যে নদী মরু পথে

যে নদী মরু পথে

ফোনটা বেজে উঠতেই কেটে দিল তুষার। পরিচয়ের পর থেকে ট্রেডিশনটা চলে আসছে। এই মূহুর্টা তুষারের জীবনের সেরা মূহুর্ত। ওর ফোন থেকে কল আসলেই ওর উচ্ছাস যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়। নিজেকে পৃথিবীব সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হয়। ধন্য মনে হয় নিজেকে। এই মূহুর্তটাও এর ব্যতিক্রম নয়। রিং ব্যাক করতেই অপর প্রান্তের সেই মিষ্টি কণ্ঠ–
>একটা খুশির খবর আছে–
>বেশতো বল–
>১৭ই জানুয়ারি আমার বিয়ে–
>মানে–?
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি তুষার।
>মানে ১৭ই জানুয়ারি আমার বিয়ে। ছেলে আমাদেরই পাশের গ্রাম শিব পুরের। ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ম্যাথে থার্ড গোল্ড মেডিলিষ্ট। দর্শনা শাখায় পোষ্টেড–
তবুও বিশ্বাস করতে চাইল না তুষার। কথার মাঝে লিপির ভূবন ভোলানো হাসিটাকে প্রথম তামাশায় ভাবছিল তুষার। কিছু মানুষের এক চিলতে হাসির মাঝেই কিছু মানুষের সারা জীবনের আশ্রয়, নির্ভরতা লুকিয়ে থাকে। লিপির হাসিটাও তেমনি তুষারের কাছে। প্রতিটা রাত ওই হাসিটুকুর মাঝেই নিজের বাকি জীবনের আশ্রয়, নির্ভরতা খুঁজে ফেরে তুষার। সেই হাসির সাথে আজকের হাসির কি কোনো পার্থক অাছে?
>তোমায় একদিন বলেছিলাম না, সেলিম ভাইয়ের কথা? ওদের ফ্যামিলি থেকে আজ দিন করে গেল–
লিপির পরের কথায় চৈতন্য ফিরলো তুষারের। এবার আর স্হির থাকতে পারল না তুষার। সারা মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মনে পড়লো আগে দু একবার কথায় কথায় সেলিম সম্পর্কে বলেছিল লিপি। তবে কি এতোদিন লিপি ওর সাথে—-
আস্তে আস্তে ঘাসের উপর বসে পড়লো তুষার। পৃথিবীটা চোখের সামনে ঘুরছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই–
.
দীর্ঘ প্রায় চার বছরের স্বপ্ন, আশা, বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি। যার সূচনা করেছিল লিপি নিজেই। মেয়েদের প্রতি একটা তীব্র বিমুখতায় ছিল তুষারের। ওর স্হির বিশ্বাস ছিল ভালবাসার মর্যাদা রক্ষায় মেয়েরা অক্ষম। তাই সেই অনিশ্চিত পথটার প্রতি অনাসক্তই ছিল তুষার। কিন্তু যাত্রা পথের কোনো এক নির্জন সৈকতে লিপির আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে ফেলেছিল। মনে হয়েছিল লিপি নিশ্চয় আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মতো হবে না। মনে হয়েছিল ওকে বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় নিজের বাকি জীবনের ভারটা ওর উপর ছেড়ে দেয়াই যায়। লিপির বুক টাকেই পৃথিবীতে নিজের জন্য সব চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছিল। কিন্তু সেই আশ্রয় টা কেন আজ নিজেই কেড়ে নিতে চাইছে লিপি। স্মৃতি হাতড়ে নিজের কোথাও কোনো ভুল আছে কিনা খুঁজে দেখার চেষ্টা করলো তুষার। যতোটা দেখা গেল নিজেকে নির্ভারই মনে হল তুষারের–
>তুষার চুপ কেন? কিছু বলছো না যে–
এক হাতে চোখ মুছলো তুষার–
>তুমি বলে ছিলে তোমার ফাইনাল পরীক্ষার পর আমরা দুজন–
>হ্যাঁ তুষার, বলেছিলাম। কিন্তু সবার সেলিমকেই পছন্দ। সব মিলিয়ে—
>আমি এখন কি করবো–?
>জানিনা তুষার। বাড়িতে প্রস্তাব দিয়ে দেখতে পার। তবে একটা শর্ত আছে। তোমার সাথে আমার কোনো রিলেশন ছিল এটা বলতে পারবে না। তাহলে আমি সবার কাছে ছোট হয়ে যাব।
নিজের পৌরষে সব চেয়ে বড় আঘাতটা লাগলো তুষারের। চার বছর দুজন দুজনকে ভালবাসছে। আজ সেটা বাড়িতে বলতেই এতো দ্বিধা লিপির? ব্যাংক কর্মকর্তা পদবীটার কাছে এতো দিনের স্বপ্ন, প্রতিশ্রুতি এতোটাই মূল্যহীন?
>নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল। ভাল থেক, সুখে থেক।
.
ফোন ছেড়ে ঘাসের উপর সটান শুয়ে পড়লো তুষার। মূহুর্তেই পুরো পৃথিবীটা অচেনা হয়ে গেল। ঘাসের উপর শুয়েই অনেক ক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো তুষার। রাত সাড়ে দশটা পেরিয়ে গেছে। চোখ মুছে উঠে বসলো। ডাইনিং হলে যেতে ইচ্ছে হলোনা। মেসে ফিরে সোজা ছাদে উঠলো। শুয়ে পড়লো ফ্লোরের উপর। সারা রাত ঘুমাতে পারলো না। ডিসেম্বরের শেষ। ঘন কুয়াশায় ভিজে ভিজে শুধু ভাবলো, কি করে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলবে লিপিকে।
.
দশ বছবের সৈনিক জীবনের সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গেল তুষারের। খাওয়া, ঘুম, কাজকর্ম কোনো কিছুতেই আর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলো না তুষার।
দুদিন বাদে ফোন করে তুষারকে বিয়ের নিমন্ত্রণ জানালো লিপি। নিজের অযোগ্যতার উপর এটা যেন নতুন আঘাত। সইয়ে গেল তুষার—
>কি করে ভাবলে লিপি, ঢাকা থেকে সুদুর কুলবাড়িয়া নিমন্ত্রণ খেতে আসবো আমি? সেও আবার তোমার বিয়েতে।
>তাহলে মেহের পুর পর্যন্ত আসো। পার্লারে। নতুন বউ সাজে আমায় কেমন লাগে দেখবে না?
>না লিপি। তোমায় নিজের বউ হিসেবে দেখতে চেয়েছি। সেটাই ভেবে এসেছি এতো দিন। অন্যের বউ রুপে তোমায় দেখবো এতোটা মানষিক শক্তি আমার নেই। শুধু এই টুকু মনে রেখ, আমি তোমায় ভালবেসেছি। নিজের জীবনের চেয়ে বেশী ভালবেসেছি। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না এর চেয়ে সত্যি নাই। তোমার জন্য এজীবন হারাতে আমার আপত্তি নাই—
ফোন ছেড়ে দিল তৃষার। ভেবেছিল লিপি হয়তো তার ভালবাসা বুঝবে। ফিরে আসবে ওর কাছে। কারন আগামীর সব স্বপ্ন তো দুজন মিলেই সাজিয়ে ছিল। বিয়ে সংসার এমনকি সন্তানের সিদ্ধান্তও দুজন মিলেই ঠিক করে রেখেছে।
.
তুষারের শেষ আকুতি টাও শোনেনি লিপি। সে তখন সেলিম আজাদের সংসার সাজাবার আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত। তুষারও নিজের গন্তব্য ঠিক করে নেয়। সে বেঁচে থাকতে অন্য কেউ লিপিকে নিয়ে বাসর সাজাবে, ওকে স্পর্শ করবে এটা অনুভব করার চেয়ে মৃত্যু ওর চেয়ে অনেক সহজ। সেটাই লিপিকে জানিয়ে দেয় তুষার। এটাও বলে দেয়, লিপির বাসর আর তার সমাধী একই দিনে হবে। কিন্তু লিপি ওর লক্ষে অবিচল–
.
রাতের নিস্তব্ধতাকে দোসর করে প্রতিটা রাত ঘন্টার পর ঘন্টা কেঁদেছে তুষার। বোঝাতে পারেনি নিজেকে। ১৫ই জানুয়ারি রাতে লিপিকে শেষ মেসেজটি করে তুষার। একটা বিখ্যাত গানের কয়েকটি লাইন–
“যদি ফিরে এসে দেখ,
এ ভুবনে আমি আর নেই।
স্মৃতির জানালা খুলে আকাশে তাকিয়ে বন্ধু।
ভোরের তারাটি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি এই আমি–
চিরকাল দাড়িয়ে থাকবো।
যদি আর দেখা না হয়-
যদি আর কথা হয়।
ওগো বন্ধু, মনে রেখ-
আজীবন তোমারই রইবো—”
মেসেজটি দিয়ে ১৬ তারিখ ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল তুষার যদি লিপির কোনো রেসপণ্স পায়। লিপি কোনো রিপ্লাই করেনি। বিকেলে তুষারের অর্ধমৃত বিভস্য রক্তাক্ত দেহটি রাজধানীর ফার্মগেইট এলাকার রাজা বাজার থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। সম্মিলিত। সামরিক হাসপাতালে কয়েক ঘন্টার কাটা ছেড়ার পর চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে একজন সৈনিক, তরুন কথা সাহিত্যিক, সাহসি ফুটবলার থেকে প্রেমিক হয়ে উঠা কে এম তুষার।
সুইসাইড নোটেও তুষার লিখেছিল – আমি চায় লিপির বাসর আর আমার সমাধী যেন একই দিনে হয়। তুষার জানতো সামরিক বাহিনীর নিয়ম মেনে লাশ বের হতে ১৭ তারিখ লেগে যাবে। হয়তো তাই ১৬ তারিখটাকেই বেছে নিয়েছিল এসিড খেয়ে ভেতরের সব কিছু ঝলসে ফেলার জন্য। যে ভালবাসা নিয়ে জীবনের সব উচ্ছাস ছড়িয়ে দিয়েছিল সেই ভালবাসাই ওকে টেনে নিয়ে গেছে জীবনের ওপারে। দুর মরু পথে—-
………….(সংক্ষেপিত)………….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত