এই ভালবাসার নাম কি

এই ভালবাসার নাম কি

রাত প্রায় তিনটা বাজে। এমন সময় হঠাৎ করেই সেতুর ঘুম ভেঙে গেল। সে খেয়াল করল তার গা ঘেমে একাকার অবস্থা। আর বুকে একটু চিন চিন ব্যথা করছে৷ সে ধীরে ধীরে উঠে বসল, যাতে শুভ্রর ঘুম ভেঙে না যায়। কারণ সকালেই আবার শুভ্রর চেম্বারে যেতে হবে।

চার বছর হল, সেতু আর শুভ্রর বিয়ে হয়েছে। সেতু একটা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের লেকচারার। সেতু ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত প্রাণবন্ত একটা মেয়ে ছিল। আর সেইটা এখনও বর্তমান। সে সব দিক থেকেই সফল একজন মানুষ। স্ত্রী হিসেবে যেমন ভাল, মেয়ে হিসেবেও তেমনই ভাল, আবার বাড়ির বৌ হিসেবেও কোন দিক থেকে কম না। ঠিক তেমনই কলিগ হিসেবে, টিচার হিসেবে, বন্ধু হিসেবে সে সবার কাছেই প্রিয়। শুভ্রর সাথে সেতুর সম্পর্ক ও অত্যন্ত মধুর। শুভ্র পেশায় একজন ডাক্তার। অত্যন্ত ভদ্র আর পরিপাটি একজন মানুষ।তারা দুজন দুজনের জন্য একদম মনিকাঞ্চন জুটি। দুইজন দুইজনকে সব কাজেই সাপোর্ট দেয়।

যাই হোক, কয়েক মিনিটের মধ্যে সেতুর বুকের ব্যথাটা আরো বাড়তে থাকল। আর সে ক্রমাগতই ঘেমে যাচ্ছিল। একবার মনে মনে ভাবল, শুভ্রকে ডাকবে, কিন্তু কি মনে করে আর ডাকলনা। বেডের পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে সবসময় একটা গ্লাসে পানি ঢাকা থাকে। সেতু হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে গ্লাসটি পড়ে ভেঙে গেল। এতে শুভ্রর ঘুম ভেঙে গেল। সেতুর দিকে চোখ পড়তেই দেখল সে খাঁটের উপর বসে আছে। ড্রীম লাইটের হাল্কা নীল আলোতে তার শরীরের ঘাম স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। শুভ্র তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে সেতুকে জিজ্ঞেস করল-

-কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?
– আমি জানিনা শুভ্র, হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা চিন চিন করে উঠল। বুঝতে পারছিনা কেন এমন হচ্ছে??
– কতক্ষণ থেকে এমন হচ্ছে?
– প্রায় ১০ মিনিট।।
– আমাকে ডাকনি কেন সেতু?
-ভেবেছিলাম কমে যাবে, তাছাড়া তোমার তো সকালে চেম্বার আছে।
– ধূর পাগলী, আচ্ছা দাঁড়াও আপাতত তুমি একটা গ্যাসের ওষুধ খাও। কাল কলেজ ছুটি নিয়ে নিবে। তোমাকে আমার হসপিটালে নিয়ে যাব। কিছু টেস্ট করাতে হবে। টেস্ট না করে আপাতত কোন ওষুধ দিবনা।

– ওকে, শুভ্র আমার না খুব অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে লাইফ থেকে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে।
– আচ্ছা কি হয়েছে বল তো? কিছু নিয়ে টেনশন করছ?
– না, কিছুই বুঝতে পারছিনা কেন এমন লাগছে।
– আচ্ছা এত ভাবতে হবেনা। তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর, আমি মাথায় হাত বুলায়ে দিচ্ছি।
– সেতু আর কোন কথা বললনা। চুপচাপ শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল ৭.৩০ এর দিকে সেতুর ফোন বেজে উঠল। সেতু শুভ্র দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল। ফরহাদ সাহেব ফোন করেছে। শুভ্র জিজ্ঞেস করল, কার ফোন। সেতু বলল, ফরহাদ ভাইয়ার নাম্বার থেকে কল এসেছে। মনে হয় রিপা ফোন দিয়েছে। রিপা সেতুর বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে দুজনের ফ্রেন্ডশিপ এর ব্যাপারে কারোর অজানা নেই। ওই যে বলেনা, সিস্টার ফ্রম এনাদার মাদার, বিষয়টা ঠিক সেরকম।দুজন দুজনের লাইফের একটা পার্ট। ফরহাদ হল রিপার হাসবেন্ড। রিপার ২ বছরের একটা মেয়ে আছে যার নাম হৃদি। গত সপ্তাহেই সেতু ঢাকাতে গিয়ে রিপার সাথে দেখা করে এসেছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে –

-(কাঁপা কন্ঠে) হ্যালো, সেতু!!
– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া?? কেমন আছেন? এত সকালে?
– (সালামের উত্তর না নিয়ে) রিপা আর নেই। কান্নার আওয়াজ।
– স্যরি , ভাইয়া কি বললেন?
– রিপা আর নেই সেতু। রিপা রাত তিনটার দিকে মারা গেছে।

সেতু কোন কথা বলতে পারলনা। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থাকার পর শুভ্রর বুকে মাথা দিয়ে জোরে জোরে কেঁদে বলল, শুভ্র রিপা মারা গেছে। শুভ্রও প্রস্তুত ছিলনা এইটা শোনার জন্য। সে বলল, কি বলছ? কখন?

– রাত তিনটার দিকে।

কি আশ্চর্যের কথা রাত তিন্টার দিকেই সেতুর বুকে চিনচিন করছিল, সে বলেছিল তার মনে হচ্ছে লাইফ থেকে কিছু চলে যাচ্ছে। আর সেই সময়ই রিপা মারা গেছে? এ কেমন আশ্চর্য বিষয়? এটাই কি তাহলে আত্মার সম্পর্ক??

রিপাকে শেষ বারের মত দেখার তিন দিন কেঁটে গেল। সেতু এখনো ভুলতে পারছেনা সমস্ত বিষয়।রিপাকে আর কখনো দেখতে পারবেনা এটা ভাবতেই পারছেনা৷। রিপা যে তার শুধু স্মৃতি নয়, তার লাইফের একটা পার্ট ছিল। যাই হোক, রিপা মারা যাওয়ার তিন দিন পর রাতে সেতু রিপাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখে। সেতু দেখে, রিপা তারই দেওয়া একটা শাড়ি পড়ে ফুলের দোলনায় দোল খাচ্ছে আর তাকে বলছে, সেতু তুই আমার মেয়েটার মা হবি?? ঘুম ভেঙে গেল সেতুর। সেই রাতে আর ঘুম আসলনা তার। পরের দিন আবার একই স্বপ্ন দেখে একি জায়গায় ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আবার নির্ঘুম রাত। শুধু এটুকুই না। পরের দিন ও একই স্বপ্ন দেখল সেতু।

৩য় দিন সে শুভ্রকে বলল আচ্ছা হৃদিকে যদি আমি আমার কাছে এনে রাখি তাহলে কি তুমি রাগ করবা? শুভ্র অত্যন্ত ভাল মনের একজন মানুষ। এবং সে সেতুর সমস্ত অনুভূতি বোঝে। তাই সে সেতুকে বলল দেখ, তুমি হৃদিকে আনতে চাচ্ছ, এখানে আমার কোন প্রবলেম নেই৷ কিন্তু ফরহাদ ভাই কি রাজি হবে? এখানে তাদের কিছু কথোপকথন হয়। তারপর তারা ফরহাদ সাহেবকে ম্যানেজ করে হৃদিকে নিয়ে আসে।

তারপর বেশ ভালোই দিন কাঁটতে লাগল। দেখতে দেখতে আট দিন কেঁটে গেল। ( বিকেল বেলায়) সেতু হৃদিকে নিয়ে নিজের ঘরেই ছিল৷ শুভ্র তখন হসপিটালে। সেতুর শাশুড়ি সেতুর ঘরে এসে বলল, সেতু মা হৃদির বাবা এসেছে, মনে হয় হৃদিকে নিয়ে যেতে। তাঁকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখেছি। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি। তুমি যাও, ড্র‍য়িং রুমে যাও।

সেতু যাচ্ছি বলেও গেলনা। হৃদিকে বুকে নিয়ে শুয়েই থাকল। মনে মনে বলল, রিপা তোর মেয়েকে হয়তো নিজের কাছে রাখতে পারবনা। কিন্তু বিশ্বাস কর, হৃদি আমারও মেয়ে। ওকে আমি মাতৃস্নেহ দিব।। সেতুর দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। জানিনা এই ভালবাসার নাম কি।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত