে তুমি?

আমি জানি না তোমার প্রতি আমার এই অনুভূতিটা প্রেম, ভালবাসা, মায়া, মোহ নাকি স্রেফ একটা আকর্ষণ। গতকাল রাতেই ঘরে ফিরে মাকে বলেছি তোমার কথা। তোমায় নিয়ে আমার অনুভূতির কথা। তোমায় তো বলেছি মাকে আমি সব কিছু বলি। সব সমস্যার সমাধান মায়ের কাছে থাকে। মা বলেছেন তোমাকে সরাসরি বলে দিতে যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আর তুমি যদি আমাকে না করে দাও তাহলে যেন তোমাকে ভুল না বুঝি। তোমার প্রতি কোনো খারাপ লাগা যেন পুষে না রাখি। মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন, ‘তোর অনুভূতি কেমন তা আমি জানি না। যদি হৃদয় থেকে অনুভব করিস তাহলে তোর কথা মেয়েটার হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছাবে। মানুষ ভুল করে। কিন্তু হৃদয় ভুল করে না।’

আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কি আমার বউ হবে? আমি খুব ভালো নুডলস বানাতে পারি। তুমি রাত জেগে পড়ালেখা করলে তোমাকে বানিয়ে খাওয়াবো। আমি জানি না আমি কি লিখছি। আমি শুধু তোমাকে আমার করে চাই। সারাজীবনের জন্য। বুকের বামপাশটার পুরো দখল তোমাকে দিয়ে দিবো। নিবে তুমি? যদি আমায় না করে দাও তো দিও। তোমার জীবন থেকে সরে যাবো সারাজীবনের জন্য। তার আগে একবার শুধু তোমার কানের পাশে চুল গুঁজে দিতে দিও আমাকে।

ইতি
এই ছেলে

আমরা কেউ কারো নাম ধরে ডাকতাম না। এই ছেলে, এই মেয়ে এটাই ছিল আমাদের ডাক। ওকে চিঠিটা দিয়ে আমি কোন রকমে দৌড়ে ভেগেছিলাম সেদিন। ঘরে ফিরে সে কি অস্থিরতা। একটা ফোনকল দেয়নি ও। একটা এসএমএসও না। আমি দেওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। সারা রাত ঘুম হলো না। ঠিক সকাল সাতটা বাজে এসএমএস এলো। বিকালে যেখানে দেখা করি সেখানে যেন থাকি।

গিয়ে দেখি এই প্রথমবার ও শাড়ি পরে এসেছে। খোলা চুল সব কাঁধের একপাশে এনে রাখা। আমি পাশে গিয়ে বসলাম। ও বলল, ‘একটা খুশির সংবাদ আছে।’ আমার বুকে লাড্ডু ফুটতে লাগলো। তার মানে ও রাজি হয়েছে। আমার কি যে আনন্দ লাগছিলো। একটু পরেই আমাকে বলল, ‘আজ সন্ধ্যায় আমার এনগেইজমেন্ট। একটু পরে আমায় যেতে হবে। তোমার দোয়া নিতে এলাম। এই ছেলে দোয়া করে দিবে না আমায়?’

আমার ভিতরে কেমন যেন করে উঠলো। তারমানে আমাকে ও না করে দিচ্ছে। সে কি কষ্ট তখন বুকে। মায়ের কথা মনে পরলো, না করে দিলেও যেন কিছু না বলি। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘হ্যাঁ অবশ্যই কেন করবো না। মেয়েটার আজ এনগেইজমেন্ট। কেন দোয়া করবো না। অনেক দোয়া করে দিলাম- সুখি হও।’ কথাটা বলতে গিয়ে আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো।

‘মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতে হয় জানো না?’ বলে আমার অনেক কাছ ঘেঁষে বসলো। আমি ‘ওহ আচ্ছা’ বলে মাথায় হাত দিতে গেলাম তখন আমায় বলল, ‘উঁহু এভাবে না। কানের পাশে চুল গুঁজে দিয়ে দোয়া করে দাও।’ আমি তখনও বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। আমার আসলে চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিলো। কানের কাছে চুল গুলো গুঁজে দিতে গিয়ে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ও চোখ বন্ধ করে নিচের ঠোঁট কামড়ে বসেছিলো। চুল গুঁজে দিতেই আমার হাতটা ধরে বলল, ‘ভালবাসি! ভালবাসি! ভালবাসি!’

আমার শরীরে একটা ঝাঁকি খেলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। ও যে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে এটা ভাবতেই আমি আর আমার মাঝে ছিলাম না।

সেদিন সারাটা বিকাল ওর হাতটা আমি মুঠোয় বন্দি করে রেখেছিলাম। ও বলল, আজই ওকে আঙটি পরাতে হবে। আমার পকেটে তেমন টাকা ছিল না তখন। মাসের শেষ। খুব সস্তায় একটা আঙটি পরিয়েছিলাম। এর দুই মাস পরেই আমাদের বিয়ে হলো। যেদিন বিয়ে হলো সেদিন আমাদের চেয়ে সুখী মানুষ মনে হয় এই দুনিয়ায় আর কেউ ছিল না। আমরা একজন আরেকজনকে পাগলের মতো চাইতাম।

অথচ এই মানুষটা আর থাকবে না আমার বুকে আমার হাতের মুঠোয়। একটা সেকেন্ড আমার নষ্ট করতে ইচ্ছা করে না। যতটা পারি ওর সাথে থাকি। ওর শরীরের গন্ধ নেই ফুসফুস ভরে। কতটা ভালবাসি ওকে সেটা আমি বোঝাতে পারবো না। কেন এতো কম সময় ও আমার কাছে থাকবে আমি মেনে নিতে পারি না।

এই ডায়েরিটা লিখছি দিন তারিখ মাসের হিসাব ছাড়া। কেন লিখছি জানি না। লিখে কি হবে তাও জানি না। মাঝরাতে ডায়েরি লিখছিলাম। হঠাৎ বউ আমায় ডাক দিয়ে বলল পানি খাবে। আমি পানি খাইয়ে দিতেই বলল বারান্দায় গিয়ে বসতে চায়। আমি বারান্দায় নিয়ে গেলাম। আমরা সব সময় বারান্দার মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসি। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আমার বুকের কাছে নিয়ে এলাম ওকে। আমার টিশার্ট খামচে ধরে বলল একটা কবিতা শোনাতে। রবি ঠাকুরের কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও কবিতাটা শোনালাম।

কবিতাটা অসংখ্য বার আমি আবৃত্তি করেছি। কিন্তু সেদিন পড়তে গিয়ে একেকটা লাইন যেন আমার বুকে শাবলের মতো বিঁধচ্ছিল। বউকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরছিলাম। ওকে আমি মরতে দিতে চাই না। ওকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিতে দিবো না। বউ আমার বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘এই ছেলে তুমিও কি আমার মৃত্যুর সময় বলবে- হে বন্ধু বিদায়…’ বলে আমার বুক কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে দিলো। আমার খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো, খোদা আমার বউকেই কেন তোমার নিয়ে যেতে হবে। কেন আমার বউকে…”

ডায়েরিটা এই পর্যন্তই। এরপরের পৃষ্ঠা গুলো আর নেই। কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে। গতকাল ভাঙ্গারির দোকান থেকে পুরাতন বই কিনার সময় ডায়েরিটা চোখে পড়ছিল। কি মনে করে কিনে আনলাম। আজ রাতে বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে। তাই ড্রয়িংরুমে বসে বই পড়তে এসেছিলাম। এসে ডায়েরিটা পড়লাম।

এই ঘন্টা দুই এক আগেও মনে হচ্ছিলো কি এক মেয়েকে বিয়ে করলাম। জীবনটা নরক বানিয়ে দিচ্ছে। অথচ ডায়েরিটা পড়ে বউয়ের জন্য বুকটা কেমন করে উঠলো। ও যদি আগামীকাল মারা যায় তাহলে আমার কি হবে। কিভাবে থাকবো আমি। এতো কষ্ট দেই ওকে তাও তো ও আমার কাছেই আছে। যদি ও মারা যায় কি নিয়ে থাকবো আমি। আমার বউ তো এখনো বেঁচে আছে। মারা তো যায়নি। কেন তবে এই সব ঠুমকো ঝগড়া করে দূরে সরে যাবো।

ডায়েরিটা একপাশে তুলে রেখে বেডরুমে এলাম। ডিমলাইটের আলোয় দেখলাম বউ এক পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মনে হলো দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে যাক। ওকে আর কোনো কষ্ট দিবো না। খাটে গিয়ে পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ঘাড়ের কাছে নাক ডুবালাম। কাঁধে চুমু দিলাম। হাত দিয়ে মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিলাম। আমার বুকটা ফাঁকাফাঁকা লাগছিলো তাও। ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সাথে সাথে আমার কান্না চলে এলো কেন আমি জানি না। আমি পাগলের মতো কান্না করতে লাগলাম।

বউয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। পাশে বেডসুইচ জ্বালালো। আমাকে দেখে বলল, কি হয়েছে তোমার। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওর বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। আমার বার বার মনে হচ্ছে, আমার বউ যদি আগামীকাল মারা যায়। তাহলেও কি আমি ওর সাথে ঝগড়া করবো। আমি আমার বউকে কিছুতেই মরতে দিবো না।

বউ আমাকে কিছু বলল না। ও নিজেই আমায় দুই হাতে আঁকড়ে আছে। একটু পরে খেয়াল করলাম ও নিজেও কাঁদছে। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আছি তো। আমি আছি। আমার বুকে জড়িয়ে আছি দেখো। কিচ্ছু হবে না আর। আমরা ছাড়া আমাদের আর কে আছে বলো।’

আমি কিছুই বলতে পারছি না। আস্তে আস্তে আমার বুকটা শান্ত হয়ে গেলো। মনে হলো আমি স্বর্গের শান্তিতে আছি বউয়ের বুকে। বউকে আমার কিছুই বলতে হয়নি। হৃদয়ের কথা ঠিকই বউয়ের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত