বাসর ঘরে ঢুকলাম যথেষ্ঠ সাহস নিয়ে ৷ কিন্তু ঘোমটা দেওয়া বউয়ের দিকে নজর দিতেই কেন যেন সাহসটা হারিয়ে গেল ৷ টেবিলের উপরে রাখা দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢগঢগ করে গিলে, বউয়ের পাশে বসলাম ৷ তার চেহারা এখনই দেখবো না ৷ অনেকবারই তো দেখেছি ৷ একটু দেরিতে দেখলেই হবে ৷ এখন খুব জরুরি একটা কথা বলতে হবে, কথাটা বলা শেষ হলেই বউয়ের মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে মন জুড়িয়ে তার মিষ্টি চেহারার মায়াবী মুখখানা দেখবো ৷ ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, মৃদ্যুভাবে কেশে গলা পরিষ্কার করে নরম মোলায়েম কন্ঠে বউকে বললাম,
—-বউ, I Love You. এটা শুনেই বউ নড়েচড়ে উঠলো ৷ দ্রুততার সহিত মাথা থেকে ঘোমটা সরালো ৷ আমার দিকে চোখ দুটো এত্তো বড় বড় বানালো ৷ চোখ দেখে মনে হলো যেন উত্তপ্ত লোহার বল ৷ চোখ গরম করে বাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
—-আপনার তো সাহস কম না, আমাকে প্রোপজ করতে আসেন ৷ কি করে ভাবলেন যে আপনার মত এমন কাইল্লার প্রস্তাবে আমি রাজি হবো? জানেন আমার জন্য কতশত ছেলে পাগল ছিল? প্রতিটা ছেলে ছিল যথেষ্ঠ সুদর্শন অথচ তাদের একজনকেও পাত্তা দিইনি ৷ আর আপনার প্রস্তাবে সাড়া দিবো আমি? হুহ, শখ কত! অবাক চোখে বউয়ের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলাম ৷ সে বললো কি এটা? অন্য যে কেউ হলে তো আমার প্রোপস পেয়ে খুশিতে মিষ্টি করে হাসতো আর লজ্জায় লাজরঙ্গা হয়ে চোখ পিটপিট করতো ৷ অথচ এই মেয়ে বলে কি?
আশ্চর্যের অভিব্যক্তিতে বললাম,
—-আরে আমি তো তোমার স্বামী, আমার প্রস্তাবে রাজি হওয়াও যা, না হওয়াও তা ৷ তোমার তো খুশি হওয়া উচিত ছিল আমার প্রস্তাব পেয়ে ৷
—-আপনি আমার স্বামী তাতে কি? স্বামী হয়েছেন বলে কি আমাকে কিনে নিয়েছেন? আমি যার তার সাথে প্রেম করিনা ৷ আগেও করিনি, ভবিষ্যতেও করবোনা ৷
—–যার তার সাথে প্রেম করোনা মানে কি? তারমানে তুমি বুঝাচ্ছো সুদর্শন ছেলেদের সাথে প্রেম করতে?
—-আস্ত একটা গাধা! বলি একটা বোঝে আরেকটা ৷ শোনেন, আমি প্রেম করিনি ৷ করবোও না ৷
—-আমার সাথে যে করবে এটা নিশ্চিত ৷ প্রেম করবে বলেই তো এত সুন্দর করে সেজে আসছো ৷ গাল দুটোকে লাল টুকটুকে বানিয়ে আনছো! তোমার সৌন্দর্য দেখিয়ে আমাকে ঘায়েল করতে চাও!
—-চুপ করেন, এই সাজ আপনার জন্য নয় ৷ কাল সকালে যারা আমাকে দেখতে আসবে, তাদের জন্য ৷ যদি তারা আমাকে দেখতে এসে বলে বউ সুন্দর না, তাহলে আমারই খারাপ লাগবে ৷ তাই সুন্দর করে সেজে আসছি ৷ কেউ আর নিন্দাতে পারবেনা ৷
—-তোমার এই সাজতো রাতের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাবে ৷
—-কেমনে? চোখ কপালে তুলে ভ্রু কুঁচকে মিটমিট করে হেসে বললাম,
—-তুমি বোঝনা নাকি? চোখ রাঙিয়ে বউ বলল,
—-কি বুঝিনা?
—-থাক সময় হলেই বুঝবে ৷
—-ঠিকআছে, এখন সত্যি করে বলেন তো আমাকে কেমন লাগছে? হাসি চেপে রেখে ভাঙ্গা গলায় বললাম,
—-ফালতু লাগছে, ফালতু!
বউ প্রথমে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো ৷ অতঃপর মুখটা এতটুকু বানিয়ে চেহারা আমার দিক থেকে ফিরিয়ে নিলো ৷৷ বেশকিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বললাম না ৷ সেলফোনটা বের করে প্রিয় বান্ধবীকে ফোন করলাম ৷ রিং হচ্ছিল ৷ একদম শেষ দিকে ফোন রিসিভ করলো ৷ ওপাশ থেকে বলল,
—-কিরে, এখন কেন ফোন দিয়েছিস? তোর তো এখন বাসর ঘরে থাকার কথা ৷ নিচুস্বরে বললাম,
—-বাসর ঘর থেকেই তো ফোন দিয়েছি ৷
—-মানে কি? তোর বউ কিছু বলছেনা?
—-নারে, আমার প্রতি তার কোনো গুরুত্ব নেই ৷
—-এটা কেমন কথা? বউ মুখ ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ রক্তিম বানিয়ে অপলকে দেখছে আমাকে ৷ আচমকা সে তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,
—-কার সাথে কথা বলছেন? গম্ভীর গলায় বললাম,
—-আমার ফ্রেন্ডের সাথে ৷
—-মেয়ে ফ্রেন্ড নাকি ছেলে?
—-মেয়ে হলে কি সমস্যা?
—-যা জিজ্ঞেসা করছি সেটার জবাব দেন!
—-মেয়ে ফ্রেন্ড ৷ ওর নাম সায়মা ৷
—-আমি বলছি ফোনটা কেটে দেন ৷ আজকের পর থেকে ভুলেও কথা বলবেন না তার সাথে ৷
—-তোমার কথা মানবো কিসের জন্য?
—-যেটা বলছি সেটাই করেন ৷ নইলে…
—-নইলে কি?
—-নইলে কিছুনা ৷ আপনার যা ইচ্ছা তাই করুন ৷ কথাটি বলেই বউ বিছানায় শুয়ে পড়লো ৷ চেহারাটা আমার দিক থেকে ঘুরিয়ে নিলো ৷৷ সায়মাকে বলতে লাগলাম,
—-হুম, বল! ও আচ্ছা, একটা কথা বলার ছিল- তুই না বলেছিলিস কোথায় যেন ঘুরতে যাবি, তো সেটার ডেট ফিক্সড করলি কবে? সায়মা বলল,
—-নারে যাওয়া হবেনা ৷ তোর বিয়ে গেল, সামনের সপ্তাহে অদিতীরও বিয়ে ৷ তাছাড়া সায়ানও বিদেশ চলে গেছে ৷ সবাই তো যার যার কাজে ব্যস্ত, একা একা ঘুরা যায় বল?
—-সমস্যা কি আমি আর তুই যাবো, চল ৷
—-ধুর, তোর বউ রাগ করবে না? সে তোকে আমার সঙ্গে যেতে দিবে?
—-অবশ্যই দিবে ৷ যাহোক, অনেক কথা হলো, এখন ফোন রাখি ৷ খুব ঘুম পাচ্ছে আমার!
ফোন রেখে দিয়ে বউয়ের পাশেই চুপচাপ শুয়ে রইলাম ৷ বেশকিছক্ষণ পর খেয়াল করলাম বউ আমার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলছে অনবরত! সে মনে করছে আমি ঘুমিয়ে গেছি ৷ একটু পরই সে বলল, “ঘুমিয়ে গেলেন নাকি? আমার কিন্তু খুব ঘুম পাচ্ছে, বেশিক্ষণ জাগতে পারবনা ৷” তার মুখে একথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না, মরার মত হয়ে শুয়ে রইলাম ৷ একটু পর বউ আবারো নিচুকন্ঠে বলল,
—-এই যে শুনছেন? আমি কিন্তু ঘুমিয়ে গেলাম ৷
জবাব দিলাম না ৷ বেশকিছুক্ষণ পর বউ থেমে থেমে বলল, উহ! উনি নতুন বউকে জাগিয়ে রেখে ঘুমিয়ে গেছেন, তিনি নাকি আমাকে ভালবাসে ৷ ফালতু লোক একটা! এবারো কিছু বললাম না ৷ দেখি বউ আর কি কি বলে? কিন্তু বউয়ের আর কোনো কথায় শুনতে পেলাম না ৷ অকস্মাৎ, কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো ৷ নিচুশব্দে হো হো করে কাঁদছিল ৷ বুঝতে পারছি বউ কষ্ট পেয়েছে ৷ ঘুমিয়ে গেছি ধারণা করে সে কষ্ট গায়ে মেখেছে ৷ ক্রমশই বউয়ের কান্নার শব্দ বেড়ে চলছিল ৷ আর ঘুমের ভান করে থাকতে পারলাম না ৷ নড়েচড়ে উঠে তোরজোর কন্ঠে বউকে বললাম,
—-কি ব্যাপার কাঁদছো কেন? বউ ক্রন্দণরত অবস্থায় বলল,
—-আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই কাঁদছি ৷ আপনি ঘুমাচ্ছিলেন ঘুমান ৷
বুঝছি তার ভাব নেওয়া কমবেনা ৷ তাই আবারো শুয়ে পড়লাম ৷ শোবার সাথে সাথেই বউয়ের কান্না কমে গেল ৷ কিন্তু একটু পর সে আবারো কাঁদতে শুরু করলো ৷ আগের চেয়ে অত্যাধিক শব্দ করে ৷ হাউমাউ করে কাঁদছিল বিধায় আমার কান ঝালাফালা হয়ে যাচ্ছিল ৷ মিনিট পাঁচেক পর দরজায় কড়া নেড়ে আমার ছোট বোন উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
—-ভাইয়া, ভাবী কাঁদছে কেন রে? কি হয়েছে? দরজা খোল তো ৷ আম্মু দাঁড়িয়ে আছে ৷ দরজা আমি কি খুলবো ৷ বউ বিছানা ছেড়ে দরজার সামনে গেল ৷দ্রুততার সাথে দরজাটা খুলেও দিলো ৷ দরজা খোলা হলে ঘরের ভেতর ঢুকলো আব্বু, আম্মু ও ছোটবোন ৷ আম্মু বউকে জোর গলায় বলল,
—-বউমা কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?
বউ তার চোখের কোণের ও ফর্সা গালে লেগে থাকা অশ্রুসজলের বিন্দু বিন্দু কণাগুলো আঙ্গুল দিয়ে মুছে থেমে থেমে অস্ফুট স্বরে বলল,
—-আম্মা, আপনার ছেলেকে ভালবাসামাখা কন্ঠে প্রোপজ করে বলেছিলাম, “Love You আপনাকে খুব ভালবাসি ৷” এটার জবাবে সে আমাকে অপমানিত করেছে ৷ থাপ্পরও মেরেছে, এইযে দেখেন ডান গালে থাপ্পরের দাগ লেগে আছে৷ এখন সে বলছে আমাকে নাকি তার পছন্দ না ৷ তাই নিচে ঘুমাতে বলছে ৷ আমি হতভম্ব ৷ এমন কথা শুনতে হবে এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না ৷ থম মেরে রইলাম ৷ ওদিকে আব্বু, আম্মু ও ছোটবোনটাও ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো ৷৷ তারা আমার বউয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো ৷ আব্বু রাগস্বরে বলল,
—-সিনেমা করোস, সিনেমা? তোর দাঁত সবগুলো ভেঙ্গে ফেলবো বলে দিলাম ৷ তোর পছন্দমত বিয়ে হলো আর এখন উল্টাপাল্টা বকছিস? ইডিয়ট! ওদিকে আম্মু গরম চোখে তাকিয়ে রইলো ৷ আমার দিকে নজর দিয়ে বলল,
—-তুই আর মানুষ হইলি না ৷ কথাটা বলেই আম্মু আব্বুকে সঙ্গে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল ৷ ওদিকে ছোটবোনটা তার ভাবীর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
—-কিরে সিন্থিয়া কি হয়েছে সত্যি করে বলতো? ভাইয়া তোকে তো অনেক পছন্দ করে, সে কেন এরকমটা করবে; বল? জবাবে সিন্থিয়া বলল,
—-দোস্ত তুই এখন যা, তোর ভাইয়াকে একটু সোজা করবো ৷ সকালে কথা হবে তোর সাথে! ছোটবোনটাও চলে গেল৷ সে যাবার পর সিন্থিয়া দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল,
—-কি, কেমন দিলাম? হাই তুলে বললাম,
—-ভালোই দিছো, এবার আমাকে ঘুমাতে দাও, খুব ঘুম পেয়েছে ৷ ঘুমের সময় জাগাবে না ৷
—-মানে কি?
—-কিসের মানে কি?
—-বাসর রাতে কিসের ঘুম?
—-ঘুম ছাড়া কি?
—-ফাইজলামী করছেন? বউকে সাজিয়ে রাখার জন্য বোধহয় বিয়ে করে এনেছেন?
—-কি আর করবো বলো, জোর করে তো ভালবাসা পাওয়া যায়না ৷
—-কিসের জোর করলেন আপনি?
—-ঐযে প্রোপজ করলাম, আর প্রত্যাখান করলে ৷
—-তারমানে ওটার জন্যই এমনটা করে যাচ্ছেন? কিন্তু আমি তো মজা করেছিলাম তখন ৷
—-বিশ্বাস হয়না যে তুমি মজা করেছিলে!
—-আচ্ছা, ঠিকআছে; আমিই বলছি, Love You . আমি আপনাকে ভালবাসি, অনেক বেশি!
—-তোমার সাহস হয় কেমনে আমাকে প্রোপজ করো! জানো কত মেয়ে আমার জন্য পাগল ছিল? কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে আমার জন্য লাইন ধরে ছিল কিন্তু পাত্তা দিইনি, কারণ এপর্যন্ত বলেছি ওমনি সিন্থিয়া আমার পিঠে থাবর মারতে লাগলো ৷ কান ধরে শক্ত কন্ঠে বলল,
—-আমি সাহস পেলাম কেমনে, তাইনা? হুহ, দেখাচ্ছি কেমনে সাহস পেলাম! আর কি যেন বললেন অনেক মেয়ে লাইন ধরে ছিলো ৷ তো তাদের কেন পাত্তা দেন নি শুনি একটু! মিনমিন গলায় বললাম,
—-তাদের পাত্তা দিইনি কারণ আমার ছোট বোনটার কিউট একটা বান্ধবী ছিল, তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েই বাকিদের দূরে সরিয়ে দিয়েছি, সিন্থিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—-সে কে?
—-আমার বউ! সিন্থিয়া মুচকি হেসে আমার পিঠে থাবর মারতে মারতে বলল,
—-শয়তান একটা!
সিন্থিয়ার মৃদ্যু আঘাতটা যেন হ্নদয়ে ভালবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল ৷ আর তার হাসিতে পুরো শরীরটা ভাললাগায় শিহরিত হচ্ছিল ৷ মনের মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে আপন করে পাওয়া মানে পুরো দুনিয়াকে নিজের করে পাওয়া!