গভীর রাত, নিস্তব্ধ চারিপাশ, গ্রাম্য অঞ্চল। বাড়ি থেকে একটু দূরে পথের মধ্যে থাকা কালভার্টের উপরে দাঁড়িয়ে আছি। এশার আজান দিয়েছে প্রায় ঘণ্টা তিনেক হবে। এই নিশীথ রাতে নিভৃতে এমন বিজন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। দাঁড়িয়ে আছি শুধু ছোট্টবেলার পুরোনো সব স্মৃতিগুলো উপলব্ধি করার জন্য। একটা সময় এখানে বন্ধুরা মিলে কত আড্ডা দিয়েছি। মায়ের মুখে ভীষণ বকাও শুনেছি সেজন্য। এই কালভার্টের উপর দাঁড়িয়েই আমি আর বাধন দু’জন দু’দিকে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছি। কখনও দু’জন এক দিকে দাঁড়িয়ে পাল্লা দিয়েছি কারটা কতদূর যায়। কখনও আবার ভূত সেজে বাইসাইকেল আরোহী ব্যক্তিদের ভয় দেখিয়েছি। বিনিময়ে কিছু বকাও শুনেছি।
কালভার্টের পাশের জমিতে বড় নানা মাটি ফেলেছেন। শুনেছিলাম তিনি নাকি সেখানে একটা বাড়ি তৈরি করবেন। অবশ্য পাড়াতে উনার একটা খানদানি ফ্ল্যাট বাড়ি রয়েছে। তবুও তিনি এই জায়গাটাতে কী কারণে যেন আরেকটা বাড়ি বানাতে চান।
বিকেল হলে আমরা বন্ধুরা মিলে সেখানে কত আড্ডা দিয়েছি। চারিদিকে সন্ধ্যে ঘনিয়ে না এলে আড্ডা থেকে উঠার কথা কল্পনাতেও আনিনি। আজ বছর দশেক পরেও এই জায়গাটা ঠিক আগের মতোই পরে আছে। নানার প্রতি এখন আর তার ছেলেরা পূর্বের মতো খেয়াল রাখেন না। শুনেছি পাটের ব্যবসায়তে সেইবার চরম আকারে ক্ষতি হওয়ায় নতুন বাড়িটাও আর করা হয়নি। যার জন্য পূর্বের এই আবাদি জমিটা এখন পতিত হয়ে পরে আছে। অথচ এই জমিটাতেই একটা সময় প্রচুর ফসল ফলতো।
মাঠটার পাশেই আমার মেজো মামার বাড়ি। ইনি আমার আপন মামা। মানে আমার নিজের নানার ছেলে। উনার বাড়ির সামনে মাঝারি মাপের একটা “খোলা” রয়েছে। আমরা বন্ধুরা মিলে নিয়ম করে রোজ সেখানে ক্রিকেট খেলতাম। খেলার সময় কখনও কখনও বল ছুটে গিয়ে বড় নানার ধানের ক্ষেতে পরলে তিনি প্রচুর রাগ করতেন। কখনও লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতেন। আর বলতেন, ওরে গোলামের দল। তোদের জন্যিই আমার এই ক্ষ্যাতটাতে ধান হয় না।
আজ সেই দিনগুলো বড্ড মনে পরছে। বড় নানা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে আছেন। মামারা সব যার যার মতো নিজের সংসার গুছিয়ে নিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন পার করছেন। অথচ নানা ঠিকমতো খেতে পেল কিনা, সেদিকে উনাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। হঠাৎ করেই চোখের কোণে দু’ফোটা জলের অস্তিত্ব টের পেলাম।
– কিরে? এখানে কী করিস?
সহসা এমন প্রশ্ন শুনে সচকিত হয়ে পেছনে তাকালাম। দেখলাম, বাধন দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে একটু দূরে সাগর দাঁড়িয়ে। আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দু’টো মুছে বাধনকে জড়িয়ে ধরলাম। সে বললো, কিরে কী হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো তুই? আমি তার প্রশ্নের উত্তরে কিছু বললাম না। আকাশের চাঁদটা যেন পূর্বের থেকে অধিক আলো ছড়াচ্ছে। বাধনকে ছেড়ে দিতেই সে বললো, কিরে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে ভাই তোর? আমি চোখটা মুৃছে সিক্ত কণ্ঠে বললাম, হারিয়ে ফেলেছি তাকে।
– কাকে?
– ছোটবেলাকে।
আমার কথা শুনে বাধন হাসতে লাগলো। কিয়ৎকাল বাদে সে হাসি থামিয়ে বললো, আরে এ নিয়ে কান্না করার কী আছে? চল বাড়ি চল, অনেক রাত হয়েছে। তোর মা তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। চল এখন।
ভোরবেলা ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙলো। ঘুম ঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি, সৌরভ কল করেছে। ছেলেটা বড্ড সহজ সরল এবং মিশুক প্রকৃতির। ভার্সিটিতে আমার যে সাতজন বন্ধু রয়েছে, তার মধ্যে সে একজন। আমি মুখে কিছু না বললেও সে কিভাবে যেন আমার মনের কথাগুলো বুঝে ফেলে। এইতো বেশ কিছুদিন আগে শ্রাবণীর সাথে থাকা সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে আমি খানিকটা ভেঙে পরেছিলাম। কয়েকটা দিন ক্লাসে ঠিকমতো মনযোগী হতে পারিনি। এজন্য অবশ্য স্যারদের কাছে বকাও শুনেছি। সেদিন ক্লাস শেষে ছেলেটা আমাকে টানতে টানতে ক্যাফে নিয়ে গেল। তারপর কিছু সিঙ্গারা আর কোকাকোলা এনে বললো, কী হয়েছে তোর? মন খারাপ?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে বললো, শ্রাবণীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লে সে বললো, আরে এ নিয়ে মন খারাপ করার কী আছে? আজ সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, তো কাল ঠিক হয়ে যাবে।
কল রিসিভ করতে গিয়ে দেখি কল কেটে গিয়েছে। আমি কল ব্যাক করতে যাবো, ঠিক সেই মুহূর্তে আবার ফোনটা বেজে উঠলো। আমি কলটা সিরিভ করে কানে ধরতেই সে বললো, দোস্ত ভুলে গেছিস আমাকে! তিন দিন হয়ে গেল, অথচ কোনো খোঁজ নিলি না আমার। বাড়ি গিয়ে যে একেবারে ভুলেই গেলি। আমি বললাম, শ্রাবণ সবকিছু ভুলে যাবে। তবু সে তোদের ভুলবে না। সৌরভ হেসে বললো, তারপর বল কেমন আছিস? আর ঢাকাতে ব্যাক করবি কবে? আমি বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো আছি। আর আগামী পরশু ব্যাক করতে পারি। তুই কেমন আছিস?
– আমি আর কেমন থাকবো। যেমন দেখে গেছিস, তেমনই আছি। ভাঙা হাত, অসুস্থ মন, এইতো আগের মতোই।
– সকাল সকাল মনটা খারাপ করে দিলি।
– কেন?
– এইযে, ভাঙা হাত, অসুস্থ মন!
সে কিঞ্চিৎ হেসে বললো, আরে বেটা মজা করলাম। সৌরভের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা টেবিলের উপর রাখতে যাবো। ঠিক সেই সময় দেখলাম আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আম্মুকে কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই আম্মু আমাকে বলে উঠলো, কাইলকির পরের দিনই চইলি যাবু বাজান? আমি আম্মুর দিকে ভালো করে তাকাতেই আমার মনটা কেঁদে উঠলো। আর্দ্র নয়ন, নিষ্পাপ চাহনি, অপলক চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি কী বলবো, ভেবে পাচ্ছি না। আম্মু আবারও বলে উঠলো, আর কয়ডা দিন থাইকি গিলি হয় না বাজান? তোর না ভাজা পিঠি খুব পছন্দের। আইজকে ঢেঁকিতে চাইল গুড়া করবো। প্রতিদিন তোক ভাজা পিঠি বানায়ে দেবো। যদ্দিন না আটা শেষ হয়, তদ্দিন না হয় থাইকি যাস বাজান! আমার চোখ দু’টো জলে ভরে উঠলো। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আম্মুকে। আম্মু অঝোর ধারায় কেঁদেই চলেছে। পাশে তাকিয়ে দেখিয়ে আব্বাও কাঁদছেন।
সকালে না খেয়ে বের হয়েছি। আম বাগানে বসে আমি, বাধন, সাগর আর শাকিল, চারজন মিলে কার্ড খেলে দুপুরে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎই চোখ গেল একজন বৃদ্ধার দিকে। দেখলাম, উনি হাত ইশারা করে আমাকে ডাকছেন। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। উনার কাছে যেতেই উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, আমায় ভুইলা গেছিস নাকি ভাই? সত্য বলতে কী, আমি সত্যই উনাকে চিনতে পারিনি। পাশে থেকে বাঁধন বলে উঠলো, এটা আমাদের বুড়ি মা। ঐ যে, চুরি করে বড়ই খাওয়ার জন্য কত মাইর খেয়েছি উনার হাতে। সাথে আরো কত দৌঁড়ানি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, নানি তুমি! কেমন আছো তুমি? আর তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। শরীরের এ কী হাল!
উনি একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, তোর জন্যি কিচু বড়ইয়ের আঁচার রাইখি দিছিল্যাম। ওদের সবাকই দিয়ে দিচি। খালি তোকই দিয়া হয়নি। তুই কবে বাড়ি আসপু, সেই দিন তোক দেবো। বলেই তিনি লাঠি ভর দিয়ে বাড়ি মধ্যে ঢুকে গেলেন। খানিক বাদে একটা বয়েম হাতে করে ফিরে এলেন। বললেন, এই নে তোর আঁচার।
আমি বয়েমটা হাতে করলে উনি বড়ই গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই গাছটাই এহুন এক গাদা বড়ই হয়। তয় এহুন আর কেউ বড়ই চুরি করতি আসে না ভাই। এইবার বড়ই হলি তুই, বাধন, সাগর আর শাকিল সবাই মিলি চুরি করতি আসিস ভাই। আমি আবার তোদের লাঠি লিয়ে তাড়া করতি চাই। আমি লক্ষ করলাম, উনি উনার পরনে থাকা মলিন কাপড়খানা দিয়ে চোখ মুছলেন। আমি বললাম, হ্যাঁ নানি নিশ্চয়ই আসবো। কতদিন তোমার হাতের তাড়া খাই না। বেশ কিছুটা সময় উনার সাথে কাটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
বাড়ি ফিরতেই ভাজা পিঠার গন্ধে মন ভরে গেল। আম্মু তখনও চুলোর পিঠে বসে পিঠা বানাচ্ছে। আমি রান্নাঘরে উঁকি দিতেই আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো, হেনে বয়। এই লে ধর, গরম গরম পিঠি খা।
আমি আম্মুকে বললাম, কতবেলা হয়ে গেল। আর আমি সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছি। তুমি মারবে না আমাকে?
আম্মু পূর্বের হাসিটাই মুখে ধরে রেখে বললো, “ও রাব্বির বাপ, কাঁচা কঞ্চিটা কই রাখছেন। দেহেন আপনের ছেলে কাঁচা কঞ্চির বারি খাতি চায়।” আম্মুর কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। বললাম, আম্মু আমি আবার আমার শৈশবে ফিরে যেতে চাই। ধুলোবালি নিয়ে খেলাধুলা, তোমার অবাধ্য হওয়া, সময়মতো না খাওয়া, পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরা, এই সবকিছু আবার করতে চাই।
আম্মু বললো, এহুন বড় হইয়ে গিছিস। এহুন এইসব চিন্তা ছাইড়ি দিয়ে সামনের চিন্তা কর। আর আমাদেরও তো বয়স কম হইলি না। আইজ আছি তো কাইল নাই। ঘরটা ক্যামন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমি একটা পিঠা মুখে নিয়ে আব্বার দিকে তাকালাম। দেখলাম, উনি মুখ টিপে হাসছেন। আমি বললাম, মেয়ে কি আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছেন? নাকি আমাকে পছন্দ করতে হবে?
আমার এমন কথা শুনে তারা দু’জন একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন এক অদৃশ্য বাক্যলাপ করে নিলেন। তারপর আম্মু বললেন, না মানে তোর ছোট খালার মাইয়াটারে তোর ক্যামন লাগে? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মু আমার তাকানো দেখে বললেন, ক্যামন লাগে এইটা জানতে চাইছি। বিয়ে তো করতে কইছি না। ছোট খালার মেয়েকে আমার আগে থেকেই পছন্দ। ভীষণ লাজুক মেয়ে। খালার বাড়িতে বেড়াতে গেলে সে কখনো আমার সামনে আসতো না। আমি যতক্ষণ তাদের ওখানে থাকতাম, সে ততক্ষণ তার চাচীদের ঘরে গিয়ে বসে থাকতো। মাঝে মাঝে বার্তাবাহককে পাঠাতো, আমার খোঁজ নিতে, আমি চলে গিয়েছি কিনা।
আমি আম্মুর প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর দিলাম না। তাকে আমার ভালো লাগে, পছন্দ করি, সব ঠিক আছে। কিন্তু ভালো তো বাসি না। কেননা আমি শুধু একজনকেই ভালোবাসি। আর সে হলো শ্রাবণী। রাতে খাওয়ার সময় আব্বা বললেন, কাল সকালে তোর ছোট খালা তোকে দেখতে আসবে। সকাল সকাল কোথাও বের হইস না। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই আম্মু বলে উঠলো, তৃপ্তি মাইয়াটা সেইরহম লক্ষ্মী। আর আমার বুনেরও মাইয়া বটে। যেমন আমার বুন, তেমন তার মাইয়া। তাকে আমাদের ঘরের বউ কইরি আনলি, সে আমাদের সবরহম খেয়াল টেয়াল করবি।
আম্মুর এমন আহ্লাদি কথা শুনে আমি বললাম, আম্মু এসব কথা এখন বাদ দাও তো। আমার বিয়ের বয়স এখনো হয়নি। আগে মাস্টার্স শেষ করি। তারপর বিয়ের কথা ভাববো। আমার আব্বা খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি যেকোনো কথা অতি সহজেই বুঝে যান। স্বশিক্ষিত ব্যক্তিরা সর্বদাই বিচক্ষণ হয়। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার আব্বা। উনাকে কখনও শুদ্ধ ভাষা ছাড়া গ্রামের ভাষায় কথা বলতে দেখিনি। গ্রামে কোনো শালিস কিংবা ঝামেলা হলে সকলে আমার আব্বাকে ডেকে নিয়ে যান। গ্রামে আব্বার বেশ নাম ডাকও রয়েছে।
আমার মুখে অমন কথা শুনে তিনি বলে উঠলেন, তুই কি কোনো মেয়েকে পছন্দ করিস? না মানে আমি বলতে চাচ্ছি, তোর কি কোনো পছন্দের মেয়ে টেয়ে আছে নাকি? আম্মুর সাথে আমি অনেকটা ফ্রি হলেও আব্বার সাথে কখনো ফ্রি হয়ে উঠতে পারিনি। আব্বার প্রশ্ন শুনে লজ্জা এবং ভয় দু’টোই পাচ্ছি। একবার ভাবছি বলে দেবো নাকি শ্রাবণীর কথা। আবার ভাবছি, নাহ! বললে হয়তো কেলেংকারি হয়ে যাবে।
– কিরে কোনো কথা বলিস না কেন? তোর কি কোনো পছন্দের মেয়ে আছে? আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে সচকিত হয়ে বললাম, “না, না মানে”
– ও বুঝতে পেরেছি। নাম কি তার? আমি মাথাটা নিচু করে বললাম, শ্রাবণী। উনি বললেন, কতদিনের সম্পর্ক তোদের?এবার আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে বললাম, এইতো এই ডিসেম্বরে আড়াই বছর পূর্ণ হবে।
– মেয়েটার পরিবারে কে কে আছে?
এমন হাজারও প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়া শেষে আব্বা শ্রাবণীর ছবি দেখতে চাইলে তাকে তার ছবি দেখালাম। তিনি দেখে বললেন, মাশআল্লাহ! মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। তা একদিন নিয়ে আয় তাকে। আমি বললাম, আগামীবার আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবো। তিনি বললেন, তাহলে কাল সকালে তোর ছোট খালা এলে তাকে কী বলবো? আমি বললাম, তা আমি জানি না। আপনার যা ভালো মনে হয়, সেটাই বলবেন।
গতরাতের মতো আজও আকাশে একখানা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের থেকে ঠিক কিছুটা দুরে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে। আকাশের হাজারো নক্ষত্রদের তুলনায় তার আলোটা কয়েকগুণ বেশি। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বড় উঠানটার এককোণে দাঁড়িয়ে শ্রাবণীকে কল করলাম। একবার রিং হতেই রিসিভ হলো। হয়তো ফোনের কাছেই ছিল সে। আমি “হ্যালো” বলতে যাবো। ঠিক তখনই সে বলে উঠলো, তুই অনেকদিন বাঁচবি। আমি তোকেই কল করতে যাচ্ছিলাম। আমি একটু হেসে বললাম, তা কী কারণে আমাকে কল করতে যাচ্ছিলি?
– বা’রে… বন্ধুর কাছে মানুষ কি কোনো কারণ নিয়ে কল করে?
– না, তা করে না।
– তাহলে?
– শ্রাবণী একটা কথা ছিল।
– বল।
– শোন, এতদিন ফাইজলামি করলেও আজ কিন্তু আমি সিরিয়াস।
– বল দেখি, কী তোর সেই সিরিয়াস কথা?
– আব্বা বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছিলেন। যখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা। তখন আমি তোর কথা বলে দিয়েছি।
– কি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? আমরা শুধু ভালো বন্ধু। এর থেকে বেশি কিছু না। আর তোকে কতবার বলবো, আমি তোকে ভালোবাসতে পারবো না। আমরা বন্ধু আছি বন্ধুই থাকি। এর থেকে বেশি কিছুতে না যাই।
– শ্রাবণী, দেখ আমি তোকে সত্যই ভালোবাসি। আমি জানি তুইও আমাকে ভালোবাসিস। শুধু শুধু এমন করছিস কেন?
– দেখ শ্রাবণ, আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি, আমি তোকে ভালোবাসি না। আর তুই এসব ভালোবাসা-বাসির কথা আমাকে বলবি না।
– কিন্তু….
– তোর তো একটা কমন সেন্স থাকা উচিত। আমার থেকে না শুনে তুই কিভাবে তোর বাবাকে আমার কথা বলতে পারিস। দেখ শ্রাবণ, আমি চাই না তোর আর আমার মধ্যে থাকা বন্ধুত্বের এই সম্পর্কটা নষ্ট হোক।
– শ্রাবণী…
– শোন, আমাকে আগে শেষ করতে দে। তারপর কথা বল।
তোর সাথে তো সেদিনই আমি সম্পর্কের ইতি টেনে দিয়েছিলাম। শুধু তোর বন্ধু সৌরভের কথাতে তোকে মাফ করে দিয়েছিলাম। তোকে কখনো বলেছি আমি যে, তোকে আমি ভালোবাসি? না বলিনি, তো তুই কিভাবে আমার কথা তোর বাবাকে বলিস? আমি বলি কী, তুই ডাক্তার দেখা। তুই দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিস। আর হ্যাঁ, তোর বাড়ির কাছেই না পাগলা গারদ? আসার সময় চেকাপ করিয়ে আসিস। যত্তসব পাগল ছাগল কোথাকার!
শ্রাবণী কল রেখে দিল। আসলেও আব্বাকে তার ব্যাপারে বলার আগে আমার একবার ভাবা উচিত ছিল, সে আমাকে ভালোবাসে কিনা। এই দুইটা বছরে কি তার মনে আমার জন্য একটুও ভালোবাসা তৈরি হয়নি? হ্যাঁ, আমি পাগল। শুধু তোর জন্যেই পাগল শ্রাবণী। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাধনদের বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে কল করলাম। খানিকবাদে সে মোবাইল হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এলো। আমি তাকে বললাম, চল একটু ঐদিকটাতে গিয়ে বসি।
– রাত তো অনেক হলো। আমার বাড়ি থেকে বকাবকি করবে। বলবে এতো রাতে বাইরে কী করছিলাম আমি।
– তুই বলবি, তুই আমার সাথে ছিলি। তখন আর কিছু বলবে না।
– সাগরকে কল করবো?
– না থাক, তুই থাকলেই হবে।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে আবারও সেই কালভার্টটার কাছে গেলাম। মোবাইলে সময়টা দেখে নিলাম, ৯টা বেজে ৫৪ মিনিট। মানে দশটা আরকি! গ্রামে দশটা বাজা মানেই অনেক রাত হয়ে যাওয়া। অথচ ঢাকা শহরে রাত বারোটা বেজে গেলেও আমাদের রাত হয় না। ঘণ্টা খানেক বাধনের সাথে কাটিয়ে রাত ১১ টার দিকে বাড়িতে ফিরলাম। ঘরের দরজায় কড়া নাড়তেই আম্মু দরজা খুলে দিলো। আম্মু কোনো প্রশ্ন করার আগেই আমি বললাম, বাধন আর আমি মামাদের কালভার্টের ওখানে বসে ছিলাম। আম্মু আর কোনো প্রশ্ন করলো না। শুধু বললো, পথঘাট ভালো না। দিন আর আগের ল্যাহান নাই। বেশি রাইত অব্দি বাইরে থাহিস না বাজান। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন সকালবেলা প্রাতরাশ সেরে আমি আর বাধন শপিংয়ের উদ্দেশ্যে শহরের দিকে রওনা দিলাম। অবশ্য আমার জন্য কিছু কিনবো না। যা কিনবো, তার সবগুলোই প্রিয় মানুষদের জন্য। বিকেলে পুকুর পাড়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিলাম। হঠাৎই আব্বা ডাক দিয়ে বললেন, তোর ছোট খালা এসেছে। শুনে যা। আমি পুকুর পাড় থেকে উঠে এলাম। বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই চোখ গেল তৃপ্তির দিকে। আহ! কী অপরূপ চাহনি গো। একবার চোখে চোখ পরলে চোখ ফেরানো দায়। সেই বছর তিনেক আগে একবার দেখেছিলাম। তখন আর এখনকার পার্থক্যটা চোখে পরার মতো। তবে লাজুক ভাবটা এখনও যায়নি তার। আমার চোখে চোখ পরতেই সে তার মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
খালাকে সালাম দিয়ে বললাম, কেমন আছেন? উনি উত্তর করলেন। ঘরের মধ্যে তখন আমি, আব্বা, আম্মু, খালা আর তৃপ্তি অবস্থান করছি। কথা বলার মাঝখানে খালা হঠাৎ করেই আমার আব্বাকে তৃপ্তি আর আমার বিয়ের কথা বলে উঠলেন। খালার এমন কথা শুনে আব্বা একবার আমার দিকে তাকালেন, আরেকবার খালার দিকে। আমি আব্বার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমি আমার চোখের ভাষায় আব্বাকে বুঝাতে চাইছি, খালার না সকালবেলা আসার কথা ছিল? তবে এখন কেন এলেন? আর আপনি এখন খালাকে যেমন তেমন করে মানিয়ে নেন।
আব্বা আমতা আমতা করতে করতে খালার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে দিলেন। খালা খুশি হয়ে বললেন, তাহলে রাব্বির চাকরিটা হয়ে গেলেই বিয়ের ব্যবস্থা করবো। কি বলেন দুলাভাই? আব্বাও হ্যাঁ বলে দিলেন। আমি তৃপ্তির দিকে তাকালাম। দেখলাম সে মুচকি হাসছে। খালা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তোর কোনো আপত্তি নেই তো? খালার এমন প্রশ্নে আমি কী উত্তর করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। মুখ দিয়ে আপনাআপনিই “না কোনো আপত্তি নেই” কথাটা বের হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর খালা আমাদের বাড়ি থেকে প্রস্থান করলে আমি আব্বাকে বললাম, এটা কী হলো? তিনি যেন বুঝেও না বুঝার ভান ধরে বললেন, কোথায় কী হলো?
– আপনি খালার প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দিলেন কেন?
– আমি না হয় ভুল করে হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু তুই বললি কেন?
– খালার মুখের উপর আমি কিভাবে উনার প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করে দেই। সেজন্যই আমি ‘হ্যাঁ’ বলেছি।
আব্বা তখন একগাল হেসে বললেন, ঠিক একই কারণে আমিও ‘হ্যাঁ’ বলেছি। ঢাকাতে ব্যাক করার আগে প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কেনা কাপড়গুলো নিজ হাতে বিলি করলাম। বড়ইয়ের আঁচার দেওয়া নানিকে বেশ কয়েকটা শাড়ি আর বাদ বাকি যা কিছু প্রয়োজন, তার সবটা দিলাম। শপিংটা স্পেশালি নানির জন্যই ছিল।
ঢাকাতে ফিরে সৌরভকে কল করলাম। সে জানালো আগামীকাল দেখা হচ্ছে ভার্সিটিতে। পরদিন সকাল সকাল ভার্সিটিতে গেলাম। সৌরভ উত্তরা ৮ নং সেক্টরে থাকে। ভার্সিটিতে আসতে তার বেশি খানিকটা সময় লেগে যাবে। আমি বাসে থাকাকালীন সময় তাকে কল করেছিলাম। সে বলেছিল, সেও বাসের মধ্যে আছে। ভার্সিটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে ন’টা বেজে যাবে। এর মাঝে আর শ্রাবণীর সাথে কথা হয়নি। এদিকে আমিও কল করিনি। ওদিকে সেও আর কল করেনি।
আমি হাঁটতে হাঁটতে ক্যাফের দিকে গেলাম। ভাবলাম, একটা কফি খেতে খেতে শ্রাবণীকে কল করবো। কিন্তু ক্যাফে ঢুকতেই দেখলাম, শ্রাবণী একটা ছেলের সাথে হাত ধরে বসে আছে। একটু এগিয়ে যেতেই ছেলেটিকে চিনতে পারলাম। রায়হান, আমরা একই সাথে পড়ি। ছেলেটা একসময় আমার বন্ধু ছিল। কিন্তু তার অনেকগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক। যদি সেটা এমনি সম্পর্ক হতো, তবে মেনে নিতাম। কিন্ত না! সে টিস্যুর মতো মেয়েদের ব্যবহার করে। আজ এই মেয়ে তো, কাল অন্য মেয়ে। বিছানা পর্যন্ত চলে গেলেই তার কাছে মেয়েটির প্রতি চাহিদা কমে যায়। আর এই কারণেই তার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কের ইতি টানি। আমি তাদের কাছে যেতেই রায়হান বললো, কিরে? কেমন আছিস? আমি বললাম, শ্রাবণীর সাথে কী তোর?
– সে আমার গার্লফ্রেন্ড। বস, আড্ডা দেই। কফি অর্ডার করবো?
– না থাক, তার দরকার নেই। শ্রাবণী, ওর সাথে কিসের সম্পর্ক তোর? শ্রাবণী উত্তর করলো, ও আমার বয়ফ্রেন্ড।
– বয়ফ্রেন্ড?
– হ্যাঁ।
– তুই ওকে ভালোভাবে চিনিস?
– আমার অতো চিনতে হবে না। ও আর যাই হোক, তোর মতো সিক মেন্টালিটির না।
আমি শ্রাবণীর হাত ধরতেই রায়হান আমার কলার চেপে ধরলো। আমি বললাম, রায়হান আমার কলার ছাড়। তুই নিশ্চয়ই জানিস, আমি শ্রাবণীকে ভালবাসি। ঠিক তখনই কোথ থেকে যেন সৌরভ এসে রায়হানকে ধাক্কা মারলো। রায়হান তার জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে ছিটকে পরলো। আমি সৌরভকে বললাম, তোর হাত ভালো হলো কবে?
– অনেক আগেই হয়েছে। তবু ডাক্তার বলেছিল, একটু সাবধানে থাকতে।
আমি শ্রাবণীকে বললাম, এদিকে আয়। কিছু কথা আছে তোর সাথে। সে আমার হাত থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে চড় মারলো। আর বললো, তোর সাহস হয় কী করে আমার হাত ধরার? আমাকে চড় মারতে দেখে সৌরভও শ্রাবণীর গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিল। ছেলেটার অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যায়। তাছাড়া, আমাকে যদি কেউ কিছু বলে। তাহলে তো আর কোনো কথায় নেই। দুপুরে শ্রাবণীকে একাকী ডেকে বললাম, রায়হান ভাল ছেলে না। অনেক মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক। দৈহিক চাহিদা মিটে গেলেই দেখবি সে তোকে ছেড়ে অন্য কাউকে ধরেছে। এই কথা শুনে সে আবারো আমাকে চড় মারলো। সে বললো, রায়হানকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবি না। আর আজকের পর থেকে আমার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করার ট্রাই করবি না। তোর সাথে এখানেই সম্পর্ক শেষ।
বিকেলে ক্যাম্পাসের এক কোণে বসে আমি আর সৌরভ আড্ডা দিচ্ছিলাম। ঠিক তখন দেখলাম, শ্রাবণী, রায়হান আর বেশ কয়েকটা ছেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেগুলোর হাতে হকিস্টিক। আমার কাছাকাছি আসতেই রায়হান একটা ছেলের থেকে হকিস্টিক নিয়ে আমার মাথায় আঘাত করলো। সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম সৌরভ আমার মাথার কাছে বসে আছে। আমি চোখ খুলতেই সে বললো, কেমন আছিস এখন? আমি উঠতে চেষ্টা করলে সে বললো, শুয়ে থাক। আরেকটু সুস্থ হলে তখন উঠবি। আমি শুয়ে রইলাম। সে তার মোবাইল বের করে আমাকে কিছু ছবি দেখিয়ে বললো, ওরা পাশের রুমে আছে। সবগুলোকে পিটিয়ে হাত পা ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
আমার পুরোপুরি সুস্থ হতে বেশ কয়েকটা মাস লেগে গেল। এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। তবে যেখানে আঘাত করেছিল, সেখানকার চুলগুলো কেটে ছোট করে দিয়েছেন ডাক্তার। তিনি জানিয়েছেন, মাস ছয়েকের মধ্যে সব আগের মতো হয়ে যাবে। এর মাঝে দুইটা বছর চলে গিয়েছে। সবকিছু আবার আগের মতোই চলছে। ভার্সিটিতে রায়হানের সাথে দেখা হলে সেও আর কিছু বলে না। তবে মাঝে মাঝেই শ্রাবণীকে তার সাথে দেখা যায়। হয়তো এখন পর্যন্ত সে শ্রাবণীকে বিছানা অব্দি নিতে পারেনি। তবে আশাকরি বেশি সময়ও লাগবে না। শ্রাবণীকে রায়হানের সাথে ঘুরতে দেখে আমার কিছুটা খারাপ লাগলেও এখন সব সয়ে গিয়েছে।
সামনে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। মোটামোটি একটা ভাল সেলারির জবও পেয়েছি। ছোটখালা সেদিন ফোন করে জানিয়েছেন, আগামী মাসে গ্রামে ফিরতে। তারপর দিন তারিখ ঠিক করে তৃপ্তি আর আমার বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবেন। আমিও খালাকে জানিয়ে দিয়েছি সামনে মাসের শুরুতেই বাড়ি ফিরবো। সৌরভকে আমার বিয়ের ব্যাপারে বলতেই সে খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলো। বললো, কবে বিয়ে? আমি বললাম, আগামী মাসেই মেবি হয়ে যাবে। সে বললো, তাহলে তো মজা হবে মামা।
বাড়ি যাওয়ার আগের দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে শ্রাবণীর সাথে দেখা হলে তাকে বললাম, এই মাসের মাঝের দিকে আমার বিয়ে। তবে একটা বিষয় কী জানিস? আমি সত্যই তোকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তুই আমার ভালোবাসিসনি। বরং আমাকে সিক মেন্টালিটির একজন বানিয়ে দিলি। কী নেই আমার মধ্যে? সব আছে, সব। চেহারা, টাকা পয়সা সব।
সে কিছু বললো না। আমি চলে এলাম। পরদিন সৌরভকে কল করে বললাম, একেবারে তৈরি হয়ে আমার বাসায় চলে আয়। মনে রাখবি এক মাস থাকতে হবে আমাদের গ্রামে। সে বললো, আজই যাবি? আমি বললাম, হ্যাঁ আজই। আব্বা কল করেছিল।
– ওকে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তোর বাসায় পৌঁছে যাবো।
বিকেলে দু’জন পাবনার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম। টেকনিক্যাল থেকে “সরকার ট্রাভেলসের” দুইটা টিকিট নিতেই একজন লোক পেছন থেকে বলে উঠলেন, কে এটা? রাব্বি না? আমি পেছনে ঘুরতেই দেখলাম, জাহিদ মামা। উনি ঐযে বড়ইয়ের আঁচার দেওয়া নানির ছেলে। আমি বললাম, মামা আপনি? কেমন আছেন? কোথায় এসেছিলেন?
– আছি ভালোই। ঐ এ্যাকটা কাজের জন্যি আইছিল্যাম। তা, তুই ক্যামা আছিস?
– এইতো মামা আলহামদুলিল্লাহ। তা, নানি কেমন আছেন?
নানির কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি কেঁদে ফেললেন। তারপর চোখের পানি মুছে বললেন, তোর নানি মইরি যাবার সুমায় তোর কথা অনেকবার কইছিলি। কইছিলি যে, আমার ঐ ভাইটাকে যদি এ্যাকবার দেখত্যাম, তাহলি পরাণডা এ্যাকটু ঠাণ্ডা হইতি। মুহূর্তেই আমার ভেতরটা হু হু করে উঠলো। নানি যে আর আমাদের মাঝে নেই, সেটা ভাবতেই পারছি না আমি। তিনি বলেছিলেন, বড়ই হলে যেন আমি, বাধন, সাগর আর শাকিল মিলে তা চুরি করতে যাই। কিন্তু সেই প্রবৃত্তিটা আর পূর্ণ হলো না তার। মাঝখানে যদি একবার বাড়ি যেতাম। তাহলে হয়তো নানির সেই ইচ্ছাটা পূরণ হতো। মামাকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, কাঁদবেন না। একদিন তো সবাইকেই এই রঙিন ধরণী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তিনি কাঁধে থাকা গামছা দিয়ে চোখ মুছলেন। আমি বললাম, তা যেই কাজের জন্য এসেছিলেন। সেই কাজটা হয়েছে? তিনি বললেন, হ বাপ। সামনের মাস তিন (থেকে) কাজ শুরু।
– তা এখন কোথায় যাবেন?
– বাড়ি যাবো।
– আচ্ছা আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি। আপনি চেয়ারে গিয়ে বসুন।
মামা না না করলেও আমি টিকিট কেটে দিলাম। আসার সময় অনেক কথায় শুনলাম তার থেকে। নানি মারা যাওয়া পর বড়ই গাছটাও মারা গিয়েছে। পরে তিনি সেখানে ছোট্ট একটা বড়ই গাছ লাগিয়েছেন। অফিস থেকে টানা এক মাসের ছুটি নিয়েছি। এক মাস অনেক লম্বা সময়। ছুটি দেবে না তো দেবেই না। গত মাসের পারফরমেন্স এবং সাজ্জাদ ভাইয়ের সহযোগিতায় ছুটিটা পেয়েছি। উনাকে বিয়েতে যেতে বললে উনি বললেন, সময় পেলে বিয়ের আগের দিন চলে আসবেন। উনার বাড়িও পাবনাতে। আমার সদর থানা। আর উনার সুজানগর থানা। বাড়ি আসার পরদিনই ছোটখালা আমাদের বাড়িতে এলেন। তারপর আমাকে দেখে বললেন, কিরে আগের থেকে তো অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস। আমি লজ্জা পেলাম খানিকটা। আস্তে করে বললাম, খালা তৃপ্তি আসেনি?
– না।
– কেন?
– এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। বিয়ের দিনই দেখিস।
খালা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে চলে গেলেন। ১৪ তারিখে বিয়ে। আজ ২ তারিখ। আর মাত্র ১২ দিন বাকি। সৌরভকে সাথে করে পুরো গ্রামটা ঘুরতে লাগলাম। এদিকে পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে শুরু করে ওদিকে ইশ্বরদী রেলওয়ে, পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, এবং শিলাইদহ, সব জায়গা ঘুরলাম। সে বললো, মামা তোদের পাবনা এত সুন্দর! আগে জানলে তো আমি প্রতিবারই তোর সাথে ঘুরতে আসতাম। আমি বললাম, এখন থেকে আসিস তাহলে। বিয়ের দিন তৃপ্তিকে এক ঝলক দেখেছিলাম। আহ! আগের থেকে বেশ সুন্দরী হয়ে গিয়েছে। পরে আর দেখতে পারিনি। তাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সে পুরো রাস্তা গাড়ির মধ্যে ঘোমটা টেনে বসে ছিল।
রাতে ফ্রেশ হয়ে বাসর ঘরে ঢুকতেই আমি অবাক। এতো সুন্দর করে ঘরটা সাজালো কে? ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম, সৌরভ কল করেছে। আমি রিসিভ করতেই সে বললো, মামা ঘর সাজানো কেমন হয়েছে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুই সাজিয়েছিস? সে হাসলো কিঞ্চিৎ। তারপর বললো, শুভকামনা দোস্ত। আমি বিছানার কাছে এগিয়ে যেতেই তৃপ্তি বিছানা থেকে নেমে এসে আমাকে সালাম করলো। তারপর আবার যথাস্থানে গিয়ে বসলো।
ঘোমটা সরিয়ে তার মুখটা উঁচু করে ধরলাম। আহ! কী মায়াবি মুখ। চোখের মণিটা একবার এদিকে, একবার ওদিকে খেলা করছে। ছুটি ফুরিয়ে এলো। আমি আব্বা, আম্মু আর তৃপ্তিকে রেখে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার সময় তৃপ্তিকে বলে এলাম, আব্বা আম্মুর খেয়াল রেখো। আর আমি প্রতি মাসেই একবার করে বাড়ি আসবো।
সে মাথা ঝাঁকালো। ঢাকায় গিয়ে শুনি পরীক্ষার রুটিন ঠিক হয়ে গিয়েছে। এই মাসের সাত তারিখ থেকে পরীক্ষা। দেখতে দেখতে পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। একদিন রাতে হঠাৎই শ্রাবণীর কল পেয়ে অবাক হলাম। ভাবলাম, হয়তো সে ভুলে কল করেছে। তাই কলটা কেটে দিলাম। সে আবার কল করলো। আমি রিসিভ করে হ্যালো বললাম।
সে বললো, কেমন আছিস শ্রাবণ? আমি বললাম, ভালো।
– আমাকে জিজ্ঞেস করবি না, আমি কেমন আছি? আমি চুপ করে রইলাম। সে আবার বললো, তুই ঠিক ছিলি শ্রাবণ। ভুল ছিলাম আমি।
– হুম।
– রায়হান আমাকে নয়। বরং আমার শরীরটাকে ভালোবেসেছিল।
– হুম।
– আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না শ্রাবণ? প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে। অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি তোর সাথে।
– হুম।
– হুম হুম করছিস কেন? কথা বলবি না আমার সাথে?
– ফোন রাখুন, ব্যস্ত আছি। পরে কল করবেন।
আমি নিজেই কল রেখে দিলাম। বিয়ের আগে আব্বা অবশ্য শ্রাবণীর ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। পরে আমার আগ্রহ না দেখে আর কিছু বলেনি। আমি তৃপ্তিকে কল করলাম। ঘড়িতে তখন রাত ১১ টা বাজে। আমি জানি, সে জেগে নেই। তবুও কল করলাম। কয়েকবার রিং হতেই সে রিসিভ করে ঘুম ঘুম চোখে হ্যালো বললো। আহা! কী অনুপম কণ্ঠস্বর গো! আমি তার কণ্ঠের মায়ায় পরে গেলাম। তার ঘুম ভাঙিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বললাম। সে বললো, এখন ঘুমাই অনেক রাত হলো। আমি বললাম, বউ শুনো। সে বললো, আবার কী? ঘুমাতে দিন এখন।
– ভালোবাসি তোমায়।
– যতসব ঢং। এই মাসে বাড়ি আসেননি কেন?
– কাজের চাপ ছিল।
– এবার এসে তাহলে বেশ কয়েকটা দিন থেকে যাবেন।
– হ্যাঁ।
– এখন ঘুমাই।
– এই বউ শুনো না।
– বলো। পাশের রুমে আম্মু ঘুমায়। টের পেলে খবর আছে।
– একবার ভালোবাসি বলো না।
– না বলবো না।
– ওকে ঠিক আছে বলতে হবে না।
– এই এই রাগ করো কেন? ভালোবাসি তো।
– এভাবে না।
– তাহলে?
– বলো, ভালোবাসি আমার বরটাকে।
– ভালোবাসি আমার বরটাকে। এবার তো হয়েছে। এখন রাখি।
– আরেকবার বলো।
সে মৃদু হেসে ভালোবাসি বললে আমি কল রেখে দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। কাল আবার অফিস আছে।