মরীচিকা

মরীচিকা

_আমি মরে গেলে আপনি আবার বিয়ে করবেন?

হুট করে এমন কিছু শোনায় একটু চমকে উঠলো রেহাল। কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখেই নন্দিতার দিকে তাকালো সে। বিছানার এক কোণায় ভেজা চোখে বসে আছে মেয়েটি।

_ হঠাৎ এমন কথা জিজ্ঞেস করার কারন?
_ না এমনি।

নন্দিতা উঠে বারান্দায় চলে গেলো। অনেক অফিসিয়াল কাজ পরে আছে রেহালের। তবুও ল্যাপটপ শাট ডাউন দিয়ে রেখে দিলো। নন্দিতার কথা এখনো কানে বাজছে তার। বিয়ে হয়েছে প্রায় এক বছর কিন্তু রেহাল আর নন্দিতার মাঝে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিলো রেহালের। তবে মেয়েটার পরিবার ভালো ছিলো না। বাসায় বিষয়টা জানাজানির পর রেহালের বাবা বেপরোয়া হয়ে উঠেন ছেলেকে বিয়ে দেবার জন্যে। মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলো রেহাল, কিন্তু সফল হয় নি। নিজের ব্যর্থতার সব রাগ, জিদ বিয়ের রাত থেকেই নন্দিতার ওপর ঢেলে আসছে সে।

নন্দিতা আজ খুব কঠিন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। রেহালের কাছে উত্তর না থাকায় অস্বস্তি লাগছে তার। মনের মধ্যে এক প্রকার চাপা ভয়ও কাজ করছে। কিন্তু কেনো? এক ছাদের নিচে থেকেও নন্দিতার দিকে কখনো ভালোমতো তাকিয়ে দেখে নি রেহাল। কোনো অনুভূতিও কাজ করে নি বরং আশেপাশে নন্দিতার অস্তিত্ব তাকে বিরক্ত করেছে।
অলসতা নিয়ে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় রেহাল। নন্দিতা গ্রীল ধরে এখনো কাঁদছে। জোৎস্নার আলোয় চোখের পানি গুলো চিকচিক করছে। রেহাল দেখলো, মেয়েটা খুব একটা সুন্দর নয়। তবে তার মাঝে আলাদা কিছু রয়েছে। মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলে মোহগ্রস্ত হওয়া অবিশ্বাস্য কিছু নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে রেহাল বললো,

_ বিয়ে করবো।

নন্দিতা এবার উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো। মেয়েটাকে শুরু থেকেই কাঁদিয়ে আসছে রেহাল। নন্দিতাকে কাঁদিয়ে সে পৈচাশিক আনন্দ পায়। কিন্তু আজ মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিলো। কৌতূহলবশত, নিজের অনুভূতি আরেকটু খুঁটিয়ে দেখার জন্যই নন্দিতাকে এই উত্তরটা দেয় সে। তবে এভাবে কাঁদতে শুরু করবে তা বুঝতে পারে নি। একটু অপ্রস্তুত হয়ে রেহাল বললো,

_ আমি মজা করছিলাম। কেঁদো না। বিয়ে করবো না আমি। কান্না থামাও।
_ সত্যি তো?
_ হ্যাঁ সত্যি।

নন্দিতা চোখ মুছে রেহালের দিকে তাকালো। অনেক সময় ধরে একটানা কান্না করায় মেয়েটার হেচকি উঠছে। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন নন্দিতার দিকে তাঁকিয়ে থেকে আচমকা দুই হাত দিয়ে তার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিলো রেহাল। নন্দিতা চমকে উঠলো। তার হেচকি উঠা বন্ধ হয়ে গেলো। খানিকটা লজ্জাও পেলো। এদিকে রেহাল এভাবে নন্দিতাকে স্পর্শ করায় নিজেই বোকা বনে গেলো। সব কিছু উলটো পালটা হচ্ছে তার সঙ্গে।

অফিসের এসি রুমে বসে নন্দিতাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছে রেহাল। কেনো করছে সে নিজেও জানে না। তবে খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে সাথে নিয়ে দূরে কোথাও একান্তে কিছু সময় কাটাতে। নন্দিতার কি পাহাড় পচ্ছন্দ নাকি সমুদ্র? সংকোচ ঝেড়ে মুঠোফোন হাতে নিয়ে নন্দিতার নাম্বার ডায়াল করে বসলো। বুক ধুকপুক করছে রেহাল এর। নন্দিতা সবে মাত্র রান্নাঘরের কাজ সেরে ঘরে ফ্যান এর নিচে এসে বসেছে। এর মাঝেই রেহাল এর ফোন। অবাক হয়ে ফোন রিসিভ করে নন্দিতা। ওপাশ থেকে করা প্রথম প্রশ্ন,

_ তোমার সমুদ্র পচ্ছন্দ নাকি পাহাড়?
_ পাহাড়।
_ ঘুরতে যাবে? নন্দিতার চোয়াল ঝুলে পড়লো। ফোন হাতে নিয়ে নম্বরটা চেক করে নিলো তাড়াতাড়ি। না, এত রেহালেরই নাম্বার!
_ ঘুরতে যাবো? কোথায়?
_ এই যে বললে তোমার পাহাড় পচ্ছন্দ। তাহলে বান্দরবান? ব্যাগ গুছিয়ে ফেলো। আমি আজ সন্ধ্যার বাসের টিকিট ম্যানেজ করছি।
_ আচ্ছা।

নন্দিতা ফোন রেখে নিজের গায়ে জোরালো ভাবে চিমটি কাটে। নাহ! স্বপ্ন নয়। এতক্ষন যা ঘটেছে সব সত্যি।
অফিসে এখনো ঝুম ধরে বসে আছে রেহাল। তার মস্তিষ্কে তীব্র দ্বন্দ চলছে। মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই। তবে কেনো সে এতদিন তাকে স্ত্রীর মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে? গতকাল মেয়েটার রেহালের উদ্দ্যেশ্যে করা প্রশ্ন আতংকের ছাপ ফেলে দিয়েছে। রেহাল জানে, মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা স্বর্ণের দোকানে গিয়ে ঢুকে রেহাল। নন্দিতার আঙ্গুলের মাপ সে জানে না। তবুও আন্দাজের ওপর ভর করে এক পাথরের একটা আংটি কিনে নেয়। বিল পরিশোধ করার সময় রেহালের মোবাইলে রিং বেজে উঠে।

_ হ্যালো।
_ আসসালামু আলাইকুম। আমি সাইরু হিল রেসোর্ট থেকে আশফাক বলছিলাম।
_ ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি বলুন।
_ আপনার বুকিং এর কনফার্মেশন জানাতে ফোন করা হয়েছে। স্যার, আপনি প্রথমে যে রুমটা চুজ করেছেন সেটা লাকিলি আজকেই খালি হয়ে যাচ্ছে। আপনি চাইলে এখন ওই রুম বুকড করে রাখতে পারেন।
_ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ওই রুমটাই বুকড করে রাখুন।
_ ওকে স্যার। হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।

ফোন কেটে দিলো রেহাল। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলা করছে। আজ নন্দিতাকে নিয়ে মেঘ ছুঁবে রেহাল। হারিয়ে যাবে নতুন করে গড়ে ওঠা স্বপ্নের রাজ্যে। আজ থেকে নন্দিতাকে খুব করে ভালোবাসবে রেহাল। বিছানায় একটি মাত্র বালিশ রাখবে। নন্দিতা তার বুকের বা পাশে ঘুমাবে। আচ্ছা ও কি বেলিফুল পচ্ছন্দ করে নাকি কাঠমালতি? যে ফুলই পচ্ছন্দ করুক! রেহাল নিজ হাতে মালা গেঁথে চুলে পড়িয়ে দিবে নন্দিতাকে। আর মাত্র ক’টা ঘন্টা! তারপর নতুন করে শুরু হবে তার জীবন। নতুন কিছু ওয়াদা, নতুন দায়িত্ব নিতে হবে কাধে। রেহালের যেনো আর তর সইছে না। বার বার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনছে সে। রাস্তার ওপাশে বাস কাউন্টার। তার পাশে একটা পিচ্চি মেয়ে ফুল বিক্রি করছে। নন্দিতার কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে রেহাল বললো,

_ তুমি দাঁড়াও। আমি ব্যাগগুলো কাউন্টারে রেখে আসছি।

নন্দিতা হ্যাঁ সূচক মাথা রাখলো। তার দৃষ্টি ওই ফুল বিক্রেতা মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত রাস্তার এপারে আসবে। আসলে, ওর কাছে থেকে ফুল কিনবে নন্দিতা। মেয়েটা যখন প্রায় মাঝ রাস্তায় তখনই নন্দিতা লক্ষ্য করলো একটি বাস বেপরোয়া গতিতে মেয়েটার দিকে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে নন্দিতার মনে পড়ে গেলো তার ছোট বোনের কথা। কলেজ পড়ুয়া বোনকে সেদিন বাঁচাতে পারে নি সে। চোখের সামনে রাস্তা পার হতে গিয়ে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো তার শরীর। প্রাণঘাতী বাস কেড়ে নিয়েছিলো তার প্রাণ। হিস্টোরি রিপিটস ইটসেল্ফ। কিন্তু আজ এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। কিছু না ভেবেই রাস্তার মাঝ বরাবর দৌঁড় দেয় নন্দিতা। বাচ্চা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে নিরাপদ দুরত্বে পৌঁছে দিতে পারে ঠিকই কিন্তু চাপা পড়ে যায় নন্দিতার দেহ। রক্ত ফিনকি দিয়ে উঁঠে। রাস্তার চলমান সকল যানবাহন থেমে যায়।

ব্যস্ত রাস্তা মুহূর্তেই পূর্ণ হয়ে ওঠে যানজটে। হইচই শুনে কাউন্টার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে রেহাল। কেনো জানি তার হাত পা কাঁপছে। ভীড় ঠেলে সামনে এগোতেই দেখতে পায় নন্দিতার রক্তাক্ত নিথর দেহ। রেহাল এর দৃষ্টি স্থির। আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সারাদিন দাপিয়ে উড়ে বেড়ানো কাকগুলোও ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডানা ঝাপটে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় দাঁড়িয়েও রেহালের কানে বারবার এক কথাই বেজে চলেছে, ” আমি মরে গেলে আপনি আবার বিয়ে করবেন?” রেহালের অশ্রুফোটা উত্তর হয়ে পড়ছে নন্দিতার লাশের ওপর। দিব্যদৃষ্টিতে রেহাল দেখলো, মেয়েটা হাসছে। খুব হাসছে। কি মায়া মেশানো সে হাসি!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত