এই মূহুর্তে শাফিন সাহেবের মাথায় চক্কর আসার উপক্রম। পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেছে তার। সচরাচর তিনি সহজ প্রকৃতির লোক তবে কি এখন তিনি প্রচন্ড রেগে যাচ্ছেন? চঞ্চল দুরন্ত বদ্ধ পরিকর আর উদ্যমী শাফিন সাহেব অনেকটা নীরব প্রকৃতির হয়ে গেছেন। বিয়ের ৮ বছর হয়ে গেছে কিন্ত এখনো বাবা হবার গৌরব অর্জন করতে না পারায় পদে পদে সমাজের নানান মানুষের নানান কথার আঘাতে শাফিন সাহেবের জীবণে নেমে আসছে এক বিষাদের ছায়া।
তিনি আজকাল তেমন একটা কথা বলেনা হাসাহাসি করেন না। অফিস শেষে বেলকুনির এক পাশে ইজি চেয়ারে বসে বসে কি যেন ভাবে। বড্ড চিন্তিত থাকেন আজকাল তিনি। ব্যপারটা তার স্ত্রী রিতিকা লক্ষ করলেও শাফিন সাহেবকে হাসানোর কোন উপায় তার জানা নেই। ‘ওগো তুমি এরকম মনমরা হয়ে থাকলে কি আমার ভালো লাগে বলোত। আমি কি আশা নিয়ে বাচব তুমি তো আমার সব দেখো আল্লাহ আমাদের মনের আশা পূরণ করবেন’।
স্ত্রীর মুখে শান্তনার বাণীতেও কোন ভাবান্তর হয়না শাফিন সাহেবের। কিন্ত আল্লাহ একদিন মুখ তুলে তাকায় শাফিন সাহেবের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। থমকে যাওয়া এই লোকটির মুখে এক চিলতে হাসি দেখেছিল রিতিকা বহুদিন পরে। সেই থেকে রিতিকার কত খেয়াল রাখা আলাদা যত্ন নেয়ার ত্রুটি করেন নি কখনো। ‘আচ্ছা আমাদের ছেলে সন্তান হবে নাকি মেয়ে?’ রিতিকার এমন প্রশ্নে শাফিন সাহেব চমকে যেতেন। তিনি ছেলে বা মেয়ে চান না তিনি চান তার একটা সন্তান হোক তাকে বাবা বলে ডাকুক ব্যাস এই টুকুতেই তার শান্তি।
দশ মাস পরে একটা কন্যা সন্তানের জন্ম হয় তাদের ঘরে। সে কি খুশি তারা এই সন্তান পেয়ে বলার মত না। ‘কন্যা সন্তান জন্ম নিলে কেউ এত খুশি হয় বুঝি?’ এলাকাবাসীর এমন কটু কথায় বিন্দু মাত্র পরিবর্তন নেই শাফিন সাহেবের। তিনি অতি উৎসবের মধ্য দিয়ে বরন করে নিয়েছেন তার ১ম সন্তান কে। আদর করে তার নাম দিয়েছেন ‘রাফিন’। সন্তান পেয়ে আবারো তার জীবণটা যেন রঙিন আলোয় মাখোমাখো হয়ে উঠেছে।
খুব ভালো ভাবে মনে আছে যেদিন রুপার জন্ম হয় কত খুশি হয়েছিলেন তিনি। পুরো মহল্লা জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন অনুষ্ঠানের একটা আমেজ পড়ে গেছিল পুরো মহল্লায়। তখন যদি জানতেন এই মেয়েই একদিন বড় হয়ে তাদের মায়া ত্যাগ করে যেদে দুবার ভাববে না তবে নিশ্চয় এত ঘটা করে উল্লাসে মেতে উঠত না কেউ মেয়ের জন্মে।
রাফিন’ বড় হচ্ছে সেই সাথে মেয়ের প্রতি শাফিন সাহেবের বাড়ছে মায়া ভালবাসা টান। অফিস শেষে এই মানুষটা পুরো সময় কাটায় মেয়ের সাথে। ছোট বাচ্চাদের মত খেলা করে মেয়েটাকে নিয়ে। মাঝেমধ্যে স্ত্রী রিতিকা রিতিমত বিরক্তিভরা তিক্ত কন্ঠে বাবা মেয়ের এই ন্যাকা ভালবাসার বিরুপ প্রতিবাদ জানিয়েছেন কিন্ত কোন লাভ হয়নি। শাফিন সাহেব তার স্ত্রীর এমন কথার কোন মূল্যই রাখেন নি। সন্তানের এমন কোন চাহিদা পূরণ করতে বাকি রাখেন নি তিনি। চাহিদার আগেই সব পেয়ে গেছে রাফিন’। অনেকটা আলালের ঘরের দুলালের মত। কিন্ত ঐ যে অতি আদরে ছেলেমেয়ে বাদর হয় সেটা শাফিন সাহেব ভুলেই গেছেন। তার মেয়ের ছোট খাট কোন দোষই তার চোখে পড়ত না। কখনো মেয়েকে শাষন তো দুরে থাক চোখ রাঙিয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি। এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে বেশ তর্ক হত তার কিন্ত সন্তান কে বড় আদরে বড় করছেন তিনি।
রাফিন’ কলেজে পড়ে। অনেক বড় হয়ে গেছে সে আর বাবার সাথে খেলেনা এখন। আর শাফিন সাহেবও অনেক বয়স্ক হয়েছেন এখন তার বিশ্রামের দরকার। তার ধারণা যে শিক্ষা আদর্শে তিনি তার মেয়েকে বড় করেছেন তার মেয়ে কোন ভুল কাজ করতেই পারেনা।
স্কুল পেরিয়ে কলেজে এসে ছোট্ট রাফিন আজ অনেকটা স্বাধীন। নিজের মত করে চলতে জানে সে। রবিন নামের একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায় রাফিন’। দিনের পর দিন বাড়তে থাকে তাদের ভালবাসা। রবিনের বাবা বিদেশে থাকেন আর একমাত্র ছেলে রবিন প্রথমবারের মত দেশে আসছে শুধুমাত্র দেশটা ভ্রমন করার জন্য। সে রাফিনকে বিদেশে নিয়ে যেতে চায়। এরকম একটা প্রস্তাবে বাবা রাজি হবেন না রাফিন সেটা ভালো করেই জানত।
কেন রাজি হবেন যেই সন্তানকে বুকে আগলে এতটা বছর বেচে রয়েছেন তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে না দেখে কিভাবে থাকবেন শাফিন সাহেব?
দুদিন রাফিন বাড়ি আসেনা। চিন্তায় চিন্তায় বিচলিত শাফিন সাহেব ও রিতিকা। এলাকায় আত্মীয়স্বজন পুলিশ ষ্টেশন সব যায়গাতে খোজ নেওয়া হয়েছে মেলেনি রাফিনের খোজ। ফোনটাও বন্ধ। কোথায় যেতে পারে কিছুই মাথায় আসছেনা শাফিন সাহেবের। রাফিনের সাথে খারাপ কিছু হয়েছে এমটা ভাবতেও পারছেনা শাফিন সাহেব। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।
হঠাৎ এয়ারপোর্ট থেকে রফিক সাহেবের ফোন আসে। রফিক সাহেব শাফিন সাহেবের বন্ধু। এয়ারপোর্টে রাফিনকে তিনি দেখেছেন। খবরটা পেয়েই গাড়ি নিয়ে শাফিন সাহেব ও রিতিকা বের হয়ে গেলেন। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া প্রাণহীন মানুষটার মুখে এক চিলতে হাসি দেখতে পেলেন রিতিকা। হয়ত মেয়ের খোজ মিলেছে তাতেই এই খুশি। মূহুর্তেই তারর সেই খুশির দুয়ারের দরজা বন্ধ করে দিল রাফিন। ‘রাফিন মা আমার কই ছিলি এই দুদিন তোকে কত খুজেছি বল তো। চল মা ঘরে চল’। কাদো কাদো কন্ঠে শাফিন সাহেব বললেন।
‘আমি রবিনকে ভালবাসি বাপি রবিনের সাথে থাকতে চায় আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। ওখানে পৌছে ফোন দেব তোমরা ভালো থেকো বাপি” বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন শাফিন সাহেব। এই কি সেই রাফিন যাকে কোলে পিঠে করে আদর ভালবাসায় বড় করেছিলেন তিনি? তার ভালবাসায় কি কোন কমতি ছিল? রফিক সাহেব সবটা শুনে রাফিনকে আটকাতে চেয়েছিল কড়া গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্ত তাকে থামিয়ে দিলেন শাফিন সাহেব।
‘এতটুকু-এতটুকু ছিলি তখন থেকে বুকে জড়িয়ে রেখেছি তোকে। কখনো তোকে নিচে শুতে দেয়নি মনে নেই তোর। তোর কিছু হলে পাগল হয়ে যেতাম আমি। তোর দিকে তাকিয়ে সব দুঃখ ভুলে যেতাম আমি তিলেতিলে বড় করলাম তোরে রে মা ২০ টা বছর ধরে আজ ২০ বছরের ভালবাসার দারুন প্রতিদান দিয়েছিস। আমাদের ২০ বছরের ভালবাসা আজ পরাজিত তোর পছন্দের কাছে। তোকে ছোট থেকে শুধু আদর আর ভালবাসা দিয়ে গেছি কখনো কষ্ট পেতে দেইনি। তোর সুখেই আমার সুখ। অন্য বাবাদের মত তোকে জোর করে বাড়ি নিয়ে কষ্ট দিতেতে চায়না আমি। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস সুখে থাকিস-সুখে থাকিস’ -ডান হাতে বুকটা চেপে বাম হাতে রিতিকার হাতটা ধরে টেনে গাড়িতে ওঠালেন শাফিন সাহেব। এতক্ষণ চোখের পানি ধরে রাখলেও গাড়িতে ওঠার পর অঝরে পানি ছেড়ে দিলেন তিনি। সাথে রিতিকাও কাদছে।
মাথাটা চেপে বসে পড়লেন শাফিন সাহেব। হয়তোবা রেগে গেছেন কেননা ২০ বছরের আদর ভালবাসা মায়া মমতাকে তাচ্ছিল্য করে তার মেয়ে রুপা আজ একটা ছেলের হাত ধরে চলে গেছে। এমন একটা খবর কোন বাবার জন্যই আনন্দমুখর নয় ঠিক শাফিন সাহেবেরও একই অবস্থা। তিনি আজকাল রুম থেকে বের হন না। কতদিন হয়ে গেছে রাফিনকে দেখন না কথাও হয়না। যে মেয়ের মুখ না দেখে অফিস যেতেন না ঘুমাতে যেতেন না আজ সে কতত দুরে। বাইরে এলাকার মানুষ কি বলে না বলে তা কানে আসেনা শাফিন সাহেবের। বদ্ধ একটা রুমে তিনি জীবন পার করে আসছেন রিতিকার সাথেও তেমন একটা কথা বলেননা। অফিস থেকেও অবসর নিয়ে নিয়ে সবকিছুর ইতি টেনে দিয়েছেন…
“জানি আমার গল্পে মুগ্ধ হবার কিছু নেই। এখানে অনেকেই জীবণে এরকম ভুল করে ফেলেছেন বা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। রাফিনের মত করবার আগে একটাবার পরিবারে অন্য মানুষদের কথা ভাববেন। ভাববেন কিভাবে কেটেছে আপনার ছোটবেলা। তারা কি ১৮-২০ বছরে আপনাকে কম ভালবেসেছে? আমি ভালবাসার বিরোধিতা করছিনা। ভালবাসার আরেক নাম ত্যাগ তবে সেই ত্যাগ হোক পরিবারের জন্য। কখনোই নিজের পছন্দ বা ভালবাসার জন্য পরিবারকে ত্যাগ করবেন না আশেপাশে পরিবারকে ত্যাগ করে সুখে আছে এমন নজির খুবই কম। যা করবেন ভেবে করবেন।”