সৈয়দপুর আর্মি ক্যান্টনমেন্টের পাশে কিছু দোকান আছে। এক টাকা থেকে পাঁচ টাকায় বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু ভাজা-পোড়া খাবার পাওয়া যায়। পাশে একটা মদেরও দোকান আছে। প্রকাশ্যে বিক্রি না করলেও অনেকেই সেখানের নিয়মিত খদ্দের। গোটা দেশ জুড়েই মদের রমরমা ব্যবসা চলে, তবে তা লাইসেন্সবিহীন অপ্রকাশ্যে। ভাজা-পোড়ার দোকানগুলো বিহারিদের। চাকরীর সুবাদে জেনেছি, খেয়েছি। অসংখ্য মানুষ গ্যাসট্রিক নিয়েও গলা অব্ধি খাচ্ছে।
নীলফামারী আমার দেখা সবথেকে পরিস্কার শহর। একসময় এখানে অসংখ্য শুয়োরের পাল দেখা যেত, এখন তেমন একটা দেখা যায় না। নীলফামারীর একটা মহিলা কলেজে ইংরেজী সাহিত্য পড়াই। আমার একটা ঠুনকো ঘর ছিল। মেসবাড়ির ঘর। আমি ঘরের টিনের ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো দেখে ঘুম নিয়ন্ত্রণ করতাম। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোটা পড়ে গলা থেকে পেট পর্যন্ত ভিজে যেতাম। সেই রাতে আর ঘুম আসত না, ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করতাম। হাতে থাকত- একটা গোল্ডলিফ। চোখে সেই অন্ধকার রাতেও চশমা দিতাম। কালো ফ্রেম, গোল চশমা। আমার চোখে কোন সমস্যা নেই, কি বুঝে যেন চশমা পড়তাম।মাঝে মাঝে মা ফোন করে খুব জ্বালাতন করত। ফোন করেই বলত- “আজ দুপুরে খেয়েছিলি?”আমি মিথ্যে না বলে বলতাম- “না মা খাইনি।”
“রাতে খেয়েছিস?”
“খাবো মা।”
“আর কতদিন এভাবে কাটাবি?”
“ভালোই তো আছি মা।”
“ওইসব ছাইপাশ বাদ দিয়েছিস?”
আমি মিথ্যে বলতে পারতাম না। বলতাম- “না মা, ছেড়ে দেবো।”আমার কোন কাজের লোক ছিল না, নিজের রান্না নিজেকেই করতে হতো। যখন ক্ষুধা লাগত সুঘ্রাণ স্বাদহীন রান্নায় পেট ভরে নিতাম। মাঝে মাঝে স্টুডেন্টরা প্রশ্ন করত- “স্যার আপনার কি বয়স বাড়েনা?” আমি বলতাম- “কেন বাড়ছে না? এই দেখ- আজকে আমি ৩৩ বছর, তিন মাস ২সপ্তাহ, ১৩ঘন্টা, ২৫মিনিটে পৌঁছুলাম।” স্টুডেন্টরা বলত- “স্যার দিনের হিসাব বুঝলাম কিন্তু ঘন্টা-মিনিটের হিসাব রাখলেন কি করে?””জন্মের পর পর বাবা একটা ডায়েরিতে, দিন-তারিখ, ঘন্টা-মিনিট সব লিখে রেখেছিলেন। আমি বুঝতে শেখার পর থেকে হিসাব রাখতে শুরু করেছি।” “স্যার আপনি এই হিসেব রাখেন কি করে?” “এটা কোন ব্যাপার না। ঘড়িতে সময় দেখা আমাদের নিয়মিত অভ্যাস, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা-টাকে একটু হিসাব রাখলেই অনেক ভিন্ন কিছু করা যায়, যা সচরাচর কেউ করে না।”
স্টুডেন্টদের মধ্যে কত কত কৌতুহল আমায় নিয়ে। আমি সাধারণ-স্বাভাবিক সচরাচর যেমন থাকি তেমনই থাকতাম। মানুষ আমার মাঝে সুন্দর ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেত। সাইন্স পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা এসে তাদের প্ল্যান, নতুন নতুন উদ্ভাবন জানাতো। আমি সাহিত্যের শিক্ষক আমি রসায়ন-বায়োলজির কি বুঝি? কিন্তু রসায়ন আর বায়োলজির শিক্ষার্থীরাই বেশি আসত। নিজেকে মাঝে মাঝে রসায়ন-বায়োলোজির গুরু মনে হতো। ছেলে-মেয়েগুলোর মেধা, পরিকল্পণা চমৎকার। মাঝে মাঝে রানী ফোন করত। রানী আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী। ও হিন্দু আমি মুসলমান।ফোন করেই মিষ্টি করে জিজ্ঞাস করত- “কেমন আছো?” মনে হতো জনম জনম ধরে তার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক। আমি সচরাচর যেমন ভাবে কথা বলি ঠিক সেভাবেই বলতাম- “হ্যাঁ, বেশ ভাল আছি। তুমি কেমন আছো? পিচ্চি কি বড় হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, সে তো এখন তোমাকে বাবা বলে ডাকে।”
“সর্বনাশ! কি অলক্ষণে কথা!”
“তোমার ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে চেনাচ্ছি, তুমি তার বাবা।”
“কি সর্বনাশ!”
“সর্বনাশের কি হলো? বাবাকে বাবা বলবেনা?”
“আমি ওর বাবা হলাম কিভাবে?”
“এভাবেই।”
“জামাইবাবু জানলে তোমার রক্ষে নেই।”
“হি হি, তোমার জামাইবাবু, মাঝে মাঝেই কি বলে জানো? বলে- তোমার প্রথম জামাইকে, বিরহের জীবন বাদ দিয়ে এইবার একটা বিয়ে-শাদী করতে বল। উনার ছেলেকেও তো কিছুদিন পরে বিয়ে দিতে হবে। মানুষ যদি জানতে পারে- ছেলের বাবাই বিয়ে-শাদী করেনি- মানুষ কি বলবে?” “ছি ছি রানী অবিবাহিত একটা ছেলের চরিত্রে তোমরা দু’জন মিলে কলঙ্ক দিলে।” রানী হো হো করে হেসে উঠত। সেই হাসি আর থামত না। জামাইবাবু পাশ থেকে বলে উঠত- “বাবুর বাবা থামেন নইলে আপনার বউ হাসতে হাসতে বিছানা থেকে পড়ে যাবে।” “আমারও হাসি পায়, আমিও হাসি, আমার হাসিতে কোন শব্দ নাই।” রানী আবারও সেই পুরোনো কথা বলতে শুরু করে দিতো। ছেলের নাম! আমাকে ছেলের ডাক নাম রাখতে হবে। আমি নাম না দিলে ছেলের কোন ডাকনাম নাকি তারা রাখবে না। রানী বলত- “তোমার ছেলের নাম টা তো এখনো দিলে না। সে তো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল, সবাই তাকে এখনো বাবু বলে ডাকে।”
“আহহা তোমরা দিয়ে দাওনা।”
“বাবুর বাবার আশায় থাকতে থাকতে শেষ পর্যন্ত সেটাই করতে হবে।” আমি শব্দ করে হাসতাম। রানীর গলায় অভিমানের ঝর বয়ে যেত-
“হাসবে না তুমি। তুমি কি বল তো কি এক পৃথিবীকে নিয়ে পড়ে থেকে বিয়ে শাদী কিচ্ছু করলে না, এখনও কি ইচ্ছা করে না?”
“কি যে বল না। সবাইকে বিয়ে করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাদকতা আছে? ভালোই তো আছি, তাইনা বল! ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে ব্যাপক। যা ইচ্ছে করছি, নিকোটিনের তীব্র ধোয়াতেও কেউ বারণ করে না। জীবন তো থেমে নেই, কাটছে, ভাল কিবা মন্দ।” রানী বেশ রেগে যেত। রাগ রাগ গলায় বলত- “বাদ দাও তো। তোমার কি কোন অনুভূতি নাই নাকি? মেয়েদের দেখলে এখনও কোন অনুভূতি জাগে না?” “জাগবে না কেন! জাগে। সব পুরুষ মানুষদেরই জাগে। তোমার জামাইবাবুরও অনুভূতি জাগে। তোমাকে বাদেও তার অনুভূতি অন্য মেয়েদের প্রতিও জাগ্রত হয়।” “এতো এতো ছাত্রী তোমার, কাউকে পছন্দ হয় না?”
“হবে না কেন হয়, আমার ক্ষেত্রে এটা মুহূর্তের ব্যপার, এক মুহূর্ত গেলেই কোন সুন্দরীকে দেখেছি ভুলে যাই। কারো অবয়ব প্রতিচ্ছবি আমাকে ভুলিয়ে দেয়।” “হয়েছে হয়েছে আর ২১ বছরে ফিরতে হবে না। ভাবছি তোমার ছেলে বুকের দুধ ছাড়লেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো।” “সর্বনাশ! এই ভুল কোরো না আমার কাছে পাঠিওনা, ভুলেও না। আমার সাথে থেকে থেকে আমার মত নিশাচর, বিকারগ্রস্থ মস্তিস্কের মালিক হবে।”
“তা হোক তাতে কোন সমস্যা নাই। শোন- ছেলের একটা নাম দিও।”
“আচ্ছা, দেবো।”
“ভুলে যেয়ো না কিন্তু…”
“আচ্ছা ভুলব না।”
“তিন বেলা খাবার খাওয়ার অভ্যাসটা কর।”
“সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বলে আসছো।”
“শুনলে কোথায়? আজীবনই বলে যাব।”
“সে কথা আমি জানি।”
“পৃথিবীর কাছে কি পেলে বল? সে কি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে? নিজে তো ঠিকি সুখের কথা ভেবেছে, নিজের মত সংসার সাজিয়েছে। আর তুমি?”
“তুমি তো জানোই ওর সাথে আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না, তারপরও কেন এভাবে বল?”
“জেনে কি লাভ ? সে তো জানত, সে তোমার পৃথিবী- জেনেও কি করে তোমাকে একলা করে দিয়ে চলে গেল?”
“দেখ রানী প্রত্যেকটা মানুষের কিছু নিজস্ব পছন্দ থাকে। মানুষ মাত্রই আছে। সে আমার প্রিয় মানুষ ছিল, তার হয়তো ছিল অন্য কেউ। মনের উপর কার হাত আছে বল? সবকিছু আমি নিয়তির উপরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার হয়তো যোগ্যতা ছিল না।”
“এখন যখন যোগ্যতা হয়েছে তখন তুমি ফ্রি মাস্টার হয়ে সবাইকে ফ্রি পড়াচ্ছো?”
“টাকা দিয়ে কি হয় বল তো? টাকার মূল্য শুধু যোগ্যতায়। সেই যোগ্যতা আমার পক্ষে আর অর্জন করা সম্ভব না।”
“হয়েছে হয়েছে। তোমার এইসব কথা শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।”
“অনেকদিন হলো, তোমার সাথে বিলে যাই না, সেই লন্ঠন, সেই নৌকা! কবে আসবে?”
“আসব আসব। আজকেই আসি?”
“সত্যি?”
“সত্যি বলছি। রাতের গাড়িতেই আসছি।”
“আমার উপলক্ষ্যে কিছু রেঁধো না।
“বাদাম ভর্তাও না?”
“না। এতে অনেক কষ্ট। তুমি বরং যা কর সবসময় তাই-ই কোরো।”
“আচ্ছা। সত্যি আসছো?”
“হ্যাঁ, সত্যি আসছি।”
“বিশ্বাস হচ্ছে না, কতবার এমন বলেছ পরে আর আসো নি।”
“এবার আসব।”
“আমি তাহলে এক কাজ করি- তোমার জন্য একটু কিছু রান্না করি।”
“কিছু রাঁধতে হবে না।”
আমি জানি রাত জেগে রাজ্যের সব রান্না রানী করেছিল। খুব খুশি মনে করেছিল। জামাইবাবুর হয়তো একটু হিংসাও হয়েছিল। আজ প্রায় দেড় বছর পর ঢাকা যাচ্ছি। রানীর ছেলেটা স্পষ্ট ভাবে বাবা ডাকতে শিখেছে। আমি তার নাম রেখেছি ‘প্রশ্ন।’. কাউন্টার থেকে রাত সোয়া বারোটার টিকিট কেটে রিক্সায় করে আমার ঠুনকো ঘরে ফিরছিলাম। মেসবাড়িটা বদলেছি, টিনের চালে এখন আর ফুটো নেই। ঝড় বৃষ্টির রাতে মা আর ফোন করে জ্বালাতন করে না এক বছর হলো। জীবনের শেষ দিনগুলো সে আমার সাথে কাটিয়ে গেছে। ফোন বের করে পৃথিবীর ম্যাসেজ পড়ছিলাম। কত বছরের পুরানো-ম্যাসেজ! স্মৃতির পাতাগুলো আজও অমলিন রয়ে গেছে।
ফোনে একটা নটিফিকেশন উঠে আছে। আজ সারা’র জন্মদিন। মেয়েটার আমার জন্যে খুব মায়া। সবসময় মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কখনো কিছু বলে না। শুধু- কলেজ ছুটিতে বাড়ি গেলে ফেরার সময় আমার জন্য টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে খাবার নিয়ে আসে। আমার সবগুলো স্টুডেন্ট-ই খুব ভাল, কিন্তু কেন যেন ‘সারা’ সবার চেয়ে একটু বেশি ভাল। সে খুব নিরব প্রকৃতির মেয়ে, ক্লাসে কখনো কোন হৈচৈ করে না, পুরো ক্লাস চুপচাপ বসে থাকে। আমি সারাকে ফোন করলাম। ফোন ধরার পর জিজ্ঞাসা করলাম- “তুমি কোথায়?” সারা বলল- “স্যার আমি হোস্টেলে।”
“ও আচ্ছা। তাহলে তুমি আধাঘন্টা পর লাইব্রেরীতে আসো। আমি আসছি।”
“স্যার কিছু দরকার?”
“রাতের গাড়িতে ঢাকা যাচ্ছি পাঁচ হাজার টাকা লাগবে, আমি আগামী-মাসে দিয়ে দিব।”
“স্যার আপনাকে এইটাও বলতে হবে কবে ফিরিয়ে দিবেন। আসেন তো।”
“আচ্ছা আসছি।”
ক্লাসের অন্যদের দ্রুত লাইব্রেরীতে যেতে বলে আমি হায়দারকে ফোন করলাম। হায়দার লাইব্রেরীর দেখাশোনার দায়িত্বে আছে। হায়দারকে লাইব্রেরীর দরজা খুলে দিতে বলে, দোকান থেকে দুই পাউন্ডের একটা কেক-মোমবাতি কিনে লাইব্রেরীর দিকে গেলাম। লাইব্রেরীর সামনে রিতা, সুমনা, যুথি দাঁড়িয়ে ছিল। সারাকে ফোন করে বললাম, তাড়াতাড়ি সে যেন টাকা নিয়ে লাইব্রেরির সামনে আসে। সারা ছোট একটা পার্সে হাতে লাইব্রেরীর সামনে এসে যুথিকে জিজ্ঞাসা করল- “স্যার কোথায় রে?” যুথি বলল- “ভেতরে।” সারা ভেতরে ঢোকার আগেই লাইব্রেরীর বাতি নিভিয়ে দেওয়া হলো এবং আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম। “হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।” সারা বেশ অবাক হয়েছিল। খুশিতে তার চোখ দুটো ছলছল করছিল। কেক কাটার পর সারা আমার সামনে এসে পার্স থেকে টাকা বের করল। আমি বললাম- “সারা টাকা টাতো লাগবে না, আমি তো ওটা এমনিতেই বলেছি, যাতে তুমি কিছু বুঝতে না পারো।” সারা জিজ্ঞাসা করল- “স্যার, ক’টার গাড়িতে যাবেন?”
“সোয়া বারোটার গাড়ির টিকিট কেটেছি। কিছু কাজ আছে, শেষ করে কাউন্টারে চলে যাবো।” “এক মিনিট দাঁড়ান স্যার, আমি আসছি।” কিছুক্ষণ পর সারা এসে একটা চিরকুট আমার হাতে দিয়ে বলল- “স্যার, এটা গাড়িতে উঠে খুলবেন।” আমি গাড়িতে বসে আছি। চিরকুটে কি লেখা থাকতে পারে, ভাবছি। ভেবে বের করতে পারছি না। সব রহস্যের উদঘাটন করতে পকেট থেকে বের করে চিরকুট-টা খুললাম। সেখানে শুধু একটি লাইন ছিল- “স্যার, আপনি এতো ভাল কেন? আমার খুব কষ্ট হয়।”