উৎসর্গ

উৎসর্গ

আবির অফিস থেকে বাসায় ফিরে বিছানায় একটা প্যাকেট রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রান্না ঘরে ছিলাম হাত মাখানো ছিলো তাই দরজাটা খুলে দিয়েই আবার রান্না করে চলে গিয়েছিলাম। তাই তখন প্যাকেট টা চোখে পড়েনি। আবিরের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে আবার রান্না ঘরে যেতে নিতেই আবির বলে উঠলো,

– নিতু প্যাকেটে দুটো শাড়ি আছে, দেখো তোমার কোন টা ভালো লাগে!
– হঠাৎ শাড়ি!

আবির কিছু বলল না। আমিও ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে প্যাকেট টা খুললাম। খুব সুন্দর দুটো শাড়িই। কালার আলাদা হলেও ডিজাইন প্রায় এক। এই নীল শাড়ি টাতে নীলা কে খুব ভালো মানাবে। তবে দুটো শাড়ি তেই ওকে একদম পরীর মতো লাগবে। আমি বলি কি আমার তো নতুন শাড়ি আছে এখনো ভাজ খোলা হয়নি। এই দুটো শাড়িই নীলাকে দিও। আবির কিছু না বলে উঠে চলে গেলো। হয়ত আমার কথা টা ওর ভালো লাগেনি। বারান্দায় সিগারেটের ধোঁয়ায় মগ্ন আবির। হঠাৎ আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে হাত থেকে জলন্ত সিগারেট টা ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো।

– ঘুমাওনি যে?
– তুমিও তো এখনো জেগে। আমি তখন কথা টা ওইভাবে বলতে চাইনি। আবির কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরতেই আমিও আর কান্না চাপিয়ে রাখতে পারলাম না।

– আমি জানি নিতু, কোনো মেয়ের পক্ষে এসব মেনে নেয়া সম্ভব না, কিন্তু আমি যে নিরুপায়।
– এসব কি বলছ তুমি। আমি তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কিছু বলিনি। কালকে তো নীলার জন্মদিন আমারও তো ইচ্ছে হয় ওকে কিছু দিতে। আর তুমি এসব কি বলছ। আমি তো সেই প্রথম দিনেই সব টা মেনে নিয়েছি। এই কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাতে শীতের তীব্রতার মতো আমার বুকের ভিতর টা মোচড় দিচ্ছিলো। পরোক্ষণে আবিরের আলতো চুম্বনে সমস্ত অভিমান জড়তা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। এই আবির টা এমনই নিমেষেই কেমন মন খারাপ দূর করে দেয়।

সকাল বেলা বিছানায় আকাশী রঙের শার্ট টা দেখে আবির কিছু টা অবাক হয়ে গেলো। এতদিনে যে আমি ও আবিরের মন পড়তে শিখে গিয়েছি সাথে ওর ভালোবাসার মানুষ গুলোর পছন্দ অপছন্দ গুলোও। সব কিছু কিভাবে যেন মানিয়ে নিতে শিখেছি। আবির নাস্তা করে বের হওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলে উঠলাম, আমি রাতে একা থাকতে পারবো। টেনশন নিও না তুমি।

আবির আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বের হয়ে গেলো। আমার বুকের ভিতর টা কেমন হুহু করে উঠলো। খুব বেশি শূন্যতা অনুভব করছি। ইচ্ছে করছে আবিরকে আটকে রাখি নিজের মধ্যে। কিন্তু সে অধিকার যে আমি নিজেই ভাগ করে নিয়েছি। বাসার সব কাজ শেষ করে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলাম। আচ্ছা আমার মতো কি নীলাও আবিরকে এত টা ভালোবাসে! নীলা আবিরের প্রেমিকা। প্রেমিকা বললে ভুল হবে ওর দ্বিতীয় স্ত্রী। আর আমি! আমি আবিরের প্রথম স্ত্রী। তবে প্রথম ভালোবাসা নই। সেই সৌভাগ্যবতী নীলা ছিল।

পারিবারিক সম্মন্ধে আমাদের বিয়ে টা হয়েছে। অবশ্য বিয়ের আগে আমি আবিরকে চিনতাম। আমার খালার ননদের ছেলে আবির। সেই খাতিরে দু একবার কথা হয়েছিল শুধু এর বাহিরে কিছু নয়। বিয়ের প্রথম রাতেই আবির আমায় নীলার কথা জানায়। কি ভাগ্য আমার! নিজের স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকার গল্পে কেটে যায় আমাদের রাত। সেদিন বুঝেছিলাম আবির নীলাকে কত টা ভালোবাসে। কিন্তু একটা মেয়ের পক্ষে কি কখনো তার স্বামী কে ভাগ করে নেয়া সম্ভব?

আবিরের কথা শুনে সেদিন এটাও বুঝেছিলাম নীলার প্রতি শুধু ওর ভালোবাসা নয় অনেক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। কিন্তু পারিবারিক চাপে নীলাকে সে বিয়ে করতে পারেনি। অবশ্য তার পিছনে আর একটা কারণ ও রয়েছে। আবির বিয়ের পর থেকে আজ অব্দি আমার প্রতি কোনো অবিচার করেনি সে পারতো নীলার বিষয় টা আমার কাছে লুকাতে, কিন্তু সে সেটা করেনি। যথেষ্ট ভালোবাসে আমায় আবির কিন্তু আমি প্রথমে মেনে নিতে পারিনি এই ভালোবাসার মাঝে অন্য কারো ভাগ ও রয়েছে। কিন্তু যেদিন জানতে পারি নীলা কোনোদিন মা হতে পারবেনা বলে সে আবিরকে বিয়ে করেনি। সেদিন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। নীলা এতিম। ওর পরিবারে ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের পড়াশুনা ও সংসার চালাতো। আর যতটা পারতো আবির সাহায্য করতো।

আমি বিয়ের পরেও দেখতাম আবির বাজার করলে ২ ব্যাগ বাজার করতো। যা কিনতো সব দুটো করে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আবির কখনো এ দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারবেনা। তাই একদিন নিজেই গেলাম নীলার কাছে। তবে সেটা আবিরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য না। নীলাকে রাজি করাতে যেন সে আবিরকে বিয়ে করে। নীলা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অনেক বুঝিয়ে নীলাকে রাজি করাতে পারলেও আমি আবিরকে রাজি করাতে পারছিলাম না।

-আবির আমি জানি তুমি কখনো আমার প্রতি অন্যায় করবেনা। আর নীলার প্রতিও না। তবে এভাবে আর কতদিন? নীলাকে আমি বোনের মতোই দেখবো।

আবিরের চোখে সেদিন পানি চলে এসেছিল। ওদের বিয়ে টা আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছি। অবশ্য এ বিষয়ে বাবা মা কেউ জানে না। আবির নীলার কাছে গেলে নীলা নিজেই ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। সপ্তাহে ১-২ দিন ও নীলার কাছে থাকে। আমিও আমার মতো করে সব টা মেনে নিয়েছি। শত কষ্ট হলেও মাঝে মাঝে এটা ভেবে তৃপ্তি পাই যে, ছিনিয়ে নিয়ে নয়, উৎসর্গের মধ্যেও আনন্দ রয়েছে। তবে আবির কে আমি আমার মতো করেই ভালোবেসে যাবো। আমি আর আবির তো ঠিকই করে রেখেছি আমাদের প্রথম সন্তানের মা হবে নীলা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত