একান্ত পছন্দের বান্ধবী সুষ্মিতার হাতখানা, খুব কাছের বন্ধু সায়নের হাতে সঁপে দিয়ে অনিক মৃদু হেসে বলে…..
–তোকে খুব ভালবাসে । ওর খেয়াল রাখিস । শালা ওর চোখে যেদিন জল আসবে কেলিয়ে তোমায় সেদিন বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব বুঝলে । চল এবার প্রেম কর তোরা । আমি কাটলাম । টাটা । এনজয় ফ্রেন্ডস….
আঙ্গুলের ফাঁকে বাইকের চাবিটি বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে দি মোস্ট ইমোশনলেস, কলেজের সবচেয়ে কুল ক্যাজুয়াল ছেলে অনিক পিছন ফেরে । এগিয়ে যেতে থাকে একটু একটু করে । এক ফোঁটা চোখের জলও হয়ত ছলকে ওঠে । বুকের কোণে চিনচিনে ব্যথাটাও হয়ত জেগেই ওঠে আলগোছে । বাঁ হাতের মুঠোয় দমবন্ধ পিষতে থাকে জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি । হ্যাঁ সুষ্মিতাকে আজ প্রপোজ করবে বলেই কলেজে এসেছিল অনিক, কিন্তু সুষ্মিতার সামনে যেতেই হাসি হাসি মুখে সুষ্মিতা জানায় যে সে এবং সায়ন দুজনে দুজনকে পছন্দ করে । কথাটা শোনামাত্রই পায়ের তলায় যেন মাটি কেঁপে ওঠে অনিকের । কিন্তু দুজন কাছের বন্ধুকে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র টের পেতে না দিয়ে মুখে মেকি হাসি টেনে অনিক মিলিয়ে দেয় ওদের ।
যেতে যেতে আপনমনে বলতে থাকে এলোমেলো গদ্যরূপ কবিতার কিছু লাইন…….
“আমি ! আমি বেশ ভালো আছি…..
অঙ্কের কোচিংয়ে তোর পাশের সিটে আমার স্থান,
নোটসের বাহানায় তোর বাড়িতে যথেচ্ছ আনাগোনা,
গাল টেপার অছিলায় তোর নরম স্পর্শ,
মন খারাপের মুহূর্তে আমার রুমালে তোর নাকের জল চোখের জলের মিলেমিশে একাকার,
বিশ্বাস কর এসব নিয়ে আমি দিব্যি ভালো আছি ।
মাসের ওই পাঁচদিনে পেটের যন্ত্রণায় যখন তুই বেসামাল, সেই মুহূর্তে তোকে সামলে নিয়ে…..আমি ভালো আছি ।
ছুড়ে ফেলা কাগজের কাপে লেগে থাকা তোর লিপস্টিক হাতড়ে…..আমি ভালো আছি ।
রেগে ভস্ম করে দেওয়া তোর ওই দৃষ্টিতে খুন হয়ে…..আমি ভালো আছি ।
আমি ! আমি খুব খুব ভালো আছি……
বুক ভরে শুষে নেওয়া তোর চুলের গন্ধ,
সেলফোনের রেকর্ডারে সেভ করা তোর শাকচুন্নী হাসি,
বাঁহাতের কব্জিতে আমরণ জেগে থাকা তোর রাগী গজদাঁতের কামড়ের দাগ,
বন্ধুত্বের প্রথম বসন্ত উৎসবে তোর মুঠোভর্তি রংয়ের ছোঁয়া,
বিশ্বাস কর এসব নিয়ে আমি সত্যিই ভালো আছি ।
ভালো না থেকে উপায় আছে বুঝি !
অসুবিধে তো কিছুই নেই…..
কৈফিয়ত নেই, রাগারাগি নেই,
নেই গিফটের অদলবদল,
নেই কোন চাওয়া,
হেঁ হেঁ পাওয়ার আশাও নেই,
জানতে চাস কি আছে তবে!….
আছে শুধু…..এক তরফা প্রেম,
হ্যাঁ আমি ভালো আছি…. আমি সত্যিই ভালো আছি রে….আমার ওয়ান সাইডেড লাভে আমি ভীষণ ভালো আছি ।।
********************
পিছন থেকে জোরে জোরে ভেসে আসে খুব চেনা মেয়েলি কণ্ঠ……যেন তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলছে চিৎকার করে….
–এ ছেলের দ্বারা আর যাই হোক প্রেম হবে না বুঝলি সায়ন…….
থমকে যায় অনিক । মনের মধ্যে কোন আশাই জাগে না তার । তবু কিসের টানে যেন সে থেমে যায় ।
এবার আরো একটু জোরে হাঁকডাক….
–ওয়ে জনদরদী আপনভোলা….হ্যাঁ হ্যাঁ তুই….তোকেই বলছি রে অনিক । দাঁড়িয়ে যখন পড়েছিস এবার একটু দয়া করে এদিকপানে ফিরে আয় বাবা…..
কনফিউশনে পিছন ফেরে অনিক । যা ভেবেছে ঠিক তাই । সায়ন হাত নেড়ে ডাকছে তাকে । পাশেই মিচকে মিচকে হাসছে সুষ্মিতা । কি হল ব্যাপারটা ! ফিরে যায় অনিক । এবার দ্রুত । সামনে যেতেই অনিককে অবাক করে বুকে জড়িয়ে ধরে সায়ন ওকে । ধীর গলায় বলে…..
–ভাই আমার কোন দোষ নেই । সব এই সুষ্মিতার প্ল্যান । তুই যে ওকে ভালবাসিস তা আমরা বেশ জানি, কিন্তু তোর মুখ থেকে কথা বের করার জন্য সুষ্মিতাই এই ফন্দি আঁটে । আমাকে জোর করে দলে টানে । আমি আর কি করব বল…….
–হ্যাঁ হ্যাঁ খুব উপকার করেছিস আমার । যা ভাগ । আর এই বাজে ছেলেটি তো সে আশায় জল ঢেলে দিল সে বেলা…..
সায়নের দিকে গোল গোল চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে সুষ্মিতা ।
–এক মিনিট এক মিনিট । কি বলছিস বল তো তোরা ! আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না ! একটু খুলে বলবি ?
চিন্তিত গলায় অনিক প্রশ্ন করে…….
–হ্যাঁ তা মাথায় আসবে কেন আপনি তো পরোপকারী মানুষ । আপনি এসব বুঝবেন কেন….ভেবেছিলাম সায়ন আর আমার মিথ্যে প্রেমের গল্প তোকে শোনালে ইমোশনাল হয়ে তুই রাগে অভিমানে আজ বলেই ফেলবি যে তুই আমাকে কতটা ভালবাসিস কিন্তু কোথায় কি !! তুই কিনা আমার হাত ধরে সঁপে দিলি সায়নের হাতে, কি অদ্ভুত ! তোর মন নেই নাকি রে ! তোর মনে এতটুকু হিংসে এলো না সায়নের ওপর ! তুই মানুষ ! তুই কি…….
দুঃখ দুঃখ ভাব করে বলে চলে সুষ্মিতা ।
–আমার ওয়ান সাইডেড লাভ এতটা স্বার্থপর নয় রে পাগলী । তোরা আমাকে এই চিনলি ! তুই যেমন আমার প্রথম প্রেম তেমনি সায়নও আমার জীবনের প্রথম ভালো বন্ধু, সেই ছোট্টবেলার বন্ধু । তোদের আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি । তোরা যখন বললি তখন বিশ্বাস না করে উপায় কি । তোদের খুশির কাছে আমার খুশি নিতান্তই তুচ্ছ…….. ভালবাসা মানে কি শুধুই পাওয়া ! ভালবাসার মানুষ গুলিকে সুখী দেখার মধ্যেও যে এক পরম পাওয়া আছে…..
অনিক বলে চলে আনমনে ।
অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সায়ন আর সুষ্মিতা । এ কোন অনিক ! এই কি সেই কুল ক্যাজুয়াল ইমোশনলেস অনিক ! সত্যিই ওয়ান সাইডেড লাভ মানুষকে উদারতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায় । পরিণতি পায় আরো একটি ওয়ান সাইডেড লাভ ।
…………………………….সমাপ্ত……………………………….
(বিঃদ্রঃ- এটা নিছকই গল্প । এরকম কত একতরফা প্রেম আছে আশেপাশে, যারা হয়ত অনিকের মত পরিণতি পায়নি । কিন্তু তবুও তারা বেশ ভালো আছে তাদের ওয়ান সাইডেড লাভ বুকে আঁকড়ে…আর যারা বোধবুদ্ধি প্রেম ভালবাসা খুইয়ে ভুলভাল পদক্ষেপ নেয় ভালবাসার মানুষটিকে না পেয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই…..ভালবাসা মানে কি শুধুই পাওয়া !!!)